কামরুল হাসান দর্পণ
মানব দেহের ৭০ শতাংশ পানি। এটা জীববিজ্ঞানীদের কথা। তারা প্রমাণও করেছেন। এতে দ্বিধা-সংশয়ের অবকাশ নেই। কোনো সুস্থ ব্যক্তির শরীরে এই পরিমাণ পানিতে যদি কোনো কারণে টান ধরে, তবে সে সুস্থ থাকতে পারবে না। নিস্তেজ হয়ে পড়বে। মানুষের শরীরের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল রয়েছে। মানব দেহের অসংখ্য শিরা-উপশিরার মাধ্যমে যেমন রক্ত প্রবাহিত হয়, তেমনি অসংখ্য নদী-উপনদী ও শাখা নদী দ্বারা প্রবাহিত পানি বাংলাদেশকে সজীব-সতেজ রাখে। বাংলাদেশকে যে সুজলা-সুফলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তার প্রধান কারণ জালের মতো বিস্তৃত শত শত নদ-নদী। এসব নদীপ্রবাহিত মিষ্টি পানিই পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে মানুষের জীবনধারণের মূল উৎস। পৃথিবীতে এমন দেশ খুব কমই আছে, যে দেশে নদ-নদী এভাবে বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশের সব নদ-নদীই প্রকৃতিক। কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি করা হয়নি। প্রকৃতিই বাংলাদেশকে এই অপার-অসীম করুণা করেছে। পৃথিবীর বহু দেশ আছে, যেখানে কৃত্রিম উপায়ে খাল, নদী সৃষ্টি করা হয়েছে। নদী বা খাল কেটে সাগর থেকে পানি এনেছে। আমরা যদি মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে সেখানে মরুভূমিতে ফসল ফলানোর জন্য সমুদ্র থেকে পানি আনতে খাল খনন করা হয়েছে। আমরা সৌভাগ্যবান যে পানির জন্য এ ধরনের কঠোর শ্রম ও ব্যয়বহুল কাজ করতে হয়নি। নদ-নদীগুলো অফুরন্ত পানির আধার হয়ে আছে। কখনো কখনো নদী উপচে আমাদের ভেসে যেতেও হয়। তখন মনে হয়, পানি আমাদের জন্য আশীর্বাদ নয় অভিশাপ। এখন সময় বদলে গেছে। আমাদের নদ-নদীগুলো আর আগের মতো স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হয় না। প্রয়োজনীয় পানিও ধারণ করে না। পানি না থাকায় বহু নদ-নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চর পড়ে মরা গাঙ্গে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন হলো?
দুই.
জালের মতো বিস্তৃত নদ-নদী যেমন আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের, অন্যদিক দিয়ে দুর্ভাগ্যেরও। দুর্ভাগ্য এ জন্য যে, আমাদের প্রধান চারটি নদ-নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ ৫৪টিই প্রতিবেশী ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এদের পানির উৎস ভারতে। এটাই আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে উঠেছে। সব নদ-নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি ভারতের হাতে। সে ইচ্ছামতো তার অংশে বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ ও আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। তার প্রয়োজনে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে আবার বন্যার আশঙ্কা দেখা দিলে পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ভারতের এই আচরণ একেবারেই অমানবিক এবং আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারত মানবিকতা ও আইন-কোনোটারই ধার ধারছে না। আন্তর্জাতিক নিয়মে অভিন্ন নদ-নদীর পানি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমানুপাতিক হারে পাওয়ার বিধান থাকলেও ভারত তার তোয়াক্কা করে না। বরং দিন দিন কঠোর হয়ে অধিক পরিমাণে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। আমরা মরছি না বাঁচছি, এটা বিবেচনা করছে না। বছরের পর বছর ধরে সে এ কাজ করে চলেছে। এর ফলে বাংলাদেশের সবকটি নদ-নদী মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। যে প্রমত্তা পদ্মা নদীর ভয়াবহতা নিয়ে অসংখ্য কাব্য, সঙ্গীত, উপন্যাস রচিত হয়েছে; শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম উৎস হয়ে আছে, সেই পদ্মা এখন নিস্তেজ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আমরা শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতে কেবল প্রমত্তা পদ্মার কথাই শুনেছি, বাস্তবেও দেখেছি। অনেকে গল্প-উপন্যাস ও গান লিখে-গেয়ে বিখ্যাতও হয়েছেন। দুঃখের বিষয়, পদ্মার এই দুঃসময় নিয়ে কাউকে সাহিত্য ও সঙ্গীত রচনা করতে দেখছি না। তাহলে কি পদ্মার প্রয়োজনীয়তা শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে ফুরিয়ে গেছে? তাদের কি উচিত নয়, পদ্মার এই দুরবস্থা নিয়ে কাজ করা? পদ্মার এখন কী অবস্থা, তা সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মধ্যে গত ৭ ও ৮ মার্চ পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ৭.৬৪ মিটার। পদ্মার পানি এত নিচে কখনো নামেনি। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, ১৯৭২ সালের পর পানির উচ্চতা এত নিচে নামেনি। এর ফলে রাজশাহীর গোদাগাড়ি থেকে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর মুখ পর্যন্ত পদ্মার দীর্ঘ এলাকার অধিকাংশই শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। যে পদ্মার পানি প্রবাহের মধ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১৫টি পিলারই ডুবে থাকত, সেই ব্রিজের ১২টিই এখন শুকনো চরে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মার এই করুণ দশার কারণে এর সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৮৫টি শাখা নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ফারাক্কার উজানে অর্থাৎ ভারতের অংশে পদ্মার পানি থৈ থৈ করছে। বলাবাহুল্য, ফারাক্কা বাঁধের কারণেই বাংলাদেশের এই করুণ দশা। ভারত ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর ব্যারাজ এবং উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় ৪০০ পয়েন্ট দিয়ে পদ্মার পানি সরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে যে তিস্তাকে কেন্দ্র করে দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প গড়ে উঠেছে, সেই তিস্তার ওপর দিয়ে এখন মানুষ হেঁটে চলাচল করতে পারে। এর ফলে তিস্তা সেচ প্রকল্প টিকে থাকবে কিনা, এ নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ নদীতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি প্রবাহও কমে গেছে। এর ফলে যমুনা নদীও তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নদ-নদীর এসব করুণ কথা প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় লেখা হচ্ছে। লিখতে লিখতে ছাপাখানার অনেক কালিও খরচ হচ্ছে। নদী বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগেরও কমতি নেই। তারা বিভিন্ন পরামর্শও দিচ্ছেন। তাতে যে নদ-নদীতে এক ফোঁটা পানিও যুক্ত হচ্ছে না, তা আমরা স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি। এর কারণ এসব প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ, পরামর্শ যার শোনার কথা, সেই সরকারের মধ্যেই কোনো বিচলন নেই। উল্টো আমরা দেখি, সরকার ভারতের প্রশংসা করতে করতে এমনভাবে বিগলিত হয়ে পড়ে যে পানির ন্যায্য হিস্যার কথা বলতে যেন যারপরনাই লজ্জাবোধ করে। মানুষ শুকিয়ে মরার পথে থাকলেও সরকার এক ফোঁটা পানির কথা ভারতের কাছে বলতে পারছে না। ভারতের সঙ্গে আমাদের সরকারের এমনই মধুর সম্পর্ক! খুব বেশি কিছু নয়, ভারতের সঙ্গে সরকারের অতি মধুর সম্পর্কের কারণে অন্তত তিস্তা চুক্তিটি করতে সক্ষম হবে বলে দেশের মানুষ খুবই আশা করেছিল। সম্প্রতি সরকারের প্রভাবশালী এক উপদেষ্টা অবশ্য স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে এখন আমাদের (সরকারের) কিছুই করার নেই। বল এখন ভারতের কোর্টে। অর্থাৎ ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর তিস্তা চুক্তিটি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। যেখানে ভারতের কাছ থেকে চেয়ে কিছু পাওয়া যায় না, সেখানে ভারত তার ইচ্ছায় তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করবে, এমন আশা স্বপ্নেও যে পূরণ হবে না, তা দেশের মানুষ জানে। এই ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে সরকারের লোকজনকে প্রায়ই বিএনপিকে দোষারোপ করতে দেখা যায়। তারা বিএনপি জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে খোটা দিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া ভারত সফর করে এসে সংবাদ সম্মেলনে নাকি বলেছিলেন, তিস্তা চুক্তির বিষয়টি ভারতের কাছে উত্থাপন করতে ভুলে গিয়েছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার এ ভুলে যাওয়া নিশ্চিতভাবেই একটা বড় ভুল ছিল। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সুসম্পর্ক যে কোনো সময়ের চেয়ে অত্যন্ত উষ্ণ এবং অতুলনীয়, তাহলে তো সরকার অতি সহজেই এ চুক্তিটি সম্পাদন করতে পারে। খালেদা জিয়াকে দেখিয়ে দিতে পারে, তিনি যে ভুল করেছেন, বর্তমান সরকার তা করেনি। প্রশ্ন হলো, সুসম্পর্কের অতি মধুরতার স্মারক হিসেবে সরকার এ চুক্তিটি সম্পাদন করে কেন দেখিয়ে দিচ্ছে না? তা না করে ভারতের কোর্টে বল ছেড়ে দিয়েছে কেন? সুসম্পর্কের মানে কি এই, ভারত তার চাহিদামতো করিডোর, বন্দর ব্যবহার, বাণিজ্যিক সুবিধাসহ যা যা চাইবে, তা দিয়ে দিতে হবে? বিনিময়ে বাংলাদেশ তার ন্যায্য পাওনাটুকু পাবে না? দেশের মানুষ জানে, ভারতের কাছ থেকে সরকার ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি ছাড়া কিছুই পায়নি। দেশ ও জনসাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করে ক্ষমতায় থাকার জন্য ভিনদেশের সমর্থন আদায়ের এমন নজির পৃথিবীতে আর কোনো স্বাধীন দেশ আছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই।
তিন.
ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য প্রাপ্তির আশা এখন দুরাশা ছাড়া কিছুই নয়। তার কাছ থেকে পানি আদায়ের যে কয়টি কৌশল বা বিনিময় প্রথা ব্যবহার করা যেত, তার কোনোটিই এখন আর বাংলাদেশের হাতে নেই। ভারতের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় একটি বিষয় ছিল করিডোর। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য হতে পারত এটি একটি বড় হাতিয়ার। দুঃখের বিষয়, ভারত চাইল আর বাংলাদেশ সরকার তা এমনি এমনি দিয়ে দিল। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের শেষ অস্ত্রটি সমর্পণ করে দিল। অথচ করিডোর আমাদের জন্য নয়, ভারতের জন্য খুবই জরুরি ছিল। ভারতের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে মালামাল পরিবহনে এই করিডোর ছিল তার জন্য বহু কাক্সিক্ষত। ভারত এটি খুব সহজেই পেয়ে গেল। সরকারের পক্ষ থেকে এই করিডোরকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন, এটা এক বাড়ির ওপর দিয়ে আরেক বাড়িতে যাওয়ার পথ ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকার এই ব্যাখ্যাও দিচ্ছে, এতে বাংলাদেশ মাশুল পাবে। বিষয়টি এমন যেন বাংলাদেশ অসীম লাভবান হয়ে গেছে। অথচ এই মাশুলের পরিমাণ কত হবে, তা ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। এমনকি বাংলাদেশ যে মাশুল নির্ধারণ করেছিল, তাও ভারতের চাপে প্রায় তিন ভাগের একভাগে নামিয়ে এনেছে। এটি এখন অনেকটা প্রতীকী মাশুলে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রতীকী মাশুল কি বাংলাদেশের জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে থাকা পানির ন্যায্য হিস্যার চেয়ে দামি বা সমতুল্য হতে পারে? সরকার ও তার পক্ষের লোকজন অবশ্য এই মাশুল এবং করিডোরকে কানেক্টিভিটি বলে এমন ব্যাখ্যা দিচ্ছে যেন, বাংলাদেশ তার আশপাশের কয়েকটি দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সোনার খনিতে পরিণত হবে। বলাবাহুল্য, একজন সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও জানে, এসবই বলা হচ্ছে ভারতকে তুষ্ট করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। তা না হলে দেশের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে এমন একপক্ষীয় প্রদান বিশ্বের কোনো দেশই করবে না। আর পৃথিবীতে এমন প্রতিবেশী কি আছে যে কেবল নিয়েই যায়, সৌজন্যস্বরূপ কিছুই দেয় না? বাংলাদেশের জনগণ এখন ভালো করেই জানে, ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা নিকট নয়, দূর ভবিষ্যতেও আদায় করা সম্ভব হবে না। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের মানুষ তা দেখেছে। নিষ্পন্ন হওয়া এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতেই ভারত ৪৪ বছর লাগিয়েছে। আর ন্যায্য পানি? সে যে দিল্লি দূরঅস্ত হবে, তা বলা অনাবশ্যক। এ অবস্থায় আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা যে নিজেরা করব, সে ক্ষেত্রেও ভারত আপত্তি করছে। ফারাক্কার বিকল্প হিসেবে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তাতেও ভারতের আপত্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তার কথা বিকল্প গঙ্গা ব্যারাজ নির্মিত হলে নাকি তার অংশে ভাঙন দেখা দিতে পারে এবং তার নি¤œাঞ্চলে বন্যা দেখা দিতে পারে। কী আশ্চর্য কথা! সে ফারাক্কার মাধ্যমে পানি আটকে রেখে প্রত্যাহার করবে, আর তা থেকে চুঁইয়ে যেটুকু পানি পড়বে, তা ধরে রেখে আমরা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করব, তাতেও ভারতের আপত্তি! এমন বৈরী মনোভাবসম্পন্ন এবং অতি স্বার্থপর প্রতিবেশী বিশ্বে আর কোথাও আছে কি? অথচ ২.১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই ব্যারাজ নির্মিত হলে পানি ধরে রেখে দেশের ১৬টি নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। গঙ্গানির্ভর এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। লবণাক্ততা থেকে সুন্দরবন রক্ষা পাবে। প্রকল্পের আওতায় ৫১ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ২৯ লাখ হেক্টর জমি কৃষি কাজে এবং ১৯ লাখ হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আসবে। এতে বছরে ২৫ লাখ মেট্রিক টন বাড়তি ধান এবং ১০ লাখ টন অন্যান্য ফসল উৎপাদন হবে। মৎস্য উৎপাদন হবে ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। ব্যারাজ নির্মাণে যে খরচ হবে, তা মাত্র পাঁচ বছরে উঠে আসবে। ব্যারাজ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের এসব সুবিধা দেখে যে ভারতের ঈর্ষা হচ্ছে, তা তার অপত্তি থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে যে অজুহাত দেখিয়েছে বিশেষজ্ঞরা একে অত্যন্ত খোঁড়া বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশের যে জায়গায় ব্যারাজটি নির্মাণ করা হবে, সেখান থেকে উল্টো ¯্রােত ভারতীয় অংশে গিয়ে আঘাত করার প্রশ্নই আসে না। উল্টো ¯্রােত দেখা দিলেও তা কোনোভাবেই বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করবে না। বরং দেশকে মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ সরকার ভারতের অযৌক্তিক আপত্তিকে গুরুত্ব দেবে নাকি ব্যারাজটি নির্মাণ করে দেশের উন্নয়ন ও অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দেবে।
চার.
বলা হয়, পৃথিবীতে প্রাণী ও উদ্ভিদরাজির অস্তিত্ব টিকে আছে পানির কারণে। যেখানে পানি নেই সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নেই। এ কারণে এখন বিজ্ঞানীরা বৃহস্পতি, শুক্র, শনি ও মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব জানার জন্য আগে পানির সন্ধান করেন। পানি থাকার অর্থ প্রাণও থাকা। এ জন্য ভিনগ্রহে পানির অস্তিত্ব খোঁজার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করছে না। কারণ পানিকে কেন্দ্র করেই সভ্যতা গড়ে ওঠে। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত সভ্যতা গড়ে উঠেছে, তা পানিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। আমাদের এই উপমহাদেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, জনপদ, নগর, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজ-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। আর বাংলাদেশের অস্তিত্ব তো জালের মতো বিস্তৃত নদ-নদী। নদী আছে তো বাংলাদেশ আছে। নদী নেই, বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশের সজীব-সতেজ থাকার লাইফ লাইনই হচ্ছে এর অসংখ্য নদ-নদী। এসব নদ-নদীর নাব্য ধরে রাখতে সরকারকেই সর্বাগ্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তার সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে পানির ন্যায্য প্রাপ্তি আদায় করতে হবে। নিদেনপক্ষে তিস্তা চুক্তিটি যত দ্রুত সম্ভব সম্পাদনে ভারতকে রাজি করাতে হবে। ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি নয়, দেশের স্বার্থে পানি প্রাপ্তির গ্যারান্টি আদায় করতে হবে। তা না হলে সরকারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের বিষয়টি জনগণের কাছে প্রহসন ছাড়া কিছুই মনে হবে না। এর পাশাপাশি গঙ্গা ব্যারাজের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে। বলাবাহুল্য, যে পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার অতি গর্ব করছে, সেই পদ্মায় যদি পানি না থাকে, তবে এ সেতু অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, পদ্মা তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে। কাজেই পদ্মা সেতুকে অর্থবহ করে তুলতে এবং পদ্মার স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের বিকল্প নেই। দেশের নদী শাসনের যে কার্যক্রম তা জোরদার করতে হবে। আমরা জানি, ড্রেজিংসহ দেশের নদ-নদী শাসনের বিভিন্ন কার্যক্রমে বছরে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ ও ব্যয় করা হচ্ছে। এই অর্থ নিয়েও দুর্নীতির মাধ্যমে নয়-ছয় করা হচ্ছে। ফলে শুধু অর্থই ব্যয় হচ্ছে, আশানুরূপ কাজ হচ্ছে না। এ ধরনের অর্থহীন কার্যক্রম ও অপচয় নিরোধ করে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে কিছুটা হলেও দেশের নদ-নদীতে পানি ও প্রাণের সঞ্চার হবে।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন