সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

সমঝোতা ছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অসম্ভব

প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এম এম খালেদ সাইফুল্লা
বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল অধিবেশনে দেয়া ভাষণে বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্য, সমঝোতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে আবারও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। নিজের এ আহ্বানের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও পরিষ্কার বক্তব্য রেখেছেন তিনি। বলেছেন, সংলাপ শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার কিংবা নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য নয়। সংলাপের প্রধান ছয়টি উদ্দেশ্য রয়েছেÑ ১. দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা; ২. জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে একটি জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করা; ৩. জনগণ ভোটের যে অধিকার হারিয়েছে সে অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা; ৪. কারা সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনা করবে তা নির্ধারণের অধিকার জনগণকে দেয়া; ৫. রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং ৬. সংকট ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমঝোতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা।
বিরোধী দলের বিরুদ্ধে চলমান দমন-নির্যাতনসহ অন্য কিছু প্রসঙ্গেও বলেছেন বেগম খালেদা জিয়া। যেমন সংসদীয় সরকারের আবরণে দেশে যে আসলে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসন চালানো হচ্ছে সে ব্যাপারে উদাহরণের পর উদাহরণ দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমন অবস্থার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন তিনি। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণœ রেখেও বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও পেশার জ্ঞানী-গুণী ও মেধাবী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদের একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ জন্য জাতীয় সংসদকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট করতে হবে। উচ্চকক্ষের সদস্যদের মাধ্যমে সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষের সব সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করা যাবে সংসদে। এর ফলে সমস্যা সমাধানের পথও বেরিয়ে আসবে সহজে। অঙ্গীকার ঘোষণা করে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে সংসদকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। রেফারেন্ডাম বা গণভোট প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গণভোটের আয়োজন করা হবে। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণকে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং যে কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে গণভোটের আয়োজন করতে হবে, জনগণ যাতে ব্যালটের মাধ্যমে নিজেদের মতামত তুলে ধরতে পারে।
কাউন্সিল অধিবেশনে দেয়া বক্তৃতার মূল কথায় অন্য কিছু প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, তারা ক্ষমতায় এলে কারো বিরুদ্ধেই প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না। যারা তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি বিএনপিসহ বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে তাদের সবাইকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। সরকারের প্রতি তার উপস্থাপিত বিভিন্ন দাবি ও প্রস্তাব মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, হিংসা ও শত্রুতা ভুলে এখন দরকার জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়া। এ জন্য দরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। বেগম খালেদা জিয়ার এই বক্তৃতা এবং বিভিন্ন প্রস্তাব দেশের সকল মহলেই আলোচিত হচ্ছে। ব্যাপকভাবে সমর্থিতও হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক।
কারণ, দীর্ঘদিন ধরে তিনি শুধু নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন না, সময়ে সময়ে রাজপথেও আন্দোলন করেছেন। নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের মুখে এখনো তার সে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। জনগণের আশা ও ধারণা ছিল, ক্ষমতাসীনরা তার দাবি মেনে নেবেন এবং সে অনুযায়ী সংবিধানে সংশোধনী এনে জনগণের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। অন্যদিকে সরকার এগিয়েছে নিজেদের ছক অনুযায়ী, যার প্রকাশ ঘটেছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত ভোটার ও প্রার্থীবিহীন একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। স্মরণ করা দরকার, ওই নির্বাচনের প্রাক্কালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, যে কোনো নামেই গঠন করা হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় হতে হবে। সংকট যাতে আরো ঘনীভূত না হতে পারে সে জন্য বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখাও পেশ করেছিলেন। সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপির তথা তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সমঝোতামুখী ও গণতন্ত্রসম্মত অবস্থান নেয়া হলেও ক্ষমতাসীনরা সে একই সংবিধানের দোহাই দিয়েছিলেন, যে সংবিধানকে তারা নিজেদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী এমনভাবে সংশোধন করে রেখেছেন যাতে তারাই আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। একতরফা নির্বাচনের আড়াল নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেনও তারা। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি না পেলেও ক্ষমতাসীনরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত বিরোধী দল যত নমনীয়তা ও সদিচ্ছাই দেখাক না কেন, সরকার সামান্যও ছাড় দেবে না। জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের নীতি-মনোভাব ও কার্যক্রমে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এ প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশনে বেগম খালেদা জিয়া যে প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সমঝোতা ও সংলাপের যে আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের উচিত সেগুলোর ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দেয়া। এ কথা বুঝতে হবে যে, দমন-নির্যাতন চালানো এবং গায়ের জোরে নির্বাচন করা বা ক্ষমতায় থাকা কোনোক্রমেই গণতন্ত্রসম্মত হতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে বরং শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা এবং শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। এভাবে রাজনৈতিক সংকটই শুধু আরো ঘনীভূত হবে না, সারা দেশে সহিংসতাও ছড়িয়ে পড়তে পারে। দেশ পড়তে পারে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের আবর্তে। এ ধরনের পরিস্থিতি অবশ্যই আশঙ্কাজনক এবং জনগণের আকাক্সক্ষার পরিপন্থী। এ জন্যই সরকারের উচিত রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়া, যে বিষয়ে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।
ষ লেখক : যুগ্ম মহাসচিব কেন্দ্রীয় কমিটি ও সভাপতি, ঢাকা মহানগর, এলডিপি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন