রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আতঙ্কে হাওরাঞ্চলের কৃষক

এ কে এম আব্দুল্লাহ, নেত্রকোনা থেকে | প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দু’দফা সময় বাড়ানোর পরও নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চলের ফসল রক্ষায় সকল বেড়ি বাঁধের সংস্কার কাজ সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে শেষ না হওয়ায় আগাম বন্যার আশংকায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা ও বারহাট্টা উপজেলার নিন্মাঞ্চল নিয়ে হাওরাঞ্চল। হাওরাঞ্চলের কৃষকদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে সারা বছরের একমাত্র বোরো ফসল। সরকার প্রতি বছর হাওরের ফসল রক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ ছিলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলা ও স্থানীয় জন প্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) লোকজনের অতি মুনাফালোভী মানসিকতার কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঠিক ভাবে বাঁধের সংস্কার কাজ সম্পন্ন না করায় প্রায় প্রতি বছর অকাল বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। গত বছর মার্চের শেষের দিকে বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের কারণে হাওরে পানি প্রবেশ করে বাঁধ ভেঙে খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা উপজেলার নিন্মাঞ্চলের শতভাগ ফসল পানিতে তলিয়ে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাওরাঞ্চলের মাছসহ জীববৈচিত্রও।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জেলার হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা, বারহাট্টাসহ বিভিন্ন উপজেলায় ছোট বড় ১৩৪টি হাওর রয়েছে। এর মধ্যে খালিয়াজুরীতেই রয়েছে ৮৯টি হাওর। এছাড়াও হাওরের ফসল রক্ষায় ২৭১ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার ডুবন্ত (অস্থায়ী) বাঁধ রয়েছে। ওই বাঁধের ওপর স্থানীয় কৃষকদের ৪৭ হাজার ৯ শত ৪ হেক্টর জমির বোরো ফসল নির্ভর করে। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় এ বছর হাওরের ফসল রক্ষায় ৭৩টি প্রকল্পের বিপরীতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে খালিয়াজুরীতে ৪৫টি, মোহনগঞ্জে ১৩টি, মদনে ৯টি, পূর্বধলায় ৩টি, কলমাকান্দায় ২টি, বারহাট্টায় ১টি ও পাশ্ববর্তী ধর্মপাশায় ১টি প্রকল্প রয়েছে। এ সকল প্রকল্প বাস্তবায়নে ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হলেও প্রথমে ৩ কোটি ১০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে চলতি বছরের ২৮ফেব্রæয়ারির মধ্যে হাওরাঞ্চলের প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় সরকার প্রথমে ১৫ মার্চ পরে আরো ৫ দিন বাড়িয়ে ২০ মার্চের মধ্যে সকল প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। শেষ মূহুর্তে হাওরে বাঁধের কাজ চলছে জোরেশোরে। তারপরও এখনও অনেক প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হয়নি। বন্যার পানি আসার আগেই বাঁধের সব কাজ শেষ হয়ে যাবে, এমন আশাবাদের কথা বলেছেন সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সাথে জড়িতরা। কিন্তু তড়িগড়ি করে দেয়া বাঁধ কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে স্থানীয়দের মাঝে।
নেত্রকোনা জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আনিছুর রহমান বলেন, আমি কয়েকদিন পরপরই হাওরে কৃষকদের নিয়ে সভা সমাবেশ করছি। ইতোপূর্বে কাজের গতি ছিল অত্যন্ত মন্থর, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার পর এখন তড়িগড়ি করে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হচ্ছে। হঠাৎ করে পাহাড়ী ঢল এসে ধাক্কা দিলে এই বাঁধ ঠিকবে কি না আমার সন্দেহ রয়েছে।
জেলার মদন উপজেলার মাখনা গ্রামের বাসিন্দা, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক, শফি আহমেদ বলেন, হাওরে ফসল রক্ষা বেড়ি বাঁধের কাজ মোটামুটি হয়েছে। তবে কিছু ঝুকিপূর্ণ জায়গা প্রকল্প থেকে বাদ পড়েছে। এ গুলো দেখে অতি দ্রæত মেরামত করা প্রয়োজন। প্রতি বছর পাহাড়ী ঢল ও অকাল বন্যায় নেত্রকোনার বেশীর ভাগ নদ নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অকাল বন্যার হাত থেকে স্থায়ীভাবে পরিত্রাণ পেতে হলে নদ-নদী খনন ছাড়া এর কোন বিকল্প নেই।
খালিয়াজুরী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া জব্বার বলেন, সঠিক নিয়মে প্রকল্প তৈরী এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী ও ইউপি চেয়ারম্যানদের যোগসাজসে পিআইসি’র বেশীর ভাগ কমিটিতে চেয়ারম্যানদের নিজস্ব লোকজনদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে কমিটি। অনেক কমিটির বিরুদ্ধে দায়সারা গোছের কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। ঢলের পানি আসলে এ সমস্ত বাঁধ কোন কাজেই আসবে না।
কৃষকদের অভিযোগ, যে সব বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই বাঁধের গুড়ি থেকেই মাটি কাটা হচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কীর্তণখোলা বেড়ি বাঁধের গুড়ি থেকে ভ্যাকু মেশিন দিয়ে মাটি তোলে বাঁধ সংস্কার করা হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চাকুয়া ইউনিয়নের লেপসিয়া বাজার, হাতিনা শিবির, পাটরা ও হারাকান্দি এলাকায় বাঁধ সংস্কার কাজে অনিয়ম হয়েছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রকল্প কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন এবং স্থানীয় ইউএনও সব সময় কাজের তদারকি করেছেন। কাজেই অনিয়ম করার কোন সুযোগ নেই।
নেত্রকোনা উন্নয়নে নাগরিক আন্দোলনের সাবেক সদস্য সচিব হারুন অর রশিদ বলেন, দু দফা সময় বাড়ানোর পরও খালিয়াজুরীর ৪৫টি প্রকল্পের মধ্যে এখনও অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। বাঁধে ঠিক মত মাটি বসানো ও ঘাস লাগানো হয়নি। তিনি এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর মনিটরিংয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেন। হাওরের ফসল রক্ষায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ সঠিক সময়ে টেকসই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সম্পন্নের দাবী জানিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, জনউদ্যোগ, কৃষক সমিতি, নেত্রকোনা উন্নয়নে নাগরিক আন্দোলন, হাওর উন্নয়ন পরিষদসহ স্থানীয় কৃষকরা বিভিন্ন সময় সভা সমাবেশ ও মানববন্ধন করলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঠিক ভাবে কাজ শেষ না করায় তারা হতাশ।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরকার আবদুল্লাহ আল-মামুন বাবু বলেন, ইতিমধ্যে সবকটি বাঁধের ৯৫ ভাগ মাটি কাটার কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে বাঁধের মাটি লেবেল ও ঘাস লাগানোর কাজ। অকাল বন্যা হলেও এখন ফসলহানির সম্ভাবনা অনেক কম।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে কোন বড় ধরণের অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়নি। হাওরের ফসল রক্ষার জন্য আমরা যে সকল বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছি, তা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন যে সমস্ত ত্রæটি বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে তা ঠিক করা হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
শরীফ ২৮ মার্চ, ২০১৮, ২:৪৩ এএম says : 0
এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সিরিয়াস হতে হবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন