জামালউদ্দিন বারী
ইউরোপ-আমেরিকায় ইসলামোফোবিক বা ইসলামবিদ্বেষীরা একের পর এক নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে পশ্চিমা জনমতকে নিজেদের দখলে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ, ইউরোপের রিফিউজি সংকট এবং প্যারিস থেকে ব্রাসেলস পর্যন্ত একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ইসলামবিদ্বেষীদের হাতে প্রোপাগান্ডার নতুন নতুন অস্ত্র ও রসদ তুলে দিচ্ছে। প্রায় দেড় দশক আগে আমেরিকায় নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার দায় আল-কায়েদার ওপর চাপানোর সূত্র ধরে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের শায়েস্তা করতে যেসব অজুহাত সৃষ্টি করা হয়েছিল তার প্রায় সবই পরবর্তীতে মিথ্যা ও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। ইরাকে ন্যাটো বিমান হামলার আগে সেখানে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের মজুদ থাকার মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছিল। আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব কায়েমের আগেও সেখানে আল-কায়েদার ঘাঁটি থাকার কথা বলা হয়েছিল। একযুগ দখলদারিত্ব কায়েম রাখার পরও আল-কায়েদার কোনো ঘাঁটি বা শীর্ষ নেতার সন্ধান সেখানে পাওয়া যায়নি। তবে আফগানিস্তানে ন্যাটোর সামরিক ঘাঁটিগুলোতে বাইরে থেকে রসদ পাঠাতে আফগান তালেবানদের সঙ্গে পশ্চিমা সামরিক কন্ট্রাক্টরদের গোপন সমঝোতার কথা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন করতেও তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসনের কোনোটিই সামরিক-রাজনৈতিক সাফল্যের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেনি। ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সূচিত তথাকথিত ‘ওয়ার অন টেররিজম’ যখন নতুন অধ্যায়ে পদার্পণ করতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষের নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করা হয়েছে। ডেনিশ পত্রিকায় রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন প্রকাশ থেকে শুরু করে প্যারিসের শার্লি এবদো পত্রিকায় সন্ত্রাসী হামলা, গত বছরের নভেম্বরে প্যারিসের বাতাক্লঁ কনসার্ট হল এবং স্টেডিয়ামে সন্ত্রাসী হামলা এবং সর্বশেষ গত সপ্তায় বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের বিমানবন্দর এবং মেট্রোতে বোমা হামলায় শতাধিক নিরীহ মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনাগুলোর মধ্যে এক ধরনের যোগসূত্র বিদ্যমান। প্রায় প্রতিটি সন্ত্রাসী ঘটনার পরই আলকায়েদা অথবা আইএসের মতো জঙ্গি গ্রুপের দায় স্বীকারের খবর প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। এর অর্থ হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বাহিনী যখন সামরিক-রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই এসব জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামবিদ্বেষীদের হাতে ইসলামোফোবিয়ার আনকোড়া নতুন ইস্যু তুলে দিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসী, আত্মঘাতী হামলায় অসংখ্য মানুষ হতাহত হচ্ছে। বাগদাদ, বৈরুত, কাবুল, আঙ্কারা, লাহোর, করাচির রাস্তা, রেস্তোরাঁ অথবা মসজিদে গ্রেনেড, গাড়িবোমায় ছিন্নভিন্ন লাশের স্তূপে সয়লাব হওয়ার ঘটনাগুলোতে পশ্চিমাদের তেমন বিচলিত-বিগলিত হতে দেখা না গেলেও প্যারিস- ব্রাসেলসের ঘটনায় শতগুণ বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পশ্চিমা সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর আক্রমণে সিরিয়ায়, ইরাকে, আফগানিস্তানে, ইয়েমেনে যখন বছরের পর বছর ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের হতভাগ্য মুসলমানদের প্রতি পশ্চিমা নাগরিক সমাজের মধ্যে এক ধরনের সিমপ্যাথি তৈরি হতে শুরু করে, ঠিক তখনই একটি নতুন আত্মঘাতী হামলার নাটক সাজিয়ে সেই সমবেদনাকে পুনরায় ঘৃণায় রূপান্তরিত করা হয়। প্যারিসের বাতাক্লঁ বোমা হামলার এক সপ্তাহ আগেই বৈরুতে বোমা হামলায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনায় পশ্চিমা বিবেকের কোনো দংশন প্রকাশিত হয়নি। একইভাবে ১৯ মার্চ ব্রাসেলসের বিমানবন্দর ও মেট্রোতে সন্ত্রাসী হামলার এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৭ মার্চ পাকিস্তানের লাহোরের একটি পার্কে দূর নিয়ন্ত্রিত অথবা আত্মঘাতী বোমা হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে ৬৫ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়। এদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। কী ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু পৈশাচিকতা? সবুজ পার্কের দোলনায় ফুলের মতো নিষ্পাপ হাস্যোজ্জ¦ল শিশু ও মায়েদের জীবন নিয়ে রক্তের হোলিখেলা! প্যারিস ও ব্রাসেলসের ঘটনায় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস দায় স্বীকার করলেও লাহোরে বোমা হামলার ঘটনায় গত সোমবার পর্যন্ত কোনো জঙ্গি গ্রুপের দায় শিকারের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে যে কোনো সময় হয়তো আইএস অথবা এলইটির (লস্কর-ই-তৈয়েবা) মতো জঙ্গি সংগঠনের নামে দায় স্বীকারের কথা প্রচারিত হবে। যারা ইসলামের নামে রক্তাক্ত সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় নিয়ে শান্তির ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে বিশ্ববাসীর কাছে ভুল মেসেজ পৌঁছে দিচ্ছে। একটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, এসব সন্ত্রাসী কর্মকা-ের হোতারা মূলত মুসলিমবিরোধী প্রোপাগান্ডা এবং পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী সন্ত্রাস অব্যাহত রাখার একটি কৌশলগত অস্ত্র তুলে দিচ্ছে।
ব্রাসেলসে বোমা হামলার পরপরই আইএস দায় স্বীকার করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ের প্রায় প্রতিটি ন্যক্কারজনক বোমা হামলা ঘটনার পরই এমন দায় স্বীকারের উদাহরণ দেখা যায়। এরপর পশ্চিমা বিশ্বে যথারীতি আরেক দফা মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা, অভিবাসন নীতি কঠোরতর করার আইনি উদ্যোগ এবং সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও ইয়েমেন থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা নারী ও শিশুদের প্রতি চরম অমানবিক আচরণ ও সীমান্ত রুদ্ধ করে দেয়ার অবিমৃষ্যকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এসব কৌশলগত ঘৃণ্য অস্ত্র এখন সম্ভবত অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের একজন অতি সাধারণ মানুষও ইসলামোফোবিয়া ইন্ডাস্ট্রির এসব কারসাজি ও প্রোপাগান্ডার বিষয়গুলো বুঝতে সক্ষম। নাইন-ইলেভেন থেকে শুরু করে বিগত বছরগুলোতে ইউরোপ আমেরিকায় সংঘটিত প্রায় প্রতিটি সন্ত্রাসী হত্যাকা-ের সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা, মিডিয়া এবং নেতারা একযোগে মুসলমান জঙ্গিগোষ্ঠীর ওপর দায় চাপানোর সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের লিগ্যাসিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। তবে প্রতিটি ঘটনার পর ইসলামবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডার বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ত্বাত্তিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণও বিশ্বজনমতে একটি ভিন্নতর মাত্রা যুক্ত করেছে। এবার ব্রাসেলস হামলার পর কিছুটা ভিন্ন বার্তা চোখে পড়ল, আইএসের দায় স্বীকারের পরও বেলজীয় নেতারা তাৎক্ষণিকভাবে মুসলমানদের ওপর দোষারোপের অপরাজনীতির ফাঁদে পা দেননি। তবে সা¤্রাজ্যবাদ যুদ্ধবিরোধী কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন, গত কয়েক বছরে বেলজিয়ামের যুদ্ধবিমানগুলো আইএস বা ইসলামী জঙ্গি দমনের নামে কত শতবার মধ্যপ্রাচ্যের জনপদগুলোতে বোমা হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় কত হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে ইত্যাদি। তবে এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ব্রাসেলস বোমা হামলার ঘটনায় মুসলমানদের ওপর অপবাদ না চাপানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ব্রাসেলসে বোমা হামলার এক সপ্তাহ আগে প্যারিস হামলার প্রধান আসামি হিসেবে পরিচিত আবদেল সালামকে ব্রাসেলস থেকে আটক করা হয়েছিল। আবদেল সালামের আটক হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার সংগঠনের সন্ত্রাসীরা ব্রাসেলস বোমা হামলা সংঘটিত করতে পারে, এমন ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই সম্ভবত ব্রাসেলস বোমা হামলার এই সময়টিকে বেছে নেয়া হয়ে থাকতে পারে।
একদিকে পশ্চিমা পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদ, অন্যদিকে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ইসলামী চেতনা জগৎ, এই দুয়ের মধ্যে একটি দার্শনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিরোধ আছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে একজন স্থুলবুদ্ধির অতি সাধারণ মানুষও বোঝেন, বিমান হামলা করে একটি ধর্মীয় আদর্শ ও জীবন ব্যবস্থাকে নির্মূল করা যায় না। এর ফলাফল হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। গত দেড় দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্বের মুসলমানদের ওপর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে যত আঘাত করা হয়েছে, তাতে সেখানকার মুসলমানরা তত বেশি সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, সেই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের অনুসন্ধিৎসু তরুণ প্রজন্ম ইসলামের প্রতি তত বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে, তাদের অনেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ মুসলমান অভিবাসী ইউরোপ আমেরিকায় বসত গেড়ে মুসলমানদেরকে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্র্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গত এক দশকে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে মুসলমান কমিউনিটি নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার পাশাপাশি কোথাও কোথাও শরিয়া আইন বলবৎ করার দাবিকেও সামনে নিয়ে এসেছে। জায়নিস্ট ও নিওকন রাজনীতিকদের ইসলামোফোবিয়া বা এন্টি-ইসলামিক তৎপরতার মধ্যেও পশ্চিমা শহরগুলোতে বড় বড় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার গড়ে উঠতে দেখা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে অনলাইন ম্যাগাজিন ‘দ্য উইক’-এ প্রকাশিত মাইকেল ডোহার্টির একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘হোয়াই দ্য নেক্সট রিলিজিয়াস রিভাইভাল ইন দি ওয়েস্ট মে বি ইসলামিক’। পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমান ও ইসলাম সম্পর্কে বিদ্যমান কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তার নিবন্ধে বিশ্লেষণ করেছেন মাইকেল ডোহার্টি। সেখানে তিনি একটি তুলনামূলক আলোচনায় বলেছেন,
In Europe, Islam comes across as streetwise and assertive. Mosques are full and thriving, the anchors of growing communities. Churches are wan, empty, scandal-ridden, and irresolute.
‘ইউরোপের অলিতে গলিতে ইসলাম একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মসজিদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে এবং ক্রমবর্ধমান কমিউনিটির মুসল্লিদের পদচারণায় পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে চার্চগুলো ক্রমে নিষ্ক্রিয়, খালি এবং নানা কেলেঙ্কারিতে অস্থির হয়ে পড়ছে।’ খ্রিস্টান যাজকরা অনেক আগেই পশ্চিমা পুঁজিবাদের সঙ্গে আপস করেছিলেন। তাদের নিষ্ক্রিয়তার ওপর ভর করেই গড়ে উঠেছিল ইহুদি জায়নবাদ প্রভাবিত অর্থনৈতিক, সমরতান্ত্রিক সা¤্রাজ্যবাদ।
হাজার বছর ধরে দেশহীন, স্থায়ী আবাসহীন ইহুদিরা নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের জন্য উনবিংশ শতকের শেষদিকে যে জায়নবাদী রাজনৈতিক এজেন্ডা গ্রহণ করেছিল। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তাকে বেশ সফলভাবে কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়। প্রথম মহাযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর নেপথ্যে ইহুদিদের এই গোপন এজেন্ডা মূল ভূমিকা পালন করেছিল। এ কারণেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই বালফোর ডিক্লারেশনের মাধ্যমে ১৯১৭ সালে প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার বাহিনীর ইহুদি হত্যাযজ্ঞকে অনেক বাড়িয়ে প্রচার করে এবং ইউরোপ ও রাশিয়া থেকে পলায়নপর ইহুদি রিফিউজিদের পুনর্বাসনের উত্তম সমাধান হিসেবে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ইঙ্গ-মার্কিন-রাশিয়া সম্মিলিতভাবে সফল করে তোলে। ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগেই ইহুদিরা ফিলিস্তিন, মিসর ও রোম থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইউরোপ ও রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। গত তিন হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইহুদিরা যে সমাজে, যে রাষ্ট্রেই বসতি গেড়েছে, সুদি ব্যবসা গড়ে তুলেছে, সেখানেই বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট ও বৈষম্য তৈরি করেছে। এভাবেই তারা মিসরের ফারাওদের হাতে, রোমান, গ্রিক ও বাইজান্টাইন ও খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের হাতে বিতাড়িত হয়ে একাধিক ইহুদি এক্সোডাসের জন্ম দিয়েছে। গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে শুধুমাত্র আন্দালুসিয়ার (স্পেন) মুসলমান শাসকদের আমলেই ইহুদিরা সব দিকে থেকে নিরাপত্তা ও পরিচর্যার সুযোগ পেয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, ইহুদি সমাজ-সভ্যতার গবেষক মার্ক কোহেন তার গবেষণা গ্রন্থে সে সময়ের ইহুদি-মুসলমান সুসম্পর্ককে ইহুদিদের জন্য গোল্ডেন এজ বা ‘স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগে খ্রিস্টানদের হাতে হত্যা নির্যাতনের শিকার হওয়া ইহুদিরা বিংশ শতকে এসেও জার্মান জাতীয়তাবাদী হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে হত্যা-নির্যাতনের শিকার হলেও ইহুদি পুনর্বাসনের জন্য কঠিন মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে আরব মুসলমানদের। আরবদের জমি দখল করে গড়ে তোলা ইসরাইল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-সামাজিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় শুরু থেকেই ওরা অর্থ ও অস্ত্রশক্তি ও মুসলিম ঐক্যবিরোধী ষড়যন্ত্রকেই নিজেদের টিকে থাকার একমাত্র পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। পুঁজিবাদের চরম বিকাশের শেষপ্রান্তে গিয়ে তা পতনের দিকে ধাবিত হবে, এটাই হচ্ছে অর্থনৈতিক তাত্ত্বিকদের ভবিদ্বাণী। মার্কিন পুঁজিবাদের চরম ঔৎকর্ষের সুরম্য প্রাসাদ যখন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো, তখন কর্পোরেট অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সাড়ে ২৯ ট্রিলিয়ন ডলারের বেইল-আউট বাজেট ঘোষণা করতে হয়েছিল। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মোট জিডিপির দ্বিগুণ। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীরা শত বছরে নানাভাবে সারা বিশ্ব থেকে যে সম্পদ জমা করেছিল তারই একটি বিশাল অংশ বেইল-আউটের মাধ্যমে ইহুদি কর্পোরেট ও ব্যাংকারদের হাতে চলে গেছে। বেইল-আউট বা ভর্তুকির নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা খাতের বিশাল অংশ পুঁজিবাদী অর্থনীতির ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহ্বরে ঢুকে গেছে। এভাবেই পশ্চিমা একচেটিয়া পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদ যখন একটি অনিবার্য পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে, তখন পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় ইসলামকেই ক্যাপিটালিজমের সবচেয়ে পটেনশিয়াল এনিমি হিসেবে দাঁড় করিয়ে ‘ওয়ার অন টেররিজম’-এর ছদ্মাবরণে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে জায়নবাদী মোড়লরা।
ইউরোপের তিরিশটি দেশের অর্ধশত কোটি জনসংখ্যার ১০ ভাগেরও কম জনসংখ্যা নিয়ে মুসলমানরা ইউরোপে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩৫ কোটি নাগরিকের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা এক কোটিরও কম। তথাপি জায়নবাদ ও নিওকন প্রভাবিত প্রোপাগান্ডা ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মাধ্যমে ইউরোপ আমেরিকায় ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ডেমোনাইজ করা হচ্ছে। এসব অপতৎপরতার ঢেউ মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায়ও লাগছে। যেখানে ইউরোপের তিরিশটি দেশের রাষ্ট্রশক্তি মিলেও মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রুখতে পারছে না, সেখানে ইউরোপীয় মুসলমানদের তুলনায় কয়েকগুণ বড় ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা ও নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চাইছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকরা। একেকবার একেক জিগির তুলে সেখানে মুসলিম বিদ্বেষ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদ ছড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে সেখানকার একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতা। ভারতের বর্তমান শাসক দল বিজেপি ক্ষমতায় এসেই ‘ঘর ওয়াপস’ স্লোগান তুলে ভয় ও ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে মুসলমানদের হিন্দু ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে গো রক্ষা আন্দোলনের নামে গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ভারত বিশ্বের প্রধান গরুর গোশত রফতানিকারক দেশ। হিন্দুত্ববাদের নিষ্ঠুরতা ও আগ্রাসী নীতিকে ভারতের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও অখ-তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন সেখানকার উদারপন্থি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সম্প্রতি আসামে এক জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতে মুসলমানদের প্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত মুসলমানদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোরও হুমকি দিয়েছেন। ইউরোপ আমেরিকার মতো ভারতও গণতান্ত্রিক এবং বহু ভাষা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা মাল্টি-কালচারিজমের দেশ। যেখানে পশ্চিমা বিশ্বে শতকরা ৩ ভাগেরও কম সংখ্যক মুসলমান জনগোষ্ঠীকে কখনো বের করে দেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। সেখানে ভারতের ২৫ কোটি মুসলমানকে যত্রতত্র নানা হুমকি ও গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছে। অথচ আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার পেছনে ভারতীয় মুসলমানদের অবদান অনেক বেশি। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরেপক্ষ ভারতে এখন মুসলমানরা অনেক বেশি অনিরাপদ ও হুমকির সম্মুখীন। অথচ এই ভারত প্রায় ১০০০ বছর মুসলমানদের শাসনাধীনে ছিল। মুসলমানরা ক্ষমতাবলে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করেছিলেন কিনা, কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গত বছর ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির একজন পশ্চিমা প-িত শেলডন পোলক বলেছিলেন, ‘মুসলমান শাসকরা জোর করে ধর্মান্তর করালে ভারতে একজনও হিন্দু থাকত না। কারণ মুসলমান শাসকরা ভারতে প্রায় বারোশ বছর রাজত্ব করেছিলেন।’ পাশাপাশি ভারতের লুপ্তপ্রায় সংস্কৃত ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও প্রসারে মুসলমান শাসকদের অবদানের কথা তুলে ধরেন নিজেকে ‘ইহুদি ব্রাহ্মণ’ বলে পরিচয় দিতে আগ্রহী শেলডন পোলক। ভারতের নিজস্ব ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তিনি ভারতীয়দের প্রতি যে মনোভাব পোষণের কথা বলেছেন, সেটি সম্ভবত একবিংশ শতকে ভারতকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেও ভারতীয় সমাজের অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, ‘চাই মুক্ত, বহু স্বরকে সম্মান করার মতো পরিবেশ। সংস্কৃতকে কোনো নির্দিষ্ট বর্ণের মানুষ সংরক্ষণ করেনি, সমাজের সব অংশের মানুষের সেখানে ভূমিকা রয়েছে। কোনো ডিভাইসিভ (বিভাজন সৃষ্টিকারী), এক্সক্লুশনারি (কোনো সম্প্রদায়কে কাউকে বাইরে রেখে), মেজরিটারিয়ান (সংখ্যাগরিষ্ঠের) রাজনীতি তাই সংস্কৃতির অন্তরায়। দরকার সবাইকে নিয়ে মুক্ত আনন্দের সৃষ্টিশীল পরিবেশ। পরাজিতের বিষণœতাবোধ থেকে সংস্কৃত পড়া (চর্চা করা) যায় না।’ শেলডন পোলক বা মার্ক কোহেনের মতো প-িতদের গবেষণাজাত উপলব্ধি এবং কণ্ঠস্বরে জায়নবাদ এবং হিন্দুত্ববাদের অসারতাই ধরা পড়ে। তথাকথিত জঙ্গিবাদের সঙ্গে যেমন বিশ্বের দেড়শ কোটি মুসলমানের মূল শক্তি ও চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে আমরা বিশ্বাস করি, ইসলামোফোবিক ও হিন্দুত্ববাদী উগ্রতার সঙ্গেও পশ্চিমা ও ভারতীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনো সম্পর্ক নেই। গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পতন অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন