মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

ফ্যাসিবাদী শাসন নয় গণতন্ত্রই কাম্য

প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবদুল গফুর
দেশের সর্বোচ্চ আদালত দুই মন্ত্রীর সাজা দেয়ার পর মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, এ রায়ের মাধ্যমে আমি জাতিকে মেসেজ দিচ্ছি। প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের তাৎপর্য কে কতটুকু বুঝেছিলেন তা বলা না গেলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল সসম্মানে পদত্যাগ করা। এমন কি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলমও বলেছিলেন, যদিও এ বিষয়ে নির্দিষ্ট বিধান নেই তবুও দুই মন্ত্রীর পদে থাকার বিষয়টি নৈতিকতার সঙ্গে জড়িত। এরপরও দুই মন্ত্রীর কেউই পদত্যাগ করেননি।
এদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন দুই মন্ত্রীকে সাজা দেয়ার পর রবিবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দুই মন্ত্রীর বাড়িতে স্বাধীন দেশের মানুষ পতাকা দেখতে চায় না। যদি তাদের গাড়িতে এ পতাকা থাকে তাহলে দেশের মানুষ লজ্জা পাবে। এত কিছুর পরও তারা মন্ত্রিত্ব ত্যাগ না করাতে প্রমাণিত হয়েছে দেশের মানুষ লজ্জাবোধ করলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদ্বয় এতে লজ্জা পাননি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সম্ভবত গত সোমবার দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের বাস্তবতা প্রমাণিত হয়েছে, যার শিরোনাম ছিল ‘মন্ত্রিত্ব ও লজ্জা এক সাথে থাকতে নেই!’
জানা গেছে, মন্ত্রীদ্বয় এখন অপেক্ষায় আছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যদি মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে বলেন, তা হলে পদত্যাগ করবেন, নইলে তারা যেমন আছেন তেমনই থাকবেন। সুতরাং এখন প্রশ্ন উঠছে, প্রধানমন্ত্রী কি তাদের পদত্যাগ করতে চাপ দেবেন? অনেকেই মনে করেন, সে রকম সম্ভাবনা খুবই কম। আসলে নৈতিকতার প্রশ্নই যদি ওঠে, তা হলে বর্তমান সরকারের নৈতিক ভিত্তি নিয়েও তো প্রশ্ন উঠবে অনিবার্যভাবে। ৫ জানুয়ারির যে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে, তিন তিনবার অবাধ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল সে নির্বাচন বয়কট করায় ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচন সম্পর্ক জনগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির নির্বাচন বয়কট করার কারণও ছিল। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। অতীতে সমঝোতা সমঝোতা লঙ্ঘন করে আওয়ামী লীগ তার সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে হয়। সে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে অনৈতিকভাবে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি তাকে অন্যায় ও অনৈতিক বলতে বাধ্য। সেই অনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে বর্তমান সরকারকে কোনোক্রমেই নৈতিকতার মানদ-ে উত্তীর্ণ বলে বিবেচনা করা যায় না।
আর বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকার যেমন ৫ জানুয়ারির এমন এক বিতর্কিত নির্বাচনের ফসল যা দেশ-বিদেশে জনগণ কর্তৃক ভোটারবিহীন নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, তেমনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এ সরকারের অধীনে এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার কোনোটাই সরকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার সামান্যতম চেষ্টা চালায়নি। জাতীয় সংসদ ও পৌর নির্বাচনের পর এখন ইউনিয়ন পরিষদের যে নির্বাচনের পালা শুরু হয়েছে, তাতেও নির্বাচনের নামে চলছে সরকারি দলের জবরদস্তি ও স্বেচ্ছাচারিতার মচ্ছব। এর মাধ্যমে দেশে নির্বাচনের নামে চলছে শাসক দলের দলীয় শাসন সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার এক উগ্র ফ্যাসিবাদী পাঁয়তারা।
এ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মনে পড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থার কথা। যে রাজনৈতিক দলটি সে সময় একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, ঘটনাক্রমে বর্তমানে সেই দলটিই ক্ষমতাসীন রয়েছে, যদিও বাংলাদেশে এর মধ্যে বেশ কিছু দিন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এখনো আমাদের মনে আছে, সেই বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকাকালে একটি নির্বাচিত সরকারকে তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে দেশে সেনা শাসন প্রতিষ্ঠা করলে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সেই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জানান সম্ভবত এই বিবেচনায় যে, উৎখাত হওয়া ওই নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তুলনায় আওয়ামী নেত্রীর কাছে সামরিক শাসন অনেক বেশি কাম্য মনে হয়েছিল।
দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে থাকার কথা, জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ ওই সেনা শাসন চলাকালে দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এরশাদবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যায়। তবে সে সময় আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা যদি রাজনীতিতে নবাগতা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মতো আন্দোলনে আন্তরিক হতেন তা হলে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন অত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারত না। যা হোক এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে যখন নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন এলো, তখন দুই প্রধান রাজনৈতিক দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একমত হয়। সেই অনুসারে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এরশাদ-পরবর্তী প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে নিজ ভোটকেন্দ্রে ভোট দেয়ার পর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে বলেন, আমি সব জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন কেউ যেন নির্বাচনে হেরে গিয়ে আবার এর মধ্যে কারচুপি আবিষ্কার না করে। নির্বাচনের সম্পূর্ণ ফলাফল প্রকাশের পর যখন দেখা গেল আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি, তিনি অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে! এর অর্থ কি? এর অর্থ হলোÑ নির্বাচন যতই সুষ্ঠু হোক শেখ হাসিনার দল নির্বাচনে বিজয়ী না হলে সে নির্বাচনকে কারচুপি হয়েছে বলে ধরে নিতেই হবে!
যাহোক, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন এবং শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী হন। খালেদা সরকারের মেয়াদ শেষে যখন নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন এলো, তখন প্রধানত তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়। এরপর এভাবে দেশে বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পালাক্রমে দুই প্রধান দলই ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ শাসনের সুযোগ লাভ করে। এতে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই দেশে গণতন্ত্র বিকাশের উপযুক্ততম ব্যবস্থা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নেতানেত্রীদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অতিরিক্ত ক্ষুধা একপর্যায়ে এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকে পচিয়ে ফেলে এবং রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের এই নীতিবিচ্যুতির সুযোগ অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করে সেনা সমর্থিত সরকারের নামে সেনা নিয়ন্ত্রিত এক অদ্ভুত সরকার গঠন করে দুই প্রধান নেত্রীকে অন্তরীণ করে দুই দলের তথাকথিত সংস্কারপন্থিদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ভাগ্যিস দুই দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রবল বিরোধিতার ফলে এই ষড়যন্ত্র ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং দেশের চারদিক থেকে ক্ষমতা দখলকারী অসাংবিধানিক শক্তির নিয়ন্ত্রিত সরকারের নেতাদের বিচারের দাবি ওঠে। এ সময়ে অন্যতম অন্তরীণ নেত্রী শেখ হাসিনা আশ্বাস দেন তিনি ক্ষমতায় গেলে অসাংবিধানিক সরকারের নেতাদের সকল কাজের বৈধতা দান করবেন। এই আশ্বাসের পর ওই অসাংবিধানিক সরকারের নেতৃত্বে যে নির্বাচন হয় তাতে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন।
অতঃপর শেখ হাসিনার এই সরকার অতীতে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে যে সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল তা থেকে সরে গিয়ে নিজ দলীয় সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ঘোষণা দিলে তা বিএনপি অতীত সমঝোতা ভঙ্গের অভিযোগে বয়কট করে। আওয়ামী নেত্রীর সম্ভবত আশঙ্কা হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন হলে তাতে অতীতের মতো বিএনপি জয়ী হবে এবং তাঁর একচ্ছত্র শাসনের সুযোগ বাধাগ্রস্ত হবে। কিন্তু নিরপেক্ষ নির্বাচনে একবার পরাস্ত হলেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় থাকলে পরবর্তীকালে যে তিনি বিজয়ী হবেন না এমন আশঙ্কা তো নিতান্তই অমূলক। তা ছাড়া দেশে গণতন্ত্র বজায় রাখতে হলে জনগণের অবাধ রায়ের মাধ্যমে পরাজয়বরণের মানসিক প্রস্তুতিও যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি মর্যাদাদানের অপরিহার্য অঙ্গ, এ কথা ভুলে যাওয়াও দুঃখজনক। এরশাদ-পরবর্তী প্রথম সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন তার নিজের বিবেচনায় সুষ্ঠু হওয়ার পরও তাতে আওয়ামী লীগের হেরে যাওয়ায় তিনি যে তার মধ্যে সূক্ষ্ম কারচুপি আবিষ্কার করেছিলেন, সেটাই যদি তার মনের কথা হয়, তা হলে তাকে কিছুতেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেত্রী বলা যাবে না।
দুঃখের বিষয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার মধ্যে ইদানীং হামলা-মামলার মাধ্যমে প্রধান বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয় রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েমের একটা অশুভ প্রবণতা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। এতে করে দেশে আর যাই হোক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। যেহেতু মানুষ যত বড় মানেরই হোক সাধারণত নিজের ত্রুটি সে নিজে বুঝতে পারে না। নেতানেত্রীরাও তার ব্যতিক্রম নয়। এ কারণেই অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধারা বলবৎ থাকলে তার ফলে দেশের জনগণের অবাধ রায় প্রকাশের মাধ্যমে যে কোনো সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতা প্রমাণের একটা নিশ্চিত ব্যবস্থা থাকে, তেমনি তাতে করে দেশে গণতন্ত্র বিকাশের ব্যবস্থাও নিশ্চিত হয়। আর গণতন্ত্র ছাড়া যেমন বৃহত্তর জনগণের মধ্যে যেমন শান্তি আসতে পারে না, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজের নেতানেত্রীদের মধ্যে স্বস্তিবোধ স্থায়ী হতে পারে না। তাই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছাড়া জনগণের শান্তি ও দেশের উন্নতির কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন