হযরত শাহজালাল (রহ)-এর পূণ্যভূমি সিলেটের জৈন্তাপুরে ওয়াজ মাহফিলে বিতর্কিত বক্তব্য দেয়াকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত, অনেকে আহত এবং ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার যে ঘটনা ঘটেছে তা একই সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত, দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। দেশের প্রধান আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত সিলেটের মাটিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, তা কল্পনাতীত। এর চেয়ে অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এ কারণে যে, এর জেরে সিলেটে ও দেশের অন্যান্য স্থানে উত্তেজনা ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এ ঘটনার পরপরই হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে আহলে সুন্নাতওয়াল জামাতের স্থানীয় এক নেতা ও মুরব্বী দুর্বৃত্তদের হাতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন। জৈন্তাপুরের ঘটনার সঙ্গে এই হত্যাকান্ডর কোনো সম্পর্ক আছে কি না, জানা না গেলেও একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির এই কাপুরুষোচিত হত্যাকান্ড ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে ঘটে থাকতে পারে, এমন অনুমান একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উভয় ঘটনায় দেশের আলেম সমাজের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য নতুন নয়। আমাদের দেশেও বিভিন্ন মতের আলেম আছেন। কিন্তু কখনোই মতপার্থক্যের কারণে তাদের সমর্থকদের সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। এই পরমতসহিষ্ণুতা আমাদের ঐতিহ্য। সাধারণত নানা ধারার ওয়াজ মাহফিলে অভিন্ন মতের আলেমরাই ওয়াজ করেন। ভিন্ন মতের আলেমদের সেখানে দাওয়াত করা হয় না। জৈন্তাপুরে অনুষ্ঠিত ওয়াজ মাহফিলে এর ব্যতিক্রম ঘটানো হয়। ওই ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে যে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে, তা বস্তুত এ কারণেই। অত:পর ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকদের উচিৎ হবে, অভিন্ন মতের আলেমদেরই ওয়াজ মাহফিলে আমন্ত্রণ জানানো। এতে অহেতুক বিতর্ক, উত্তেজনা ও অকাম্য ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।
একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে সুফী-দরবেশও পীর-আওলিয়াদের মাধ্যমে। তাদের মাধ্যমেই এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোনো বিপ্লব ও যুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশে ইসলাম আসেনি ও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধু বাংলাদেশ কেন, গোটা উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা ঘটেছে সুফী-দরবেশ ও পীর-আওলিয়াদের দ্বারা। মুসলিম বিজেতারা এসেছেন পরে এবং তাদের মাধ্যমে রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিশ্বের যেখানেই মুসলমানদের সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানেই ইসলামের ভিত্তি ও সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছেন সর্বস্ব ত্যাগী, আল্লাহ-রসুলের পথে জীবন উৎসর্গকারী সুফী-দরবেশ ও পীর-আওলিয়াগণ। বাংলাদেশের ইসলাম সুফী-দরবেশ ও পীর-আওলিয়াদের ইসলাম। এ ইসলাম সহিষ্ণু, উদারও পারস্পারিক সহবস্থানের আদর্শে ¯স্রোত। এখানে উগ্রবাদের কোনো জায়গা নেই, জোর জবরদস্তির কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এর পেছনে রয়েছে ইসলামের শিক্ষা ও মহানুভবতা। সুফী-দরবেশ ও পীর-আওলিয়াদের প্রতি ঐতিহাসিক কারণেই এদেশের মানুষের রয়েছে বিশেষ আবেগ, শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভক্তি। তাদের প্রতি অসৌজন্যমূলক কোনো বক্তব্য, তাদের খানকা ও মাজারের প্রতি কোনো অবজ্ঞা ও অসম্মান এ দেশের মানুষ কখনোই বরদাশত করেনি, এখনো করবে না। কারণ, সুফী-দরবেশ ও পীর-আওলিয়াদের আদর্শ ও শিক্ষাই তাদের যুগ যুগ ধরে সঠিক পথের দিশা দিয়েছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু ভিন্নমতবাদীর আবির্ভাব ঘটেছে, যারা সুফী-দরবেশ ও পীর-আওলিয়াদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে না। তাদের ও তাদের মাজার-খানকার বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই কটূকাটব্য করে। এই ভিন্নমতবাদীরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী সমাজের মধ্যে বিভেদ-বিসংবাদ ছড়িয়ে দিতে তৎপর রয়েছে। এদের মধ্যে সউদী আরবের ওয়াহাবিজম বা সালাফিজমের অনুসারীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো ডলারের দৌলতে এরা দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে, সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে সালাফিজমের প্রচার-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরা সমাজকে বিভ্রান্ত করছে, বিভক্ত করছে। দেশে উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ সৃষ্টির পেছনে এদের হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়। সালাফিস্টরা মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বেই উগ্রবাদ বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে। এরা যেখানে গেছে সেখানেই বিরোধ-সংঘাত ঘটিয়েছে এবং ঘটিয়ে যাচ্ছে। এদের সম্পর্কে সতর্ক ও সাবধান হওয়ার এখনই সময়। এরা কোথায় কী করছে, কোথা থেকে অর্থ ও মদদ পাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। আরব দেশীয় ক‚টনীতিকদের বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়, সহিষ্ণুতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পাশাপাশি শান্তি শৃংখলার সপক্ষে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও সরকারকেও সচেতন হতে হবে, নজরদারি বাড়াতে হবে। আমরা আমাদের সমাজকে কখনোই বিভক্ত হতে দিতে পারি না, সমাজের মধ্যে বিতর্ক ও সংঘাত সৃষ্টি করতে দিতে পারি না।
আগেই বলা হয়েছে, ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। বলা বাহুল্য, এটা জীবন্ত ও চলিষ্ণু সমাজেরই প্রমাণ। এই মতভেদ ও মতপার্থক্য নিয়েই এ দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে যে যার মতো ধর্ম-কর্ম করে আসছে, সুখ-শান্তিতে বসবাস করে আসছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের মারধোর, কিংবা হত্যা করার ঘটনা কখনোই ঘটেনি। এই পরমতসহিষ্ণু ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে, তাকে আরো সংহত করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মতপার্থক্য, বিবাদ-বিসংবাদ ও যুদ্ধে মুসলমানরাই একমাত্র শিকার। একথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। মুসলমানরা যখন বিভক্ত হয়ে পড়ে, নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হয় তখন ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রæরা খুশী হয় এবং ওই বিভক্তি ও সংঘাত বাড়াতে ইন্ধন জোগায়। সাম্প্রতিককালের বহু ঘটনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের সমাজের ঐক্য-অখন্ডতা রক্ষায় আমরা ব্যর্থ হলে ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরাই লাভবান হবে। তারা এর সুযোগ নিয়ে আমাদের ক্ষতি করবে। ঐক্যই শক্তি, বিভেদে বিপর্যয়। আশংকিত বিপর্যয় থেকে আমাদের সমাজ ও নিজেদের সুরক্ষা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন