যানজট নিঃসন্দেহে রাজধানীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। যানজটে প্রতিদিন নগরবাসীর ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে রাজধানীর যানজট বছরে ৯৮ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি বা অপচয় ঘটাচ্ছে। সন্দেহ নেই, দুনিয়ার অনেক নগরই যানজটে আক্রান্ত। এই উপমহাদেশের দিল্লি, কলকাতা, করাচি সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে দুনিয়ার কোথাও শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগে কিনা তা আমাদের জানা নেই। ঢাকায় ঘণ্টায় বাসের গতি নয় কিলোমিটারেরও নিচে। লন্ডনে এ গতি দ্বিগুণেরও বেশি ১৮ কিলোমিটার। রাজধানীর যানজট নিরসনে একের পর এক উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো ইতিবাচক উন্নতি ঘটছে না। বিশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থাই যে রাজধানীর যানজটের জন্য প্রধানত দায়ী তাতে সংশয়ের সুযোগ নেই। ফলে ছুটির দিনে যখন যানবাহন চলাচল অর্ধেকে নেমে আসে তখনো যানজটের ভোগান্তি পিছু ছাড়ে না।
যানজটের লাগাম টানতে হলে ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। যেখানে-সেখানে পার্কিংয়ের যথেচ্ছতা বন্ধে নিতে হবে উদ্যোগ। ফুটপাত ও সড়ক দখল করে দোকানপাট খোলা কিংবা জিনিসপত্র রাখার প্রবণতা রুখতে হবে। যেখানে-সেখানে বাসে লোক উঠানোর বদভ্যাস বন্ধে নিতে হবে কড়া ব্যবস্থা। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব বন্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবতে হবে। প্রতিটি সড়কে অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলে আলাদা লেন চালু এবং যেখানে-সেখানে রাস্তা পারাপার বন্ধেরও উদ্যোগ নেওয়া দরকার। প্রাইভেট কারের চাপ কমাতে রাজধানীতে মানসম্মত বাস চালুরও উদ্যোগ নিতে হবে। যানজটের কারণে প্রতিদিন যে বাড়তি জ্বালানি পোড়ে তা জাতীয় অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর যানজট বন্ধ হলে উৎপাদনশীলতায় তা যে অবদান রাখবে, তাতে জাতীয় প্রবৃদ্ধি প্রতি বছরই ৭ শতাংশের বেশি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হওয়ার টার্গেট পূরণ সহজতর হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য মেট্রোরেল-পাতালরেল এবং ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রাসঙ্গিকতা থাকলেও সবচেয়ে জোর দিতে হবে ট্রাফিক শৃঙ্খলাকে। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত না হলে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও কোনো সুফল যে অর্জিত হবে না। এ সহজ সত্যটি সবকিছুর আগে অনুধাবন করতে হবে।
রাজধানীর যানজট কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। যানজট কমানোর বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ তেমন কোনো কাজেই আসছে না। নিকট ভবিষ্যতে এই যানজট কমবে, এমন কোনো ধারণাও পাওয়া যাচ্ছে না। বরং বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, দ্রুত পরিকল্পিত উদ্যোগ না নেওয়া হলে ২০৩৫ সাল নাগাদ যানজট বর্তমানের দ্বিগুণ হবে। তখন কি ঢাকায় মানুষের জীবনযাত্রা সচল থাকবে? ঢাকায় রাস্তা বাড়ছে না। অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা নগরীতে এমনভাবে ভবন তৈরি হয়েছে, যেখানে রাস্তা বাড়ানোর সুযোগও কম। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী ঢাকার রাস্তায় বড়জোর দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলাচল করতে পারে। বাস্তবে চলছে তার চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি। ফলে যানজটে নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে। তার পরও রাজধানীতে প্রতিদিন ৩৭১টি নতুন গাড়ি নামছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে গাড়ি নেমেছে এক লাখ ১৪ হাজার ২৭১টি, যার অধিকাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি। ২০১০ সালে যেখানে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ছয় লাখের কম, ২০১৭ সালের অক্টোবরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লাখে। আবার অ্যাপভিত্তিক গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় গাড়িগুলোর ট্রিপ সংখ্যাও অনেক গুণে বেড়ে গেছে। অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি সংগ্রহে আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। বাইরে থেকেও প্রতিদিন অনেক গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করছে। তাই অল্প কিছু উড়াল সড়ক বাড়লেও তা যানজট কমানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। অন্যদিকে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা হু হু করে বাড়লেও বাড়ছে না গণপরিবহন। পুরনো লক্কড়ঝক্কড় বাসেই চলছে বেশির ভাগ মানুষের অতি কষ্টের চলাচল।
শৃঙ্খলাহীনতাও রাজধানীতে যানজটের একটি বড় কারণ। বাস-মিনিবাসগুলো যেখানে-সেখানে দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করানো হয়। প্রাইভেট কার, ট্রাক, ভ্যান ইত্যাদি যত্রতত্র রাস্তার ওপরে পার্কিং করে রাখা হয়। একই সড়কে ধীরগতির ও দ্রুতগতির যানবাহন চলায় পুরো রাস্তায় গতি কমে যায়। অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের জন্যও রাস্তায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়। ফুটপাতগুলো হকার ও দোকান মালিকদের দখলে চলে যাওয়ায় পথচারীরা বাধ্য হয় রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে। এতেও গাড়ি চলাচলের রাস্তা সংকুচিত হয়ে যায়। আর বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পারাপার যানবাহনের গতি কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রচুর দুর্ঘটনাও ঘটায়। এসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনার উল্লেখযোগ্য কোনো প্রচেষ্টাই দেখা যায় না। পুরনো ও ফিটনেসহীন গাড়িও যত্রতত্র নষ্ট হয়ে যানজটের সৃষ্টি করে।
বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়, ঢাকায় যানজটের দ্রুত বা আশু সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে জরুরি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। ঢাকায় প্রতিনিয়ত মানুষ বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। এখনই উদ্যোগ না নিলে পাঁচ-দশ বছর পরে যে অবস্থা হবে, তাতে সমাধানের কথা চিন্তা করাও হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রয়োজনে নতুন ব্যক্তিগত গাড়ি নামানোকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ লেন করে গণপরিবহনের চলাচল সহজ করতে হবে। রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন