দেশের বেসরকারী চিকিৎসা সেবাখাতে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি)’র একটি গবেষনা রিপোর্টে। ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট উদ্যোগ ও বিনিয়োগে গড়ে ওঠা হাসপাতালগুলোতে চরম মাত্রার মুনাফাবাজির প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে রিপোর্টে। শহরের অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠা নামিদামি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবার উচ্চমূল্যের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে টিআইবির রিপোর্টে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবায় ব্যাপক অনিয়ম ও বাণিজ্যিকীকরণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে। সারাবিশ্বে স্বীকৃত মানুষের মৌলিক চাহিদা সমুহের মধ্যে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা অন্যতম। এ কারণেই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারই গ্রহণ করে থাকে। উন্নত ও উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশেই জনগণ বিনামূল্যে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার সুযোগ অথবা সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় বিশেষ সরকারী ভর্তুকির সুযোগ পেয়ে থাকে। আমাদের মত দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশেও জনগনের স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সাধারণ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। জনসংখ্যা ও চাহিদার তুলনায় সরকারী হাসপাতালের বেডসংখ্যা খুবই কম, সেই সাথে অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার কারণে দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বেসরকারী চিকিৎসা সেবার বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে।
সরকার একদিকে যেমন জনগনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে অন্যদিকে বেসরকারীভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে প্রত্যাশিত সেবা পাওয়ার অধিকার ও সেবার মান নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণহীনতার সুযোগে জেলা উপজেলা পর্যায়ে বাসাবাড়ি বা ভাড়া করা ভবনে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা খুলে বসছে যে কেউ। এ ক্ষেত্রে অনুমোদন বা রেজিস্ট্রেশনেরও তোয়াক্কা করেনা সংশ্লিষ্টরা। তারা ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা সেবায় নিজেদের ইচ্ছা মাফিক মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। উচ্চমূল্য দিয়েও এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে মানসম্মত বা নির্ভরযোগ্য সেবা পাচ্ছেনা সাধারণ মানুষ। চিকিৎসা সেবার মত অতি গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি না থাকায় নি¤œমান, ভুল চিকিৎসা ও প্রতারনার শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোতে জরুরী চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা অথবা অনীহার কারণেও অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটে থাকে। সম্প্রতি রাজধানীতে ছিনতাইয়ের কবলে পড়া এক রোগিকে একটি বেসরকারী হাসপাতালে জরুরী চিকিৎসা না দিয়ে আরেকটি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়ায় রাস্তায় তার মৃত্যু ঘটে। এ সম্পর্কে আদালতে একটি রীট পিটিশন দায়ের হলে শুনানি শেষে সব হাসপাতালকে রোগীর জন্য জরুরী তাৎক্ষণিক সেবা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় শহর ও জাতীয় পর্যায়ের সব হাসপাতাল মিলিয়ে দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশী নয়। শত শত সরকারী হাসপাতালের অবকাঠামো নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক,জনবল, সাজ -সরঞ্জামের কতটা মানুষের কল্যাণে ব্যয়িত হচ্ছে তার জবাবদিহিতা থাকতে হবে। দেশের বৃহত্তম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সরকারী ও বিশেষায়িত হাসপাতালে কোটি কোটি টাকা মূল্যে কেনা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি মাসের পর মাস অকেজো হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ সুযোগে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগিদের নানা ধরনের রোগ নির্নয়ের জন্য বেসরকারী হাসপাতাল বা ডায়গনোস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার কথা থাকলেও ব্যবস্থাপত্রের অধিকাংশ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। বাইরের ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। এ খাতে সরকারের বরাদ্দকৃত শত শত কোটি টাকার এক বড় অংশই দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে প্রভাবশালী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পকেটে চলে যায়। এমনকি সরকারী হাসপাতালে ওত পেতে থাকা বেসরকারী হাসপাতালের দালালরা রোগিদের বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যেতে বাধ্য করে। রোগি ভর্তি, ডায়াগনোসিস এবং ওষুধের কমিশনের ভিত্তিতে এসব কর্মকান্ডের সাথে সরকারী হাসপাতালের একশ্রেনীর ডাক্তারও জড়িত থাকে। বেসরকারী হাসপাতালের সেবার মান নিশ্চিত করতে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এসব হাসপাতালের জন্য আলাদা একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে টিআইবি রিপোর্টে। বেসরকারী হাসপাতালের সেবার মান, দক্ষতা, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবী। এক্ষেত্রে প্রথমেই সরকারী হাসপাতালের অবকাঠামো, জনবল ও সম্পদের সদ্ব্যবহার ও সুশাসন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা খাতের সব স্তরে কমিশন বাণিজ্য ও অতি মুনাফাবাজি রুখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন