ডা. শোভন দাশ
অর্থনীতি, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষাখাত, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও কৃষিতে যে পরিমাণ উন্নতি হয়েছে সে তুলনায় পিছিয়ে আছে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। একটি সুস্থ জাতি গঠনে রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা যতই বৃদ্ধি পাবে, আমরা পিছিয়ে পড়বো ততই। অবকাঠামো উন্নয়ন, কিছু স্বল্পমেয়াদি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ছাড়া জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির আলোকে পুরো জাতিকে শতভাগ স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার জন্য এখন পর্যন্ত কোন সরকারই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থাহীন হয়ে দেশের মানুষ ছুটছে বাইরের দেশে চিকিৎসা নিতে। সেই সাথে বাংলাদেশের জনগণ হারাচ্ছে বিপুল অর্থও।
একজন চিকিৎসক সেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসা পেশা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত সেবার মনোভাব উবে গিয়ে ব্যবসায়িক হয়ে যান কিংবা হতে বাধ্য হন। এই চিকিৎসকদের বিশেষ করে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের ড্রাগ লাইসেন্স প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। হোমিও চিকিৎসকদের ড্রাগ লাইসেন্স প্রয়োজন নেই মর্মে ১৯৮৪ সালের ৩ মার্চ ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তর একটি সার্কুলার জারি করে (নং : ডিএ/এডমিন-৫১৭/৮৩/৯৪৪)। পূর্বে একজন হোমিও চিকিৎসকের চেম্বারে ড্রাগ লাইসেন্স রাখার বিধান কিংবা প্রয়োজনীয়তা ছিল না।
১৯৪০ সালের ওষুধ নীতি ১৯৮২ সালে সংশোধিত হয়, যেখানে বলা হয়, একজন চিকিৎসক শুধুমাত্র প্রেসক্রাইব করবেন। তবে ওষুধ বিক্রি করতে পারবেন না। একজন চিকিৎসক যদি এক শিশিও ওষুধ চেম্বারে রাখেন তাহলে তাঁকে অবশ্যই ড্রাগ লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। তবে, হোমিও চিকিৎসকদের ড্রাগ লাইসেন্সের জন্য সরকারি ফি দুই হাজার টাকা হলেও অনেক সময় দশ হাজার টাকা খরচ করলেও লাইসেন্স পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। সাথে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস ডিএইচএমএস/বিএইচএমএস সার্টিফিকেট, রেজিস্ট্রেশন সনদ, দোকান ভাড়ার রশিদ/স্থায়ী দোকানের জায়গার দলিল, কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, পাসপোর্ট ছবি, সম্ভাব্য ক্ষেত্রে টিন সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয় পত্র/জন্ম-নিবন্ধন এর কপি দিতে হবে। এর নবায়ন ফি পনেরশ টাকা।
ওষুধ ব্যবসায়ীরা দোকানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওষুধ প্রশাসনের কাছ থেকে ড্রাগ লাইসেন্স নিয়ে থাকেন। ওষুধ প্রশাসনের নির্ধারিত ফরম-৭ এর মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। ব্যাংক সচ্ছলতার সনদপত্র, ট্রেজারী চালান, দোকান ভাড়ার রশিদ বা চুক্তিপত্রের সত্যায়িত কপি, নিজস্ব দোকান হলে দলিলের কপি, পৌর এলাকার জন্য ট্রেড লাইসেন্স এর কপি, ফার্মাসিস্টের অঙ্গীকারপত্র, ফার্মেসী কাউন্সিল থেকে ছয়মাস মেয়াদি ফার্মাসিস্ট সনদ কপি, টিন সার্টিফিকেট কপি, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি, পাসপোর্ট ছবি দুই কপি। এ, বি, সি তিন ক্যাটাগরিতে ফার্মাসিস্ট সনদ দেওয়া হয়। বিশ^বিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রীধারীরা এ গ্রেড, ডিপ্লোমাধারীরা বি গ্রেড এবং মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে শর্ট কোর্সধারীদের সি গ্রেড দেওয়া হয়। শর্ট কোর্সটি করানো হয় বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির তত্ত্বাবধানে। দেশের প্রায় ৬৪টি জেলায় এই সমিতির শাখা রয়েছে। প্রায় চল্লিশটি ক্লাস করিয়ে দুই ঘণ্টার একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। উত্তীর্ণদের সনদ দেওয়া হয় যার কোর্স ফি এক হাজার ৭৫০ টাকা। লাইসেন্স ফি ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে জমা দিতে হয়। পৌর এলাকার ফি তিন হাজার, মফস্বলে পনেরশ টাকা। দুই বছর পর লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। নবায়ন ফি পৌর এলাকার জন্য দুই হাজার আর মফস্বলের জন্য এক হাজার টাকা। তিন মাস পরপর ওষুধ প্রশাসনের সভা হয়, যেখানে তথ্যগুলো যাচাই সাপেক্ষে লাইসেন্স দেওয়া হয়। নতুন লাইসেন্স পেতে প্রায় দুই-তিন মাস সময় লাগে আর নবায়ন করতে লাগে প্রায় সপ্তাহ খানেক সময়। হোমিও ওষুধ প্রস্তুতের ফি দুই হাজার টাকা, শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ছয় হাজার টাকা, মাদার-টিংচারের জন্য পনের হাজার টাকা।
ওষুধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ড্রাগ অ্যাক্ট-১৯৪০, ড্রাগ রুলস-১৯৪৫, বেঙ্গল ড্রাগ রুলস-১৯৪৬, ড্রাগ (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২ এবং জাতীয় ওষুধ নীতি-২০০৫ অনুসরণ করা হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইন ও প্রবিধানসমূহ কোন দেশে ওষুধের উৎপাদন, বিতরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করে এবং সে সাথে এটাও নিশ্চিত করে যে, ওষুধগুলো ভালোমানের ইপ্সিত ফল প্রদানে সমর্থ ও নিরাপদ। বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধের নিবন্ধন, উৎপাদন, বিতরণ, বিক্রয়, আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় ঞযব উৎঁমং অপঃ ১৯৪০ (ঢঢওওও ঙভ ১৯৪০) এবং ঞযব উৎঁমং (ঈড়হঃৎড়ষ) ঙৎফরহধহপব, ১৯৮২ (ঙৎফরহধহপব.ঠওওও ঙভ ১৯৮২) দ্বারা।
জাতীয় ওষুধনীতি ২০০৫-এ বলা হয়েছে, দেশে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য সুযোগ-সুবিধা স্থাপনে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা। ওষুধ প্রস্তুতবিদ্যা, জীববিদ্যা প্রযুক্তিবিদ্যা, জেনেটিক প্রকৌশল বিদ্যা ও জীব চিকিৎসা বিজ্ঞানসমূহের ক্ষেত্রে মৌলিক ও ফলিত গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বিশ^বিদ্যালয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং প্রস্তুতকারকদের মধ্যে সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা। ব্যবস্থাপত্র প্রদানকারী এবং প্রান্তিক ব্যবহারকারীদের যথাযথ পরামর্শদান ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক। তবে একথা সত্য যে, জার্মানির উইলমার সোয়েব, বিটি আমেরিকা, ভারত, সুইজারল্যান্ড, কেন্ট, ব্যাকসন, হ্যানিম্যানসহ অন্যান্য বিদেশী হোমিও ল্যাবরেটরীর মতো দেশীয় ল্যাবরেটরীগুলো আন্তর্জাতিকমানের হয়ে গড়ে উঠতে পারেনি।
হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির মূলসূত্র (অর্গানন, ফার্মাকোপিয়া, নিয়মনীতি, শক্তি ও মাত্রা তত্ত্ব) অনুযায়ী ওষুধসমূহের সংমিশ্রণ প্রস্তুত আমদানি ও বিক্রয়ের জন্য নিবন্ধনের অনুমতি প্রদান করা যাবে। মাদারটিংচার, অশোধিত ট্রাইট্যুরেশন ও ১২টি বায়োকেমিক ওষুধের ১ঢ পটেন্সির জন্য নিবন্ধনের প্রয়োজন হবে। কিন্তু হোমিওপ্যাথিক ও বায়োকেমিক শ্রেণির ওষুধসমূহের পটেন্সী আরও বৃদ্ধির জন্য কোন নিবন্ধনের প্রয়োজন হবে না। হোমিওপ্যাথিক ও বায়োকেমিক ওষুধগুলোর নিবন্ধনের জন্য উন্নত দেশসমূহের গৃহীত হোমিওপ্যাথিক ও বায়োকেমিক ফার্মাকোপিয়াসমূহে নির্ধারিত প্রমিত মানসমূহ অনুসৃত হবে। উৎপাদিত ওষুধের নিরাপত্তা, মান ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সেগুলো নিবন্ধিত হবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে নবায়ন করা লাইসেন্সের সংখ্যা ছিল এক হাজার ১২২টি। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪০৬টিতে। বিগত বছরের জুলাইয়ে নবায়ন করা লাইসেন্সের সংখ্যা ছিল ১৪৯টি। অভিযান শুরুর পাঁচ মাস পর নভেম্বর মাসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৬৭টিতে। পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, ২০১৪ সালের অগাস্টে লাইসেন্স নবায়নের সংখ্যা ছিল ২১০টি। গত বছরের একই মাসে সেটি হয়েছে ২৫৯টি। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ২৩৪টি লাইসেন্স নবায়নের বিপরীতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সেই সংখ্যা ২৭৭টি। আর ২০১৪ সালের অক্টোবরে নবায়ন করা লাইসেন্সের সংখ্যা ২২৯টি বিপরীতে গত বছরের অক্টোবরে তা দাঁড়িয়েছে ৩৫৪টিতে। লাইসেন্স নবায়নের সংখ্যা বাড়ায় স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে এ খাতে লাইসেন্স নবায়ন বাবদ রাজস্ব আদায়।
ওষুধ অতি গুরুত্বপূর্ণ জীবন রক্ষাকারী পণ্য। সঠিক ও বিশুদ্ধ মানসম্পন্ন ওষুধ যেমন জীবন রক্ষাকারী হতে পারে আবার মানহীন ভেজাল পণ্য জীবননাশেরও কারণ হতে পারে। এই গুরুত্বপূর্ণ পণ্যটি যথাযথ মান নিয়ে যথাযথভাবে যেন সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে সেটি নিশ্চিত করা একটি গুরুদায়িত্ব। ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা তদারকির এই দায়িত্বশীল কাজটি আমাদের দেশে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত। অথচ এই ওষুধ প্রশাসন নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। দেশে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে নৈরাজ্য এবং তা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ প্রশাসনের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে ওষুধ প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে জনবল বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও তেমন পরিবর্তন হয়নি এ খাতটিতে। দীর্ঘদিন থেকে শিকড় গেড়ে থাকা অনিয়ম-দুর্নীতি বর্তমানে ফুলে ফেঁপে বড় আকার ধারণ করেছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের প্রায় প্রতিটি ধাপে অনৈতিক অর্থ লেনদেন চলে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কী পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে ওষুধ প্রশাসনে। ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই নতুন ড্রাগ লাইসেন্স ইস্যু বন্ধ রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই ব্যাপারে দিকনির্দেশনা না আসা পর্যন্ত নতুন ড্রাগ লাইসেন্স ইস্যু করা হবে না বলে জানানো হয়েছে। তবে নতুন ড্রাগ লাইসেন্স ইস্যু বন্ধ থাকলেও থেমে নেই অভিযান।
একজন চিকিৎসক শুধুমাত্র সেবাই দেন না, তিনি সমাজের সম্মানীত ব্যক্তি। কাজেই ড্রাগ লাইসেন্স যাতে সহজ পন্থায় হয়রানি ছাড়াই পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। হোমিও চিকিৎসকরা রোগীদের কাছ থেকে ফি হিসেবে বিশ-পঞ্চাশ টাকা নিয়ে থাকেন। তাদের পক্ষে অনৈতিকভাবে দশ/বারো হাজার টাকা লেনদেনের মাধ্যমে ড্রাগ লাইসেন্স প্রাপ্তি অসম্ভব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন, নতুন ড্রাগ লাইসেন্সের ইস্যু ফি এবং নবায়ন ফি কমিয়ে হোমিও চিকিৎসকদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন দেশ ও জনগণের স্বার্থে।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক ও চিকিৎসক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন