মুহাম্মদ বশির উল্লাহ
মহান ইসলামের বুনিয়াদ যেসব কর্ম ও চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত তার মধ্যে অন্যতম পবিত্রতা। ইসলাম দেশের জন্য যে সমাজ ব্যবস্থা চালু করতে চায়, তা এমন এক পূতঃপবিত্র- নিপুন সমাজ ব্যবস্থা যার শিরে সতীত্ব ও পবিত্রতার তাজ থাকবে। যার কর্ম ও চিন্তাধারার কোন পর্যায়েও অসৎ চরিত্র ও নিলর্জ্জতার লেশমাত্র নেই। এ উদ্দেশ্যের জন্যই ইসলাম তার আইনগত ও নৈতিক শিক্ষায় অত্যন্ত তাগিদ রয়েছে। সেসব গোপন দরজায় পাহারাদার বসানো হয়েছে, যেখান থেকে সমাজে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান ফরমান হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি আমাকে তার দুই সওয়ালের মধ্যেবর্তী জিনিস (জিহ্বা) এবং দুই উরুর মধ্যেবর্তী জিনিসের (লজ্জাস্থান) হেফাজতের নিশ্চয়তা দিবে। আমি তার জন্য, জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।’
এই হেকমতপূর্ণ বাণী মানব সমাজে অবশ্যই আন্দোলিত শিরায় হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম। বাস্তবতা হচ্ছে, এই দুনিয়ার যত গুনাহ, মারামারি, কাটাকাটি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জেল-জুলুম, খুন-খারাবি, নারী-নির্যাতন, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, ইভটিজিং এক কথায় যত অপরাধ সংঘটিত হয় তার প্রধান কারণ এ দু’টিই। যেমন, জিহ্বার অসংলগ্নতা- যাতে খারাপ ভাষা, যেমন সম্পৃক্ত, তেমনি পেটের চাহিদা পূরণ করার জন্য কৃত অপরাধ কিংবা কুপ্রবৃক্তি। মানুষ যদি নামাজ-রোজা ইত্যাদি ব্যক্তিগত আমলে ত্রুটি করে তবে তার কুফল ও পরিণতি সে ব্যক্তি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের অসংলগ্নতার কারণে সমাজের সর্বত্র এর কুপ্রভাব বিস্তার লাভ করে থাকে। এমনকি অবশেষে তা পুরো সমাজকে ধ্বংসের অতলে ডুবিয়ে ছাড়ে। সুতরাং ইসলাম উপযুক্ত দুটি বিষয়ে অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল একটি ধর্ম। ইসলাম এ দুটি অসংলগ্নতা দূর করার জন্য মহান শিক্ষা ও পূর্ণাঙ্গ আহকাম দান করেছে। জৈবিক চাহিদা হচ্ছে মানুষের সহজাত, যার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় কাক্সিক্ষত। পবিত্রতার সঙ্গে তার প্রয়োগ করতে পারলে তা জীবনে প্রশান্তি আনয়নে সাহায্য করবে। এটা সৃষ্টির ধারা টিকিয়ে রাখার উপায়। এর মাধ্যমে সম্পর্ক ও ভালোবাসা মজবুত বন্ধনে স্থাপিত হয়। কিন্তু এ চাহিদা যদি সীমালঙ্ঘন করে আর পশুত্বসূলভ পথ অবলম্বণ করে তাহলে পুরো জীবন ধারাকে পারস্পারিক সম্পর্ক ও বন্ধন কেবলই কৃত্রিমতার রূপ প্ররিগ্রহ করে। অবৈধ তথা জারজ প্রজন্মের দ্বারা ফেতনার বিস্তার ঘটে। চারিত্রিক ও শারীরিক অসুখের ব্যাপকতা দেখা দেয়। পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষের দহন বাড়তে থাকে। ঐক্যবদ্ধ কর্মপন্থায় ব্যাঘাত ঘটে। মানবতা আশরাফুল মাখলুকাত তথা (সৃষ্টির সেরা) এ স্তর থেকে বিচ্যুত হয়ে কুকুর বিড়ালের কাতারে এসে সামিল হয়।
তবে ইসলাম বৈরাগ্যবাদের মতো জৈবিক চাহিদাকে একেবারে বন্ধ করে দেয়নি। বরং একদিকে মানুষের স্বভাবজাত এই চাহিদাকে স্বীকার করে নিয়েছে এবং এর যথার্থ প্রয়োগের লক্ষ্যে বিয়ে-শাদীর মতো পবিত্র একটি ব্যবস্থা করে রেখেছে। এ জন্য অনেক সহজসাধ্য পথ আবিষ্কার করেছে। অপরদিকে ওই সব অসংলগ্ন ও ভারসাম্যহীনতার ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যে সকল কর্মের মাধ্যমে মানুষের চিন্তাধারা বিকৃত হতে পারে, যার দ্বারা তাদের কুপ্রবৃত্তি লাগামহীন হতে পারে। যার কারণে, জৈবিক উন্মাদনা বাড়তে পারে এবং যা সমাজের মধ্যে কোন না কোনোভাবে নগ্নতা ও অশ্লীলতা ছড়ানোর জন্য দায়ী। ইসলাম এসব কিছুর পথ গোড়াতেই বন্ধ করে দিয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ থেকে আখলাকি হেদায়েত দীর্ঘ ধারা বর্ণিত হয়েছে। যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘‘হে নবী! আপনি মুসলমানদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতার মাধ্যম। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন যা কতিপয় লোক করে থাকে’’(সূরা নূর : ৩০) অপর দিকে নারীদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ‘‘আর তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান কর আর পূর্বের জাহেলি যুগের ন্যায় নিজেদের সাজিয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করবে না’’ (সূরা আহযাব : ৩৩) সমগ্র সমাজ কাঠামোতে মানুষের কামনা-বাসনা, পূতঃপবিত্র রাখার জন্য প্রচার মাধ্যমকে সর্তক করা হয়েছে। এ জাতীয় অসংখ্য নির্দেশনা দ্বারা মানুষের কান, চোখ অন্তর এবং তার সমস্ত ধ্যান- ধারণার ওপর আল্লাহর ভয় ও পরকাল ভাবনার ব্যাপারটি প্রয়োগ করা হয়েছে। এত কিছুর পরও যদি কোন সুযোগ তালাশের মাধ্যমে অসদুপায় অবলম্বন করে তবে তার জন্য রয়েছে ভয়াভহ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও তরবিয়াতের প্রভাব এমন ছিল যে, ইসলামী কাঠামোর নিস্কলুষ চরিত্র, সতীত্ব ও পবিত্রতার এবং জৈবিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে সমগ্র পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। অথচ পশ্চিমা দুনিয়ার বেহায়াপনা ও চারিত্রিক স্খলনের যে কাহিনী অবগত হই তা খুবই পীড়াদায়ক। কিন্তু বর্তমানে অন্য সকল অসৎ ক্রিয়া-কর্মের সঙ্গে এ বিষয়টিও আমাদের সমাজের প্রকৃতি অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় বদলে যাচ্ছে। পশ্চিমা সমাজের এসব ব্যধি যা তাদের সমাজে সর্বত্র চারিত্রিক স্খলনের শেষ সীমায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ধীরে ধীরে আমাদের নিস্কলুষ চরিত্র, আভিজাত্য দিক থেকে অনন্য ও অনুকরণীয় মনে করা হতো। আজ তাদের মাঝেও বেপর্দা, নির্লজ্জতা এবং অবাধে চলাফেরার প্রবণতা ধ্বংসের সকল উপায়-উপকরণ নিয়ে হাজির, ভয়ানক এ বিপথগামিতা এত বহুমুখী ও ব্যাপক যে, শুধু একটি পদক্ষেপই এর প্রতিকারের জন্য যথেষ্ট নয়।
দেশের প্রায় সকল জনপদেই সিনেমার প্রেক্ষাগৃহ বর্তমান। যেখানে রাত-দিন নিলর্জ্জ ও বেহায়াপনা টাইফের ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। এসব সিনেমায় উলঙ্গপনা, অশ্লীলতা এবং যৌন আবেদনময় বিষয় নিয়মিত প্রদর্শন করা হচ্ছে। কার্যত এসব ভিনদেশি ফিল্মে যেসব উত্তেজনাকর ও যৌন আবেদনময় দৃশ্য দেখানো হয়, তা নতুন প্রজন্মাকে গলাটিপে বধ করার শামিল। যখন শত-সহস্র মানুষ এক সঙ্গে বসে এসব চরিত্র বিধ্বংসী দৃশ্য অবলোকন করে তখন এর ভয়াবহ পরিণতি ও ফলাফল সম্পর্কে তাদের মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা যায় না। তাদের চোখগুলো মানবতা-বিধ্বংসী এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রবৃত্তি পূজার এ মারাত্মক সংক্রামক ব্যধি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে সকলকে আক্রান্ত করে ফেলছে।
সমাজ চরিত্রের অধঃপতনের আরেকটি শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে টেলিভিশন। সিনেমার প্রেক্ষাগৃহ কিংবা নাটক ক্লাবে গিয়ে যা করার কথা ছিল এখন তা ঘরের বেড রুমে বসেই টেলিভিশনের মাধ্যমে করতে পারছে। ফলে ধীরে ধীরে ছোট-বড়’র মধ্যে সমীহবোধের যে বাচ-বিচার ছিল তাও নির্মূল হয়ে যাচ্ছে। পিতা-পুত্র, ভাই-বোন তথা পরিবারের সকলে একত্রে বসে এই কুরুচিপূর্ণ দৃশ্যগুলো শুধু দেখছেন না বরং পারস্পারিক আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ও হয় তাদের মধ্যে। উলঙ্গতা ও অশ্লীলতা ছাড়ানোর ক্ষেত্রে বর্তমানে সংবাদপত্রসমূহ একটি বড় মাধ্যম। বিনোদনের নামে এর পাতাগুলোতে এমন সব ছবি ছাপা হচ্ছে, যেগুলো দেখে শয়তানও লজ্জায় মুখ ঢাকে।
বিজ্ঞাপনি সংস্থাগুলো নারীদের ব্যবসায়ীক পণ্যে পরিণত করছে। বর্তমানে এমন কোন পণ্য নেই যার বিজ্ঞাপনে আমার, আপনার মা-বোনদের উপস্থিতি নেই। বিশেষ করে সিনেমার যেসব বিজ্ঞাপনের যে পোস্টার রাস্তার মোরে মোরে টাঙ্গানো থাকে তা ভয়ানক অশ্লীলতার দিকে সমাজকে হাত ছানি দিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে অর্ধ-উলঙ্গ নয় বরং সম্পূর্ণ নগ্ন ফিল্মের বেচাকেনা বর্তমানে ব্যাপক হয়ে গেছে। ফলে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা সহজেই ধ্বংস হওয়ার পথের যাত্রী হচ্ছে।
এ ধ্বংসাত্মক অবস্থার ব্যাপারে আলোচনা-পর্যালোচনা করে শুধু সিনেমা, টিভি, রেডিও, মিডিয়া এবং সরকারের অমনোযোগিতার ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপনের দ্বারা অবস্থার পরিবর্তন হবে না। অবশ্যই এর জন্য দায়ী কিন্তু আমরাইÑএ কথা ভুলে গেলে চলবে না। আমরা যদি নিজেরা চেষ্টা ও সাধনা দ্বারা এই অশ্লীলতা ও উলঙ্গতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধমূলক মনোভাব সৃষ্টি করতে পারতাম। তাহলে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান সমূহের পক্ষে সম্ভব হতো না, এ ধরনের সমাজবিধ্বংসী কর্মকা- পরিচালনা করা। সমাজের যেসব লোক এ জাতীয় অপকর্ম ছড়ানোর পেশায় নেমেছে তারা জেনে যেত, তাদের এ কর্ম কেবল পরকালের শাস্তিই ডেকে আনবে না! বরং দুনিয়াতেও ব্যাপক জনরোষের কবলে পড়তে হবে। কিন্তু আমাদের অবস্থাতো হচ্ছে, বাস ভাড়া এক টাকা বাড়লে ইট-পাটকেল হাতে রাস্তায় নামছি। বেতন-বার্তা সামান্য কম হলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের তুফান তুলছি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে শ্লোগান দিচ্ছি। অথচ যখন যত্রতত্র নিলর্জ্জতা ও বেলাল্লাপনা প্রচার করা হয়, তখন এর কোন অশুভ প্রভাব আমাদের চোখে পড়ে না। অতএব, বিপথগামিতার এই জোয়ারকে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন