জীবে দয়া একটি মহৎ গুণ। জীবে দয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে গ্রন্থে এবং বিভিন্ন মনীষীর উক্তিতে বহু বাণী উচ্চারিত হয়েছে। যেমন ভারতের বীর সন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ স্বীয় রচিত ‘সখার প্রতি’ কবিতার অন্তিম দুটি চরণে বলেন-“বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?/জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” অর্থাৎ তিনি বলতে চাচ্ছেন-তুমি কোথায় ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াচ্ছ, তোমার আশে পাশে অনেক জীব আছে তাদের সেবা করলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। তিনি আরো বলেন-“যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেশের একটি কুকুরও ক্ষুধার্ত, আমার সমগ্র ধর্মকে একে খাওয়াতে হবে এবং এর সেবা করতে হবে, তা না করে অন্য যাই করা হোক না কেন তার সবই অধার্মিক।”
প্রাণীর অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে ৪ অক্টোবরকে বিশ্ব প্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর প্রাণীরি অধিকার রক্ষা ও কল্যাণার্থে বিশ্বব্যাপী বিশ্ব প্রাণী দিবস পালন করা হয়। দিবসটি অবশ্যই প্রাণীর অধিকার রক্ষায় একটি মাইলফলক। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মহানবী (স.) প্রাণীর অধিকার রক্ষায় এমন সব বাণী উপহার দিয়ে গেছেন যা কল্পণাও করা যায় না। এ বিষয়ে হাদীছে অগণিত মূল্যবান বাণী পরিলক্ষিত হয়। ইসলামী সংস্কৃতির চিত্তহারী দিকসমূহের অন্যতম হল জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন। মানবজগতের ন্যায় প্রাণীজগতও সদয় আচরণ পাওয়ার যোগ্য এ ব্যাপারে ইসলামে যে বাণী উচ্চারিত হয়েছে এবং নবী (স.) এর আচরণে যা ফুটে উঠেছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার এবং বিশ্ব মানবতাকে নাড়াদানকারী। নবী (স.) বর্ণিত এ বিষয় সংক্রান্ত কতিপয় বাণী এবং তদ্বিষয়ে কিছু আলোচনা নিম্নে তুলে ধরা হল।
মানুষ শুধু মানুষের জন্যই নয় বরং মানুষ সমগ্র জীবের জন্য, ইসলাম এই সুমহান বাণীর প্রবক্তা। এক হাদীছে নবী (স.) বলেন -“যে ব্যক্তি একটি বৃক্ষ রোপন করল অথবা কোন ফসল উৎপাদন করল, আর উক্ত বৃক্ষের ফল বা ফসল কোন মানুষ বা কোন চতুষ্পদ জন্তু বা কোন হিংস্র জন্তু বা কোন পাখি ভক্ষণ করল তাহলে সে ব্যক্তির জন্য উহা সাদকাহ হিসেবে পরিগণিত হবে”। (সাহীহ আবি ‘আওয়ানা, হাদীছ নম্বর-৩৩২, মুসনাদু আহমাদ, হাদীছ নম্বর-১৫২৩৫ ও কানযুল ‘উম্মাল, হাদীছ নম্বর-৯০৭৭)। এ হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, কারো রোপন কৃত বৃক্ষ হতে কোন ফল বা উৎপাদিত ফসল হতে কোন ফসল যদি কুকুর, শৃগাল, বিড়াল বা এ জাতীয় কোন পশু বা কীট পতঙ্গ খায় তাহলে সে জন্যও সে সাওয়াব পাবে। কাজেই মানুষের উচিৎ রাস্তার মোড়ে মোড়ে এ নিয়তে ফলদার গাছ লাগানো।
যে কোন জীবের সেবা মহৎ কাজ বলে ইসলামে স্বীকৃত। হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন- “একদা একটি কুকুর প্রচন্ড গরমের দিনে একটি কুয়ার পাড়ে পিপাসায় কাতর হয়ে জিহবা বের করে হাঁপাচ্ছিল এবং কুয়ার চারদিকে ঘুরছিল। এ অবস্থা দেখে বানী ইসরাইলের একজন স্ব-ঘোষিত বেশ্যা মহিলা নিজের ওড়না দ্বারা মোজা বেঁধে কুয়াতে নামিয়ে পানি উত্তোলন করে কুকুরটিকে পান করাল। এর ফলে তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হল।” অপর এক বর্ণনায় হাদীছের শেষাংষে আছে- সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন-হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলোকে পানি পান করালেও কি সাওয়াব পাব? নবী (স.) উত্তরে বলেন - প্রতিটি জীবকে পানি পান করালেই সাওয়াব পাওয়া যাবে”। (সাহীহুল বুখারি, হাদিছ নম্বর-২৫৫২, ৩৩২১, ও সাহীহ মুসলিম, হাদিছ নম্বর-৫৯৯৭, ৫৯৯৮)। আমরা কুকুরকে নিকৃষ্ট প্রাণী বলে মনে করি এবং বেশ্যা মহিলাকে নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে জ্ঞান করি, কিন্তু উক্ত হাদীছের আলোকে বুঝা যায় যে, তাদের সেবা করলেও সাওয়াব পাওয়া যাবে।
জীবকে কষ্ট দেয়া অমানবিক ও গর্হিত কাজ। নবী (স.) বলেন-“একজন স্ত্রীলোক একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল। অতঃপর অনাহারে বিড়ালটি মারা যায়। এ অপরাধে স্ত্রীলোকটিকে শাস্তি দেয়া হয় এবং জাহান্নামী বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সে উহাকে বেধে রেখেছিল, অথচ তাকে আহারও করায়নি, পানও করায়নি। অপরপক্ষে তাকে ছেড়ে দেয়নি, যাতে সে জমিনের লতা-পাতা খেয়ে বাঁচত”। (সাহীহ মুসলিম, হাদীছ নং-৫৯৮৯)।
নবী (স.) এর যুগে ভ্রমণের জন্য একমাত্র যানবাহন ছিল জন্তু। জন্তুকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কষ্ট দেয়াও অমানবিক। তাই নবী (স.) কোন জন্তুর উপর আরোহন করতঃ কারো সাথে কথা বলে বা অন্য কোন প্রয়োজনে সময় নষ্ট করে জন্তুকে কষ্ট না দিতে ফরমান জারি করেন। তিনি (স.) বলেন-“তোমরা সুস্থ অবস্থায় এ সমস্ত পশুদের উপর আরোহন কর এবং সুস্থ অবস্থায় এদেরকে ছেড়ে দাও। আর তোমরা সেগুলোকে চেয়ারে পরিণত কর না”। (মুসনাদু আহমাদ, হাদীছ নম্বর-১৫৬৭৯ ও মুস্তাদরাক আল হাকিম, হাদীছ নম্বর-১৬২৫)। পশুদেরকে অভুক্ত রাখা এবং তাদেরকে দূর্বল ও কৃশকায় করে তোলাও সমীচীন নয়। এ ব্যাপারে সাহল ইবনুল হানযালিয়্যাহ আল আনসারী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীছ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন- “একদা রাসূলুল্লাহ (স.) একটি উটের নিকট দিয়ে গমন করছিলেন। তিনি দেখলেন - ক্ষুধায় উটটির পেট পিঠের সাথে লেগে গেছে। এ অবস্থা দেখে তিনি (স.) বললেন-এসব নির্বাক পশুদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। এরা কথা বলতে পারে না এবং প্রয়োজন ব্যক্ত করতে পারে না, এরা যখন আরোহী বহনের যোগ্যতা রাখে তখন তাদের পিঠে আরোহন কর এবং সুস্থ অবস্থায় তাদেরকে ছেড়ে দাও”। (সুনানু আবী দাউদ, হাদিছ নম্বর - ২৫৪৮, ২৫৪৯ ও ২৫৫০)।
কোন জন্তুর দ্বারা তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ নেয়া বৈধ নয়। ‘আবদুল্লাহ ইবন জা‘ফার বর্ণিত হাদীছে আছে- “একদা রাসুলুল্লাহ (স.) এক আনসারীর বাগানে গমন করেন। সেখানে তিনি (স.) একটি উট দেখতে পান। উটটি রাসুলুল্লাহ (স.)কে দেখে চেঁচিয়ে উঠল। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। নবী (স.) উটটির কাছে গিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললেন। ফলে সে শান্ত হল। অতঃপর নবী (স.) জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কার উট? মালিক এসে বললেন- আমি এর মালিক হে আল্লাহর রাসূল! রাসূল (স.) বললেন -এ পশুর ব্যাপারে তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না? আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন এ পশুকে তোমার মালিকানায় দিয়েছেন। সে আমার নিকট অভিযোগ দায়ের করেছে যে, তুমি তার কাছ থেকে কাজ নাও ঠিকই কিন্তু তাকে ঠিকমত আহার করাও না”। (সুনানু আবী দাউদ, হাদীছ নম্বর-২৫৫১, সুনানুল বায়হাকী আল কুবরা, হাদীছ নম্বর-১৫৫৯২)। অনুরূপ একটি হাদীছ বর্ণনা করে সাহল ইবনুল হানযালিয়্যাহ আল আনসারী (রা.) বলেন- “রাসূলুল্লাহ (স.) কোন এক প্রয়োজনে বের হলেন। দিনের প্রথম ভাগে মসজিদের দরজার সামনে বাঁধা একটি উটের সামনে দিয়ে অতিক্রম করলেন। দিনের অপর ভাগে সেই স্থান দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখলেন যে, উটটি একই অবস্থায় বাঁধা আছে। অতঃপর তিনি (স.) বললেন-এই উটের মালিক কোথায়? তাকে খুঁজা হল, কিন্তু পাওয়া গেল না। অতঃপর রাসূল (স.) বললেন-এই সমস্ত জন্তুর ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর সুস্থ্য অবস্থায় এদের পৃষ্ঠে আরোহন কর”। (মুসনাদু আহমাদ, হাদীছ নম্বর-১৭৬২৫)। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন