জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সংক্রান্ত মামলার রায় ঘোষণার বেশ আগে থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান শুরু করে পুলিশ। রায় ঘোষণা এবং বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পরও সে অভিযান অব্যাহত আছে। এ পর্যন্ত কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও ৮ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত এক হিসাবে গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির দাবি মতে, তার সাড়ে তিন হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য মতে, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী। পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সাধারণ মানুষও রয়েছে, যাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। কিছু নজিরও খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়, বিভিন্ন উপলক্ষে পুলিশ গ্রেফতার অভিযান চালায় এবং সেই অভিযানে নিরিহ সাধারণ মানুষও পুলিশের দুর্ব্যবহার, হয়রানি ও গ্রেফতারের শিকার হয়। ভিন্ন মত প্রকাশ, সভা-সমাবেশ ও মিছিল ইত্যাদি করার অধিকার রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের রয়েছে। গণতন্ত্র এ অধিকার দিয়েছে। যে দেশ বা সমাজে গণতন্ত্র আছে বলে দাবি করা হয়, সেখানে এ অধিকার থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তুু আমাদের দেশে এ অধিকার সংকুচিত করতে করতে একেবারে প্রান্তিক কিংবা নেই পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশকেই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশকে যখন যাচ্ছেতাই করার অধিকার দেয়া হয়, দেয়া হয় দায়মুক্তি তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তার অসংখ্য নজির আমাদের দেশে রয়েছে। সুষ্ঠু আইনশৃংখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ অভিযান চালাতেই পারে। সেক্ষেত্রে গ্রেফতার অনিবার্য। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করলে কারোই আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তুু বাস্তবতা এই যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষদেরও গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার পরিণত হয় গণগ্রেফতারে। গণগ্রেফতার কাম্য নয়। এতে গণহয়রানির পাশাপাশি গ্রেফতার বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে।
বিএনপি দেশের দুটি বড় দলের একটি। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের অধিকার অন্যান্য দলের মতো তারও আছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তার পক্ষে নির্বাধে কোনো কর্মসূচীই পালন করা সম্ভব হয় না। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্যান্য দলের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। এটা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ বা অবস্থার পরিচয় বহন করে না। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সংক্রান্ত মামলার রায়ের আগে পরে বিএনপির তরফে যেসব কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে সেসব কর্মসূচী শান্তিপূর্ণভাবে করার প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, এসব কর্মসূচীতে পুলিশের বাধা এসেছে। পুলিশ মারমুখী আচরণ করেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদেরও পুলিশের মতো একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। ৩০ জানুয়ারি রাজধানীর কদম ফোয়ারার কাছে একটি ঘটনা ঘটে। পুলিশের ভ্যান থেকে দু’জন আসামীকে জোর করে ছিনিয়ে নেয়া হয়। এটা অবশ্যই নিন্দনীয় কাজ। এর সঙ্গে যারাই জড়িত থাক, তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা আবশ্যক। ভিডিও ফুটেজ থেকে এই অপকর্মে জড়িতদের চিহ্নিত ও গ্রেফতার করা মোটেই কঠিন নয়। অথচ দেখা গেছে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শত শত লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এমন অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা ঘটনাস্থলের আশেপাশে এমনকি ঢাকাতেও ছিলনা। বুঝায় যায়, ওই ঘটনাকে উপলক্ষ করে ইচ্ছেমত গ্রেফতার করা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার পর নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দেয়া অমূলক নয়। জানা গেছে, গ্রেফতারের আগে বেগম খালেদা জিয়া যে কোনো পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের ধর্য অবলম্বন ও শান্ত থাকার নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তার অবর্তমানে শীর্ষ নেতারা প্রতিবাদ, বিক্ষোভের যে কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন তাতে নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে অংশ নেয়ার আহŸান জানিয়েছেন। দেখা গেছে, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালনের সময়ও বাধা দেয়া হয়েছে অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। কোনো কর্মসূচীতে আইনশৃংখলা ও নাগরিক নিরাপত্তা ব্যহত হলে পুলিশ যথাবিধি ব্যবস্থা নিতে পারে। কোনো আশংকা থাকলে প্রয়োজনীয় সতকর্তামূলক ব্যবস্থা নেয়ার অধিকারও পুলিশের রয়েছে। এছাড়া যে কোনো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনে সহায়তা দেয়া গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশের কর্তব্য হিসাবেই গণ্য। এই কর্তব্যরোধের পরিচয় পুলিশের কাছ থেকে কদাচিৎ পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকার যা চায় পুলিশ তাই করে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সংক্রান্ত মামলার রায় ঘোষণার পর, পর্যবেক্ষক মহলের আশংকা, রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। দেখা দিতে পারে সংঘাত-সহিংসতা। নির্বাচনের বছর হওয়ায় রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান যখন জরুরি, তখন এর ব্যতিক্রমটিই দেখা দিতে পারে যা দেশের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। আশংকার এহেন পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচিৎ হবে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন পরিহার করে সহাবস্থানের অনুকূল পরিবেশ নির্মাণে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখা। হামলা, মামলা ও গণগ্রেফতার এই পরিবেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। এধরনের একতরফা ব্যবস্থা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কাজেই পুলিশকে সংযত করতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়া কেউ যেন গ্রেফতার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি যথাযথভাবে আমলে নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন