‘ঢাকার উত্তরা ট্রাফিক বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাপ্তাহিক ভিত্তিতে টাকা দেই। পরিবহন কোম্পানির লোক মাসোহারা হিসেবে এই টাকা পৌঁছে দেয় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার কাছে। উদ্দেশ্য যাতে ওই সব পরিবহণের বিরুদ্ধে রাস্তায় কোনো মামলা করা না হয়। এত কিছুর পরও রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে মামলা দেয়া হয়’। গতকাল বুধবার মতিঝিল এলাকায় একটি পরিবহণের চালক মাসুদ মিয়া এভাবেই নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে। ‘বডি অন ক্যামেরা’ও রুখতে পারছে না তাদের অনিয়ম। সাপ্তাহিক ও মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে অবৈধ পন্থায় বড় অঙ্কের অর্থ পকেটে ভরে দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এছাড়া যানবাহনের কাগজ দেখার নামে হয়রানি ও চাঁদা আদায় অনেকটাই ওপেন-সিক্রেট।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, কাগজপত্র চেক করার নামে ট্রাফিক পুলিশ যত্রতত্র যানবাহন থামিয়ে চাঁদা আদায় করে। নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন নানা ব্র্যান্ডের গাড়ি কারণে-অকারণে থামিয়ে কাগজপত্র দেখার অজুহাতে হয়রানি করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটক রাখার ফলে নগরীতে যানজট আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাড়ির কাগজপত্র চেক করা নয়, সাধারণ মানুষকে হয়রানি আর টাকা আদায়ই তাদের মূল টার্গেট বলে ভুক্তভোগীরা জানান। রাস্তায় লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা ফিটনেসবিহীন যাত্রীবাহী বাস চলাচল করলেও সেদিকে তাদের নজর নেই। ফিটনেসবিহীন যাত্রীবাহী বাস আটক করা হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে এসব ফিটনেসবিহীন বাসের চালক ও মালিকদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা মাসোহারা নিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। আর এ মাসোহারার জোরেই রাস্তায় চলাচল বন্ধ হচ্ছে না লক্কড়-ঝক্কড় ফিটনেসবিহীন যানবাহন।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের জয়েন্ট কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান ইনকিলাবকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশ চাঁদাবাজি করছে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। রাজধানীর বাস টার্মিনাল ও সড়কসমূহে অপেশাদার কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নজরদারি করছেন। সিসি ক্যামেরা ফুটেজের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীতে নিয়মিত যাতায়াতকারী বালুর ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্রেনিং কার, মুরগি পরিবহণের বিশেষ গাড়ি, মালবাহী পিকআপ ও প্রাইভেট সিএনজি থেকে পুলিশের নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে মাসোহারা ভিত্তিতে। রাজধানীতে রাতভর চাঁদাবাজি করে ট্রাফিক পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের বিপথগামী সদস্যরা। গত সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় কিছু পুলিশ সদস্যকে ট্রাক থামিয়ে চাঁদা আদায় করতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশের এ চাঁদাবাজি নিত্যদিনের। যানজটের তোয়াক্কা না করে শুধু দিনে নয়, রাতভর চাঁদা নিতে তৎপর এসব পুলিশ সদস্য। প্রতিটি ট্রাক থেকে ন্যূনতম ৫০ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা বা তারও বেশি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়ে থাকে। জুরাইন, পোস্তগোলার দিক থেকে আসা যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মুখে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা রাত ১টা ৫০ মিনিট থেকে ১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত ৫টি ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করেন। একই দিন রাতে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের ওপর একটি সিএনজি থামিয়ে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করতে দেখা গেছে পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজনকে। শুধু যাত্রাবাড়ী আর খিলগাঁও নয়, রাত হলেই রাজধানীজুড়ে ট্রাফিক পুলিশের বিপথগামী সদস্যরা চাঁদাবাজি চালায়। অতি তুচ্ছ কারণে রাতের বেলা রাস্তায় চলতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন যানবাহন চালকরা।
গতকাল মালিবাগে হামিদ আহম্মেদ নামে এক ট্রাকচালক ইনকিলাবকে বলেন, চালকদেরও অনেক দুর্বলতা থাকে, যার সুযোগ নেয় ট্রাফিক পুলিশ। গাড়ির কাগজপত্রে ত্রুটি ও ড্রাইভিং লাইসেন্সে ত্রুটিজনিত দুর্বলতা থাকায় গাড়ির চালকরা পুলিশকে চাঁদা দিতে বাধ্য হয়।
রাজধানীর কয়েকটি পয়েন্টে হয়রানির শিকার চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চালকের অপরাধ থাকার পরও মামলা না দিয়ে অবৈধ উপায়ে টাকা নেয়ার সময় কনস্টেবল ও আনসার কর্মীদের ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো সময় সার্জেন্ট সামনে এলেও থাকে না নেমপ্লেট। টাকা হাতিয়ে নিতে আইনের শেষ নেই তাদের।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সার্জেন্টরা টাকা নেয়ার সময় ইচ্ছে করেই ‘বডি অন ক্যামেরা’ বন্ধ রাখে। আবার কাজ শেষে ‘অন’ করেন। দরকষাকষি করেন কনস্টেবল। আবার গাড়ির সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ছোটখাটো ইস্যু সামনে এনে নেয়া হয় টাকা। যার পরিমাণ ১০০-২০০ টাকা। ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে অপরাধের ধরন বুঝে নেয়া হয় ১০০-৫০০ টাকা।
একজন ভুক্তভোগী মোটরসাইকেল (পাঠাও) চালক আল আমিন বলেন, মহাখালী যক্ষ্মা হাসপাতালের সামনে ফুটওভার ব্রিজের নিচে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবল এসে তার গাড়ি থেকে চাবি নিয়ে যায়। যদিও ওই ট্রাফিক সদস্যের নেমপ্লেট ছিল না। সব কাগজ থাকার পরও রাস্তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য ১০০ টাকা জরিমানা করেন।
উত্তরায় বসবাসকারী ব্যবসায়ী কামরুল বলেন, উত্তরা থেকে গুলিস্তান আসতে একটি প্রাইভেটকারকে ৪ থেকে ৫টি পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশের তল্লাশি মোকাবেলা করতে হয়। কোনো ধরনের কারণ ছাড়াই গাড়ি থামিয়ে অবান্তর প্রশ্ন করা হয়। আবার ট্রাফিক পুলিশের দাবি করা টাকা দিলে কোনো কাগজপত্র না থাকলেও অনেক গাড়ি ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া রাতের বেলা চলে ট্রাক থামিয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। উত্তরা জোনে ট্রাফিক পুলিশ আব্দুল্লাহপুর, হাউজ বিল্ডিং, জসিম উদ্দিন রোড ও এয়ারপোর্টে কর্মরত টিআই ও সার্জেন্টরা বিভিন্ন পরিবহণ থেকে বেপরোয়াভাবে চাঁদাবাজি করছে। উত্তরা জোনে ট্রাফিক পুলিশ আব্দুল্লাহপুরে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি করছে। এছাড়াও গাজীপুর থেকে সিএনজি অটোরিকশা উত্তরায় প্রবেশ করলেই সার্জেন্টদের চাঁদা দিতে হয়। মাসিক হিসেবে ঐসব সিএনজি অটোরিকশার মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে ট্রাফিক পুলিশ। তারা প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশা থেকে ১ হাজার টাকা করে মাসিক হিসেবে আদায় করছে।
যানবাহনের চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপাররা জানান, কোনো রুটের যানবাহনই চাঁদামুক্ত নয়। বরং চলাচলকারী সব গাড়িকে প্রতি ট্রিপেই নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদা পরিশোধের পর টার্মিনাল ছাড়তে দেয়া হয়। সে ক্ষেত্রে দূরপাল্লার কোচ থেকে ১২শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। লোকাল সার্ভিসের প্রতিটি গাড়ি থেকে ট্রিপে আদায় করা হচ্ছে ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন