আফতাব চৌধুরী
খাদ্য অপরিহার্য। তা শুধু মানুষের নয়, সকল প্রাণীর জন্যই। তারপরই বাসস্থান, নিরাপত্তা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য উপাদান। অথচ মানুষ আজ তার মৌলিক ও প্রাথমিক আবশ্যক খাদ্য চাহিদা পূরণে ব্যর্থতার সম্মুখীন। নিকট ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বগ্রাসী রূপ ধারণ করতে পারে। তার পূর্বাভাস ইতিমধ্যে স্পষ্টতই দৃশ্যমান। সম্ভাব্য চরম খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও রাষ্টনেতারা যথেষ্ট ভাবিত। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অতি উন্নত দেশের পক্ষেও খাদ্য সংকটের প্রভাবমুক্ত থাকা সম্ভব হবে না।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে তীব্র খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হতে পারে, তার পূর্বাভাস অর্থনীতিবিদরা বহু পূর্বে দিয়ে রেখেছেন। দুই শতাধিক বর্ষ পূর্বে অর্থনীতিবিদ থমাস মালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বে খাদ্যাভাব জর্জরিত ভবিষ্যৎ বিশ্বের রূপ চিত্রায়িত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জ্যামিতিক হার এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির গণিতিক হারের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতাকে খাদ্য সংকটের অবশ্যম্ভাবিতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন ঐ প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ। যাই হোক, বর্তমান বিশ্বে ক্রমপ্রকটমান খাদ্য সংকটকে প্রত্যক্ষভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করা এ রচনার মূল উদ্দেশ্য নয়। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পায়ন-নগরায়ন কীভাবে খাদ্য সংকটে এক ভয়াবহ মাত্রার সংযোজন ঘটিয়ে চলেছে সেটি এ রচনার প্রতিপাদ্য বিষয়।
শিল্পায়ন ও কৃষিবিকাশ একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হয়। যন্ত্রপাতি, সার, কীটনাশক ইত্যাদির যোগানের মাধ্যমে শিল্পায়ন কৃষিবিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা তথা শিল্পায়নে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান কৃষির পক্ষে হানিকর প্রমাণিত হয়। এ ক্ষেত্রে কৃষির সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা সাধারণ মানুষের খাদ্য সংকট মোচনে সক্ষম নাও হতে পারে। শিল্পায়ন কৃষিক্ষেত্রে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের চেয়ে অর্থকরী শস্যের উৎপাদনকে অধিক উৎসাহিত করে। অর্থাৎ যেসব শস্য শিল্পাকারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেগুলো উৎপাদনে কৃষকরা অধিক উৎসাহিত হয়। তাছাড়া, এসব শস্যের উৎপাদন কৃষকদের কাছে অধিকতর লাভদায়ক হওয়ায় তারা খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমিয়ে শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত অর্থকরী শস্যের উৎপাদনে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। সামগ্রিকভাবে দরিদ্র-বৈরি শিল্পায়ন সাধারণ মানুষের কাছে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের লভ্যতার সংকোচন ঘটায়। বর্তমানে উচ্চবিত্তদের মধ্যে প্রসেসড ফুডের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য সংশ্লিষ্ট কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে ফলমূল, দানাশস্য, দুধ, গোশত সবই রয়েছে। ফলে ঐসব খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন বাড়লেও তা সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের ব্যবহারের জন্য সহজলভ্য হয় না। যারা এগুলো উৎপাদন করে তারা তার ব্যবহারে সক্ষম হয়। শিল্পায়নের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনিক শ্রেণী ও দরিদ্র শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতার তুলনামূলক ব্যবধান। ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের এ যুগে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এত নিম্ন যে তাদের পক্ষে খাদ্যের ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মেটানো সম্ভব হয় না। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী মজুত থাকলেও এদের কাছে তা লভ্য নয়, কেননা এদের ক্রয়ক্ষমতা শূন্যের কাছাকাছি।
শিল্পায়নের ক্রমব্যাপ্তির এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে হ্রাস পাচ্ছে কৃষিজমির পরিমাণ। বনাঞ্চল বা ঊষর ভূমিতে যে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে উর্বর কৃষিজমি শিল্পকারখানার দখলে চলে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষরূপে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপর। শিল্পায়নের ফলে বাড়ছে নগরায়ন, কমছে চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ। তাছাড়া, শিল্পায়ন-নগরায়নের যুগলবন্দি প্রদূষণ সৃষ্টির মাধ্যমে খাদ্যশস্যের ফলনে মন্দাভাব ডেকে আনছে।
খাদ্যসংকট সৃষ্টিতে শিল্পায়ন-নগরায়নের পরোক্ষ প্রভাব অনেক জটিল, সুদূরপ্রসারী ও বহুমুুখী। এ প্রভাব এখন তেমন প্রকট না হলেও আগামী দশক কয়েকের মধ্যে এর ভয়াবহ রূপ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করবে। তার পর্যাপ্ত সংকেত এ মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে। শিল্পায়ন, নগরায়নসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন আগামী বিশ্বে বিশেষ করে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে তীব্র খাদ্যসংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হবে। বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনেতারা এ নিয়ে তাদের আশঙ্কার কথা ইতিমধ্যে ব্যক্ত করেছেন। উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ুর অবাঞ্ছিত পরিবর্তনের ফলে কোথাও প্রচ- খরা আবার কোথাও প্রচ- বর্ষণ ও বন্যা ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনছে। দেখা যাচ্ছে আরো আশ্চর্যজনক ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। গ্রীষ্ম-বর্ষায় বৃষ্টির আকালে দেখা দিচ্ছে খরা আর কোন কোন অঞ্চলে শীতকালে প্রচুর বৃষ্টিতে হচ্ছে বন্যা। জলবায়ুর এ কা-ে মার খাচ্ছে কৃষি-খাদ্যশস্যের উৎপাদন।
শিল্পায়ন-নগরায়নের ফলস্বরূপ বায়ুমন্ডলে গ্রীণ হাউস গ্যাস, বিশেষত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে গোলকীয় তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে এ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ বা তারও আগে। এমতাবস্থায় অ্যান্টার্কটিকা, গ্রীণল্যান্ড তথা হিমবাহের বরফাচ্ছদন দ্রবীভূত হয়ে সমুদ্রের পানি পৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ থেকে ২.৫ মিটার অবধি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এমন ঘটনা যে এক অবর্ণনীয় সুদূরপ্রসারী বিপর্যয় ডেকে আনবে তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। উপকূলীয় অঞ্চল ও অনেক দ্বীপমালা পানিহীন হয়ে যাবে। আক্রান্ত অঞ্চল থেকে ভূ-ভাগের অন্যত্র মারাত্মক হারে প্রব্রজন ঘটবে। পরিণতিস্বরূপ বেকারত্ব, দারিদ্র তথা খাদ্যসংকট এক বিভীষিকাময় রূপ ধারণ করবে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে আগামী বিশ্বে চরম পানি সংকট দেখা দিবে, যার ফলস্বরূপ খাদ্যসংকট তীব্রতর হবে। পৃথিবীর গাত্র বেয়ে বয়ে চলা নদী-নালার প্রবাহিত পানির উৎস হিমবাহ। হিমবাহ থেকে নিরন্তর প্রবাহ রূপে পানি সাগরে গড়াচ্ছে। আবার সাগর থেকে বাষ্পাকারে এ পানি পূণরায় হিমবাহে জমা হচ্ছে। এ জমাট ও গলন প্রক্রিয়ায় পুরো বিষয়টি চক্রাকারে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অথচ উষ্ণায়নের ফলে বর্তমানে এ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। অত্যধিক বরফ গলনের কারণে নদী-নালা একসঙ্গে এত পানি ধারণ করতে না পারায় দেখা দিচ্ছে অকাল বন্যা, বিঘিœত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন, সৃষ্টি হচ্ছে খাদ্য সংকট। গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর ক্রম উষ্ণায়মানতার কারণে সাগর থেকে জলীয় বাষ্প উঠে এলেও তা হিমবাহ গাত্রে জমাট না বেঁধে বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়ছে। তাই শীত-বসন্তে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এ জন্য দেখা যাচ্ছে বর্ষায় খরা আর শীতে অকাল বৃষ্টি-বন্যা। অর্থাৎ প্রয়োজনের সময় পানি নেই, অথচ অপ্রয়োজনে অপ্রত্যাশিত পানি। উভয় অবস্থাতে বিঘিœত হচ্ছে কৃষিকাজ, বাড়ছে খাদ্য সংকট।
এক সময় বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হতো। এর ফলে নদীনালা-খালবিল ভরাট থাকতো। পানির অভাবে কৃষিকাজ বিঘিœত হতো না। কিন্তু উষ্ণায়নের প্রভাবে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত খুবই কম হচ্ছে। এদিকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত বেশিরভাগ নদীর উজান দিকে বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক গতিপথকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা তাদের দেশের জন্য পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়ার ফলে বাংলাদেশ তার পানির ন্যায্য পাওনা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে কৃষিকাজে ব্যাপক অসুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে-মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, মৎস্য চাষ ব্যাহত হচ্ছে, নানারকম রোগের সৃষ্টি হচ্ছে, গাছপালা মরে যাচ্ছে। জাতীয় এ সমস্যার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি কৃত্রিম নদী ও জলাশয় খনন করে পানি ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে-যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করা হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, উষ্ণায়নের ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে হিমবাহগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ফলে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দক্ষিণ আমেরিকাসহ চীন, বাংলাদেশ, ভারত ও এশিয়ার আরো অনেক দেশ। সবচেয়ে বেশি বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষিক্ষেত্রে। নদী-নালার পানিধারার উৎস হিমবাহ নিশ্চিহ্ন হলে অনেক নদী-নালা অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে যা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে যে কৃষিভিত্তিক সভ্যতা নদীকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছিল তার বিপর্যয় ঘনিয়ে আসবে। কেননা, বিড়ম্বিত কৃষি তীব্র খাদ্যাভাব, অপুষ্টি তথা মন্বন্তর রূপী চরম মানবিক বিপর্যয় সূচিত করে।
শিল্পায়ন-নগরায়নের সৃষ্ট উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন যেমন খাদ্যসংকট ডেকে আনছে, তেমনি উষ্ণায়ন রোধে গৃহীত ও অনুসৃত কিছু ব্যবস্থা খাদ্যসংকটের তীব্রতাকে বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রীণ হাউস গ্যাস সৃষ্টিকারী জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে, জৈব জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু এ জৈব জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা খাদ্যশস্যের উৎপাদনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জৈব জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিøষ্ট তৈলবীজের উৎপাদনে নানারকম উৎসাহমূলক সরকারি ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের সরকারি নীতি জৈব জ্বালানির উৎপাদন বাড়িয়ে শিল্পায়ন-নগরায়ন প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও এর ফলে খাদ্য সংকট আরো প্রকট হওয়ার স্পষ্ট আশঙ্কা বিদ্যমান। বিশেষজ্ঞর অভিমত, জৈব জ্বালানির কাঁচামাল (ফিডস্টক) উৎপাদনের ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট তীব্রতর হচ্ছে। তার কারণ হল, সরকারি ছাড় তথা অধিক অর্থকরী হওয়ায় অনেক কৃষক চিরাচরিত খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছেড়ে তাদের উর্বর জমিতে পাম, জেট্রোফা ইত্যাদি জৈব জ্বালানি তৈরির কাঁচামাল চাষ করছে। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে জমির লভ্যতা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। জৈব জ্বালানি হিসাবে পাম তেলের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে এ তেল ভোজ্যতেল হিসেবে সহজলভ্য হচ্ছে না। তাই বিশেষজ্ঞরা জৈব জ্বালানি বিষয়ে সঠিক নীতি রচনার আবশ্যকতা বোধ করছেন। জৈব জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিঘিœত হলে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র জনবহুল দেশগুলো অধিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। যেহেতু খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি তথা খাদ্য সংকটের জন্য জৈব জ্বালানির উৎপাদনও একটি কারণ, তাই বিশ্বের অন্যতম পাম তেল উৎপাদক দেশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া জৈব জ্বালানি উৎপাদনের বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে পর্যালোচনা করার আবশ্যকতা উপলব্ধি করছে। উর্বর জমিতে জৈব জ্বালানি উৎপাদনের আশু অবসান না ঘটলে আগামী দিনে খাদ্য সংকট আরো ঘণীভূত হবে; সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর এ উদ্বেগের বিষয়টি মোটেই অমূলক নয়।
খাদ্যাভাব এখন সারা বিশ্বে তেমন সংকটজনক রূপ ধারণ না করলেও আগামী দিনে তা যে তীব্রতর হবে তার আভাস ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে অনাবৃষ্টির জন্য কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পক্ষান্তরে বহু এলাকায় প্রবল বন্যা হাজার হাজার হেক্টর চাষের জমি ভাসিয়ে নিচ্ছে। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে মারাত্মক ভাটা পড়ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর খাদ্য সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। এ দেশে ধানের উৎপাদন দিন দিন মারাত্মক হারে হ্রাস পাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশে চাহিদানুপাতে ধানের উৎপাদন কমে গিয়ে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় কুড়ি লক্ষ মেট্রিক টনে পৌঁছেছে, যা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। বাংলাদেশের মতো খাদ্য সংকটের কবলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এবং নেপালও। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতর সূত্রে প্রকাশ, নেপালে খাদ্যাভাব ও অপুষ্টির শিকার এক কোটিরও বেশি মানুষ। খাদ্যশস্য উৎপাদনে নেপালেও দারুণ ভাটার টান পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঐ দেশের কিছু কিছু জেলায় টানা পাঁচ বছর তেমন ফসল উৎপাদন হয়নি। বর্তমানে নেপালের প্রায় নয়টি জেলার কয়েক লক্ষ মানুষ মারাত্মক খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। খাদ্যশস্য উৎপাদনে মন্দাভাবের কারণ নেপাল শাখার অভিমত ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম। আর এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে সে অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টিকে যার কারণ শিল্পায়ন সৃষ্ট উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন। এশিয়ার আরেক দেশ উত্তর কোরিয়ায় ১৯৯৫ সাল থেকে দীর্ঘ বছর ধরে চলতে থাকা খাদ্যের আকাল বিগত কয়েক বছরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের সাম্প্রতিক সমীক্ষা মতে, ঐ দেশের প্রায় অর্ধেক লোক ক্ষুধার্ত রয়েছে এবং জীবনধারণের জন্য তাদের ঘাস ও গাছের পাতা-মূল খেয়ে থাকতে হচ্ছে।
এ তো গেল উন্নয়নশীল দেশের কিছু উদাহরণ। তবে খাদ্য সংকট যে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। সারা বিশ্ব এর দ্বারা প্রভাবিত হবে। আপাত অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি সত্য যে মার্কিন মুলুক দারিদ্র্য ও খাদ্য সংকটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। সম্প্রতি বিশ্বে যে ভয়াবহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও খাদ্যশস্য উৎপাদনে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে তা অব্যাহত থাকলে ধনী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দু’কোটি মানুষ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রভাবিত হতে পারে। প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে এ তথ্য পেশ করেছেন জাতিষংঘের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। সম্মেলনে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য ও খাদ্যাভাবের কালো ছায়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে ঘণীভূত হচ্ছে। কেননা, সেখানে শিল্পের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনের হার অনেক কমানো হয়েছে। অধিকন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপর পড়ছে। ‘শতাব্দীর উন্নয়ন’ শীর্ষক এক আলোচনা চক্রে এ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, উত্তর আমেরিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বেশ ক’টি দেশ এখন চরম দারিদ্র্য ও খাদ্য সংকটের শিকার। তার হাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে তেমন সময় লাগবে না। খাদ্যশস্য উৎপাদন না করে শুধু শিল্পায়ন যে সাধারণ নাগরিকের দারিদ্র্য ও খাদ্যাভাব দূরীকরণে অপারগ, মার্কিন কর্তাদের সত্বর তা উপলব্ধি করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
এটি পরিষ্কার যে শিল্পায়ন, শিল্পায়নসৃষ্ট উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণায়ন রোধে অনুসৃত কিছু ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এ বিশ্বে খাদ্যসংকট তীব্রতর করে তুলছে। তৎসঙ্গে ধনী ও দরিদ্র্যের মধ্যকার আয় ও ক্রয়ক্ষমতার ব্যবধান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্পায়ন ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এ যুগে এক শ্রেণির মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিত্যনতুন উপকরণ উদ্ভাবিত হচ্ছে, অপরদিকে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের অতি মৌলিক ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা অপূরণীয় থেকে যাচ্ছে। শিল্পায়ন ও কৃষিবিকাশ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতার ফলে কৃষি অনেকাংশে উপেক্ষিত। অধিকন্তু পুঁজি-প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিবিকাশ মূলত ধনিক শ্রেণির স্বার্থপূর্তির সহায়ক হচ্ছে। ফলস্বরূপ সাধারণ কৃষক, মজুর তথা সমাজের দুর্বলতর শ্রেণির মানুষের অর্থনৈতিক স্থিতির ক্রমাবনতি ঘটছে। ধনী-দরিদ্রের আয় ও ক্রয়ক্ষমতার বৈষম্য দিন দিন এত প্রসারিত হচ্ছে যে এ দুই শ্রেণির জীবনশৈলীতে অদ্ভুত বৈপরিত্য প্রকট হয়ে উঠছে। দরিদ্র শ্রেণি তার ন্যূনতম খাদ্যের প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে, পক্ষান্তরে ধনিক শ্রেণির আহার তালিকায় বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মানুষের ন্যূনতম খাদ্যের লভ্যতা নিশ্চিতকরণ উন্নয়নের প্রথম লক্ষ্য হওয়া আবশ্যক। সভ্য সমাজে খাদ্যের অধিকার মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃত। সমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষকে অভুক্ত পশ্চাদপদ রেখে স্বল্প সংখ্যক মানুষের ভরপুর স্বাচ্ছন্দ্যে দ্রুত অগ্রগমন প্রকৃত উন্নয়নের দ্যোতক নয়। বর্তমান শতাব্দীর মাঝামাঝি বিশ্বের জনসংখ্যা নয়শ’ কোটিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। খাদ্য সংকটের বিষয়টি এখন গভীরভাবে বিবেচিত না হলে অদূর ভবিষ্যতে অপরিমেয় মানবিক বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না। মানুষের খাদ্যলভ্যতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে যে কৃষিকেন্দ্রিক মানব সভ্যতার গোড়াপত্তন ও ক্রমবিকাশ, সে সভ্যতার স্থায়িত্ব নির্ভরশীল যথাযথ কৃষিবিকাশের উপরই। কৃষিকে উপেক্ষা করে শিল্পায়ন মানব জাতির সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে না, পারবেও না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন