গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি অনুযায়ী এবারও বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। জানুয়ারি থেকে ফেব্রæয়ারির ১০ তারিখ পর্যন্ত চার কিস্তির প্রতিটিতেই বাংলাদেশ কম পানি পেয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, চার কিস্তিতে মোট ৫৭ হাজার ৮১৩ কিউসেক পানি কম পেয়েছে বাংলাদেশ। চুক্তির ইন্ডিকেটিভ সিডিউল মোতাবেক বাংলাদেশ এই পরিমাণ পানি কম পেয়েছে। প্রথম কিস্তিতে পানি কম পেয়েছে ১৮ হাজার ৭৩৩ কিউসেক, দ্বিতীয় কিস্তিতে কম পেয়েছে ১৮ হাজার ১১৮ কিউসেক এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তিতে কম পেয়েছে যথাক্রমে ১১ হাজার ৬৭৪ কিউসেক ও ৯ হাজার ২৮৮ কিউসেক। এইভাবে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কম পানি পেলেও ভারত কিন্তু প্রতি কিস্তিতেই ৪০ হাজার কিউসেক পানি বুঝে নিয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি অনুসারে এ পর্যন্ত কখনই বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। প্রতি বছরই বাংলাদেশের তরফে বিষয়টি জানানো হলেও ভারত নানা অজুহাতে পাশ কাটিয়ে গেছে। এবারও জানানোর কোনো আমলে নেয়নি। চুক্তিটি সমতাভিত্তিক নয়, ত্রæটিপূর্ণ ও ভারতীয় স্বার্থের অনুকূলে, এ অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এই সুযোগটিই ভারত বরাবর নিচ্ছে। চুক্তিমতে, ফারাক্কা পয়েন্টে প্রাপ্ত পানি ভাগাভাগির কথা। কিন্তু এই মওসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে তুলনামূলকভাবে কম পানি পাওয়া যায়, যা প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। পানি কম পাওয়া গেলেও চুক্তিতে ভারতকে তার হিস্যা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের হিস্যা প্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা তাতে নেই। ফলে ভারত তার হিস্যাটি ঠিকই নিয়ে নিচ্ছে। আর বাংলাদেশ ইন্ডিকেটিভ সিডিউল থেকে প্রতি কিস্তিতে হাজার হাজার কিউসেক পানি কম পাচ্ছে। ফারাক্কা পয়েন্ট প্রাপ্ত পানি সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বন্টনের ব্যবস্থা চুক্তিতে থাকলে বাংলাদেশ অন্তত এভাবে একতরফা পানি বঞ্চনার শিকার হতো না। ভারত সবসময় এ অজুহাতই দেখায় যে, ফারাক্কা পয়েণ্ট পানি কম থাকার কারণে বাংলাদেশকে সিডিউল অনুযায়ী পানি দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু ফারাক্কা পয়েন্টে পানি কম থাকার কারণটি ভারত উল্লেখ করো। বাংলাদেশও এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করেনা। উজান থেকে ব্যাপকভাবে পানি সরিয়ে নেয়ার ফলে ফারাক্কা পয়েন্ট পর্যাপ্ত পানি আসেনা। গঙ্গার মূল প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে পানি ভাগাভাগির বিষয়টি যদি চুক্তিতে স্থিরিকৃত হতো তাহলে ভারত বেপরোয়াভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারতো না। প্রয়োজনীয় পানি ফারাক্কা পয়েন্ট আসতো এবং বাংলাদেশও পানির ন্যায্য হিস্যা পেতো।
গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি নিয়ে আমাদের ক্ষমতাসীন মহল যতই কৃতিত্ব জাহির করুক না কেন, বাস্তবে ওই চুক্তি বাংলাদেশের অনুকূলে যায়নি। তার স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের পানিবঞ্চনার বিষয়টি বার বার জানানো সত্তে¡ও ভারত এদিকে বিন্দুমাত্র কর্মপাত করছেন। বিষয়টি পর্যালোচনা করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষেও ভারতের সায় নেই। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক দীর্ঘদিন ধরে ভারতের টালবাহানার কারণে হচ্ছে না। আসলে ভারত পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনীতির খেলা খেলছে। দু’দেশের মধ্যে প্রবাহিত সকল নদীতেই ভারত বাঁধ, গ্রোয়েন ইত্যাদি নির্মাণ করে শুকনো মওসুমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এতে বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবে যে পরিমাণ পানি আসার কথা, তা আসছে না। এ কারণে শুধু পদ্মা নয়, বড় ছোট সকল নদীই তীব্র পানিসংকটের শিকার হচ্ছে। এ সময় পদ্মা শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তার মতো নদী একই দশায় পতিত হয়। এদের শাখা-উপশাখা নদীগুলোর অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় আরো শোচনীয়। ইতোমধ্যে দেশের বহু নদী তাদের অস্তিত্ব হারিয়েছে। যারা টিকে থাকে তাদের অবস্থা মরোমরো। পানির অভাবে দেশের আবহাওয়া, আবাদ-উৎপাদন, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। বর্ষা মওসুমে দেখা দেয় ভিন্ন পরিস্থিতি। বন্যায় ফসলহানি এখন প্রতিবছরের সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই বন্যার প্রধান কারণ উজান থেকে নেমে আসা ঢল। প্রতিবছরই যখন উজানে পানি বাড়ে তখন অভিন্ন সব নদীর ওপর দেয়া বাঁধ ভারত একযোগে খুলে দেয়। এতে বাড়িঘর, ফসলাদি পানির তোড়ে ভেসে যায়। এর অনুষদ হিসাবে নদীতে দেখা দেয় ব্যাপক ভাঙন। বন্যা ও ভাঙনে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। গত বর্ষাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভারতের পানি রাজনীতির কবলে পড়ে বাংলাদেশ একদিকে শুকিয়ে মরছে, অন্যদিকে ডুবে মরছে। এ পরিস্থিতির কবে অবসান হবে, আদৌ হবে কিনা, কেউ বলতে পারে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক সর্র্বোচ্চ উচ্চতায় উপনীত হয়েছে বলে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। অথচ বাংলাদেশের জীবন-মরণের সমস্যা পানি সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। সমাধানের কোনো লক্ষণও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। পানি নিয়ে বলতে গেলে কোনো ফলপ্রসূ আলোচনাই হচ্ছে না। গঙ্গা ছাড়া আর কোনো নদীর ব্যাপারে কোনো চুক্তি নেই। চুক্তি থাকলেও গঙ্গার পানির ন্যায্যা হিস্যা বাংলাদেশ পাচ্ছে না। চুক্তিবিহীন নদীগুলোর পানি কতটা পাচ্ছে তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে। চুক্তির দেখা মেলেনি। বিষয়টি এখন তামাদি হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। গত পরশু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তিস্তা ইস্যুর সমাধানে ভারতের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘আমাদের জনগণের কাছে যেতে হবে। তাই তিস্তা ইস্যু সমাধান করুন।’ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সুবিধায় ভারত এই ইস্যুর সমাধানে এগিয়ে আসবে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন। ভারত তার নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কিছু করবে, এমনটি মনে করার বোধহয় কারণ নেই। সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছে। বলেছে, ‘নদী কোনো প্রদেশের নয়।’ পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, এই রায়ের পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি করতে আর কোনো বাধা নেই। দেখা যাক, অত:পর ভারত কি করে। আমাদের পূর্বাপর অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে মোটেই সুখকর নয়। ভারত আন্তর্জাতিক সকল আইন, বিধি ও প্রথা লংঘন করে অভিন্ন নদীর উজান থেকে নির্বিচারে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকার ও দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র আমল দিচ্ছে না। বলা হয়, ‘নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।’ অথচ ভারতের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সেই নদী একে একে নেই হচ্ছে যাচ্ছে। এর অর্থ, বাংলাদেশের অস্তিত্বের হুমকি দিনকে দিন বাড়ছে। এ অবস্থা কোনো মতেই দীর্ঘায়িত হতে দেয়া যায় না। বাংলাদেশকে অবশ্যই পানির ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। অববাহিকাভিত্তিক পানি বন্টনের ব্যাপারে যে সমঝোতা হয়েছে সেটা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
সমঝোতা হলেও এব্যাপারে ভারতের উৎসাহ আছে বলে এখনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। যদি তার মনোভাব নেতিবাচক হয়, তাহলে এই ইস্যু জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থায় নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন