বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

কি লাভ হলো সিএনজি ভাড়া বাড়িয়ে? এখন ভাড়া ডাবল : তারপরেও বখশিশ

প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

॥মোবায়েদুর রহমান॥
সেই পাকিস্তান আমলে একটি সিনেমা দেখেছিলাম। নাম ‘সাত ভাই চম্পা’। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন মরহুম খান আতাউর রহমান। ছবির নায়িকা ছিলেন কবরী এবং নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। ছবির শেষ দিকে একটি গান আছে যেটি দর্শকদের আবেগকে খুব নাড়া দেয়। গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন হচ্ছে,
শোনেন শোনেন জাঁহাপনা,
শোনেন রানী ছয় জনা
শোনেন বলি নতুন করে
পুরান ঘটনা।
আজ (রবিবার) সকালে সিএনজি যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা লিখতে গিয়ে ওপরের গানের কয়েকটি কলি খুব বেশি করে মনে পড়ছে। সত্যি কথা বলতে কি, আজকে যা কিছু বলব তার কোনটিই আপনাদের কাছে নতুন মনে হবে না। সবই পুরান ঘটনা। তবে নতুন পটভূমিতে নতুন কনটেক্সটে বলতে হচ্ছে।
কয়েক মাস আগে সিএনজি চালকদের সাথে বৈঠক করে সরকার সিএনজির নতুন ভাড়া ঠিক করেছে। কিন্তু নতুন যে ভাড়া এসেছে সেটি ঐ নতুন বোতলে পুরানা মদ রেখে দেয়ারই শামিল। এখন ঢাকায় দুই ধরনের সিএনজি চালিত বেবী ট্যাক্সি চলছে। একটি হলো, সবুজ রংয়ের এবং আরেকটি হলো, সাদা রংয়ের। সবুজ রংয়ের সিএনজিতে মিটার বসানো হয়েছে। সাদা রংয়ের সিএনজিতে কোনো মিটার নেই।
সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একজন করিৎ কর্মা লোক। তিনি মাঝে মাঝেই সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে সাথে সিকিউরিটি পরিবেষ্টিত হয়ে তার বিভাগের কাজ কর্ম তদারক করেন। এটি খুবই ভালো কথা এবং খুব ভালো অভ্যাস। আমি তো বলব বরং রূপকথার বাদশা হারুন অর রশিদের মতো ছদ্মবেশ ধরে তিনি যদি সিএনজির কার্যকারিতা দেখতেন তাহলে জনগণের অনেক উপকার হতো। এই যে মহানগরী জুড়ে সরকারের অসংখ্য ট্রাফিক পুলিশ এবং প্যাট্রোল পুলিশ কর্মরত রয়েছে তারা কি কাজ করে? লাইসেন্সও নেই আবার মিটারও নেই- এমন সিএনজিকে রাস্তায় চলতে দেয়া হয় কেন? একই রাজ্যে দুই রকম নিয়ম? এটাতো কোনো দিন হতে পারে না। কিন্তু সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে সেটাও তো এখন হচ্ছে।
সবগুলো সাদা সিএনজির পেছনে লেখা থাকে প্রাইভেট। একটি দেশে কি হাজার হাজার প্রাইভেট সিএনজি চলতে পারে? আর যদি প্রাইভেট সিএনজি হবে তাহলে তারা ভাড়ায় যাত্রী বহন করে কিভাবে? এ ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে কলাবাগানের ট্রাফিক পুলিশকে বলেছি। দেখলাম, তারা বিষয়টিতে মোটেই গা করছে না। তারা বলে, আপনি বরং মন্ত্রীর সাথে কথা বলেন। অর্থাৎ পুলিশের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তাহলে কথা হলো, মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করা কি যার তার পক্ষে সম্ভব? সেই জন্যই খবরের কাগজের আশ্রয় নিলাম, যদি তারা মেহেরবানী করে জনগণের এসব ভোগান্তির কথা শোনেন। এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত। অতীতে অনেক লেখা লেখি হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আপনি যদি সাদা সিএনজিতে উঠতে চান তাহলে সিএনজি ড্রাইভার একটি ভাড়া হাঁকবে। কাছে কূলে গেলে ১৫০ টাকা। একটু দূরে গেলে ২০০ টাকা। এয়ারপোর্টে গেলে ৫০০ টাকা। আর এয়ারপোর্ট থেকে আপনি যদি বিদেশ ফেরত হিসেবে ঘরে ফেরেন তাহলে ওরা নির্ঘাত হাঁকবে ১ হাজার টাকা। এই যে তারা ১৫০, ২০০, ৫০০ বা হাজার টাকা ভাড়া দাবি করেন সেই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তাদের সাফ জবাব, স্যার আমাদের মিটার নেই। তাই আপনাকে কনট্রাক্টে যেতে হবে। মিটার কেন নেই সেটি জিজ্ঞেস করলে তারা দাঁত কেলিয়ে হাসে। সেই জন্যই মন্ত্রী, সচিব, প্রমুখের কাছে সোজা প্রশ্ন: আপনারা এক দেশে এক শহরে সাদা ও সবুজের দুই সিস্টেম রেখেছেন কেন? একই সাথে সবুজ সিএনজি এবং সাদা সিএনজির ভাড়ার হারে আসমান জমিন তফাৎ থাকবে কেন?
॥দুই॥
সবুজ সিএনজিকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন, ভাই অমুক জায়গায় যাবে? তার গৎবাঁধা উত্তর, না যাব না। ৭০ শতাংশ সিএনজিওয়ালার উত্তর মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মন্ত্রী-সচিবরা সাহেবরা ঘন ঘন বিদেশ যাতায়াত করেন। তাদের তো বিদেশ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকার কথা। উন্নত দেশগুলো তো দূরের কথা, আপনি পাশের দেশ ভারতে যান। সেখানেও কোনো সিএনজি আপনাকে বলবে না যে, সে যাবে না। সিএনজি রাস্তায় নেমেছে, অথচ এখানে বলে বেড়াচ্ছে, ওখানে বলে বেড়াচ্ছে যে যাবো না। এমন কথা বলার কোনো অধিকার তাদের নেই। রাস্তায় যখন সিএনজি নেমেছে তখন তাকে যে এলাকার রুট পার্মিট দেয়া হয়েছে তাকে সেই এলাকায় যেতেই হবে। চলতি বছরই ইংল্যান্ডের একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার বলছিল যে, সে যাত্রীর বলা স্থানে যাবে না। যাত্রীটি এতখানি সমাজ সচেতন যে, তিনি সাথে সাথেই নিকটবর্তী ট্রাফিক পুলিশে অভিযোগ করেন। পুলিশ এসে সাথে সাথেই এই ট্যাক্সিটি বায়েজাপ্ত করে এবং ট্যাক্সিওয়ালাকে গ্রেফতার করে।
এই তো বছর দেড়েক আগে আমি স্বপরিবারে ভারতের কলকাতা এবং হায়দারাবাদ ঘুরে এলাম। কলকাতা বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বেরিয়ে আসতে রাত প্রায় সাড়ে ১১টা হয়ে গেল। বিমানবন্দরের বাইরে আসার সাথে সাথেই অনেকগুলো ট্যাক্সি আমাদের সামনে এলো। আমরা একটি ট্যাক্সি ঠিক করে মালপত্র উঠালাম। তারপর তাকে বললাম, অমুক হোটেলে চল। বিনা বাক্যব্যয়ে সে আমাদেরকে মিটারে সেখানে নিয়ে গেল। হায়দারাবাদে ‘ভিভান্তি’ বলে একটি পাঁচ তারা হোটেল আছে। হোটেল থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকের একটি মার্কেটে হেঁটে গেলাম। মার্কেটের কাজ সেরে রাস্তায় এসে ট্যাক্সি এবং অটো রিক্সার জন্য হাত তুললাম। মুহূর্তের মধ্যে চারটি অটো এবং তিনটি ট্যাক্সি এসে হাজির। আমরা দুটো অটোতে উঠলাম। চালক মিটার ডাউন করে জিজ্ঞাসা করল, আমরা কোথায় যাব? আমাদের গন্তব্য বললে সে আমাদেরকে সেখানে নামিয়ে দিল এবং মিটারে যে ভাড়া উঠেছে সেটাই তাকে পেমেন্ট করলাম।
॥তিন॥
আপনি কি এই দৃশ্য ঢাকায় কল্পনাও করতে পারেন? ঢাকার সিএনজিওয়ালাদের প্রথম উত্তর হলো, যাবো না। তারপর যদিও বা যেতে রাজি হলো তখন শর্ত হলো, মিটারে যে ভাড়া উঠবে তারচেয়ে ৩০/৫০ টাকা বেশি দিতে হবে। গত সপ্তাহে একটি নতুন প্রবণতা দেখলাম। মিটারওয়ালারা বলছে, স্যার আমার মিটার খারাপ। আপনাকে কনট্রাক্টে যেতে হবে। এখন বুঝুন ঠেলা। নতুন ভাড়া নির্ধারণ করায় কি লাভ হয়েছে যাত্রী সাধারণের? আগে প্রথম ২ কি.মি.-এর ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। এখন সেটি ৪০ টাকা। আগে পরবর্তী ২ কি.মি.-এর বাড়া ছিল ৭.৬৪ টাকা আর এখন ১২ টাকা। আগে প্রতি মিনিটের হলটেজ ছিল ১.০৪ টাকা। বর্তমানে ২ টাকা। কি লাভ হয়েছে যাত্রীর? ভাড়া বলতে গেলে প্রায় ডাবল করা হয়েছে। তারপরেও অতিরিক্ত ৩০/৫০ টাকা। এ যে দেখছি ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’। এ সরকার কি সাধারণ জনগণের? নাকি বাস এবং সিএনজি মালিকদের?
বিআরটিএর এনফোর্সমেন্ট দপ্তরের পরিচালক বিজয় ভূষণ পাল বলেন, মিটারে না যাওয়া ও নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে না চাওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৫ জানুয়ারি বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৮টি সিএনজি চালিত অটো রিকশাকে ডাম্পিংয়ে (ভাগাড়ে) পাঠান। একই সঙ্গে ১৯ জন চালককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেন। পরের দিন ২৬ জানুয়ারি ২৬টি অটো রিকশা ডাম্পিং করা হয় এবং ৩২ জন চালককে দ- দেয়া হয়। এটি শুধু দুই দিনের হিসাব। প্রতিটি যানবাহনের অনিয়ম ধরার জন্য বিআরটিএ প্রতিদিনই পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। প্রতিদিনই চালকদের জরিমানাসহ অটো রিকশা ডাম্পিং করা হচ্ছে।
পরিচালক সাহেবের এই তথ্য আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু তারা যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছেন সেগুলো দৃশ্যমান নয়। যদি দৃশ্যমান হতো তাহলে সিএনজির মালিক বা ড্রাইভারদের মধ্যে একটি ভীতির সৃষ্টি হতো। সেটি মোটেই হয়নি। কারণ আপনি টিকাটুলি, মতিঝিল, কলাবাগান, গুলশান বা বনানী যেখানেই যান না কেন, দেখবেন বেবী ট্যাক্সি চালকরা এখন সরকারের নির্দেশ এবং সিদ্ধান্ত মোটেই মানছে না। সিএনজি চালকরা মিটারে যেতে অস্বীকার করছে অথবা বেশি টাকা চাচ্ছে, সেই কথা আপনি যদি ট্রাফিক পুলিশকে জানান তখন ট্রাফিক পুলিশ ঐ চালকের সামনেই আপনাকে বলবে, ভাই চালকের সাথে ‘ভাও’ করে নিন। খামাখা তার সাথে গ-গুল করে লাভ কি?
এই হলো আমাদের দেশের পুলিশ। যারা অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে বলে। এটিই যদি তাদের রূপ হয় তাহলে যাত্রী সাধারণ কোথায় যাবে? ট্রাফিক পুলিশের ভাষায় সেই ভাও করা ছাড়া মানুষের সামনে আর কোনো বিকল্প থাকে না।
॥চার॥
বিষয়টি নিয়ে আগেও আমি ইনকিলাবের এই কলামে লিখেছি। কোনো কাজ দেয়নি। বাংলাদেশের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি কিছুদিন আগে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। সেখানকার সুশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থা দেখে তিনি হতাশ হয়ে বলেছিলেন, আমাদের দেশে জনগণের মধ্যে আইনকে অশ্রদ্ধা করা এবং আইন ভাঙ্গার এই প্রবণতা প্রতিদিন ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এটি শুধু ট্রাফিক ব্যবস্থাই নয়, এর সাথে জনগণের মাইন্ড সেট জড়িত। আমাদের দেশের মানুষ বিদেশে গেলে তাদের আইন-কানুন শতকরা ১০০ ভাগ পালন করে চলে। সেই একই মানুষ ছুটি ছটায় দেশে আসলে আইন কানুনের প্রতি এতো অশ্রদ্ধাশীল হয় কেন?
বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে এখন।
journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Rakib ২৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:১২ পিএম says : 0
sudu amader voganti
Total Reply(0)
Kiron ২৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:২০ পিএম says : 0
সবুজ সিএনজি এবং সাদা সিএনজির ভাড়ার হারে আসমান জমিন তফাৎ থাকবে কেন?
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন