শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

রিযক নির্ধারিত : মৃত্যু অবধারিত

মাওলানা এরফান শাহ্ | প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

\ এক \
জীবন চলার পথে রিযক তথা জীবিকা জীবনের অপরিহার্য উপাদান। জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবিকা ব্যতিত জীবন অসম্পূর্ণ, অচল ও অসম্ভব। কম বেশি সবার প্রয়োজনীয় জীবিকা দরকার। খাদ্য-পানীয়, সহায় সম্বল, অর্থ-কড়ি, সন্তান-সন্ততি ও ধন সম্পদ যা আমরা ভোগ করি, সবই রিযকের অর্ন্তভূক্ত। রিযক আল্লাহপাক নিজ অনুগ্রহে সৃষ্টিজগতকে দান করেন। আল্লাহপাক জন্মের আগে তা আমাদের ভাগ্যে বন্টন করে রেখেছেন। আমরা সর্বদা জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি। ধন-সম্পদ নিয়ে টেনশন করি। অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তায় চিন্তিত থাকি। পরিবার-পরিজন ও ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। টাকা-পয়শার বিষয় সামনে আসলেই ব্যতিক্রম, স্বার্থপর ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। সবসময় ভাবতে থাকি আগামীতে কী করব? কী খাব? কীভাবে চলব? ইত্যাদি, ইত্যাদি। জীবিকা প্রসঙ্গে আল্লাহপাক মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলেন, “পৃথিবীতে চলমান সকল প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি তাদের অবস্থানস্থল ও সংরক্ষণস্থল জানেন। সবকিছুই এক স্পষ্ট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে” -সূরা হুদঃ ৬। অন্যত্র আল্লাহপাক বলেন, “কোন প্রাণীই জানে না, আগামীতে সে কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না, তার মৃত্যু কখন কোথায় হবে” - সূরা লোকমানঃ ৩৪।
আধুনিক ও সভ্য পৃথিবী আজ ব্যস্ত ও অস্থির দু’ জিনিসের পিছনে। এক. রিযক তথা জীবিকার অন্বেষণ। দুই. মওত তথা মৃত্যুর হাত থেকে বাচাঁর প্রাণপণ চেষ্টা। অথচ অবধারিত সত্য হচ্ছে, এ দু’টি বিষয় অনেক আগে থেকে নির্ধারিত ও মীমাংসিত। জীবিকার জন্য মানুষ কত কিছুইনা করছে! চির সত্য হচ্ছে, জীবিকা ভাগ্যে যা লিপিবদ্ধ আছে এর বাইরে অর্জন করতে পারে না। শত সহস্র চেষ্টা করেও রায্যাক কর্তৃক বাজেটের বাইরে যাওয়া কোনো মাখলুকের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রকৌশলীর পরিকল্পনা ও নকশার বাইরে যেভাবে নির্মাণ শ্রমিকদের যাওয়ার সুযোগ নেই, অনুরূপভাবে রব তথা রায্যাকের নকশা ও বন্টনের বাইরেও সৃষ্টিজগতের যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের বরাদ্দের বাইরে কোন এজেন্সি, কর্মকর্তা ও কর্মচারী যেতে পারে না, অনুরূপভাবে মহান রবের বাজেট তথা বরাদ্দের বাইরেও মাখলুক যেতে পারে না। এজন্যই সচরাচর দেখা যায়, একই ব্যবসায় কেউ সফল আবার কেউ ব্যর্থ। একই কর্মে কেউ কৃতকার্য আবার কেউ অকৃতকার্য। সমান পরিশ্রম করে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ পিছিয়ে যাচ্ছে। একই গবেষণায় কেউ সফল আবার কেউ বিফল। একই বাহনে কেউ আহত, কেউ নিহত আবার কেউ জীবিত ও সুস্থ!
জন্ম, জীবিকা, বিবাহ ও মৃত্যু এগুলো মহান রব তথা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি, রহস্য ও নিয়ন্ত্রিত মহিমা! অতএব পরিশ্রম, চেষ্টা ও সাধনার পরও যদি কোনো কিছু অর্জন না হয় তাহলে মনে করতে হবে, রিযক, নসিব তথা ভাগ্যে নেই। এজন্য হতাশ বা চিন্তিত হওয়া উচিত নয়। সর্বাবস্থায় আল্লাহর ফায়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকায় হচ্ছে ঈমানের দাবী। হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেন, “গরীব মু’মিনেরা ধনীদের পাচঁ শত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে”-তিরিমিজিঃ ২৩৫৩। আল্লাহপাক বান্দার জন্য যা ভাল ও মঙ্গল তাই করেন। যদিওবা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের বুঝে আসে না। অন্য হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেন, “আমি জান্নাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশই গরীব লোক। আর জাহান্নামের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার অধিকাংশই মহিলা”-বুখারীঃ ৩২৪১। অতএব কার বরাদ্দ কোথায় রেখেছেন তা আল্লাহই ভাল জানেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,“তোমার রব যাকে চান জীবিকা বাড়িয়ে দেন, আবার সংকুচিত করে দেন। নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের সব খবর রাখেন এবং সবকিছু দেখেন-৩০ঃ১৭।
জীবিকার পেছনে সবাই দৌড়ায়। জীবনের জন্য রিযক অথচ এই রিযকের জন্য অনেকের জীবন পর্যন্ত চলে যায়। সবার রিযক কিন্তু সমান নয়। কেউ হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে লবণ আনতে পান্তা ফুরায়। আবার কেউ উত্তরাকিার সূত্রে পাওয়া সম্পদ বসে বসে খায়। সবাই সমান রিযক উপার্জন করতে পারে না। আল্লাহপাকের হিকমতের দাবীও তাই। কারণ সবার রিযক যদি সমান হয়, সবাই যদি সমান অর্থ-সম্পদের মালিক হয়, তাহলে দুনিয়ার আবাদ ও বিশ্ব পরিচালনা ব্যাহত হবে, পৃথিবী স্থবির হয়ে পড়বে। তাই এর বণ্টন আল্লাহপাক নিজ দায়িত্বে রেখেছেন। তিনি নিজ হিকমত ও প্রজ্ঞানুযায়ী সবার মাঝে তা বণ্টন করেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, “অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ, রিযক তথা জীবিকার সন্ধান করবে-সূরা জুমুআহঃ ১০। উল্লেখ্য, সরকারের বাজেট পাশ হয় সংসদে আর রবের বাজেট পাশ হয় আসমানে। অতএব রিযক বাড়ানোর জন্য আগ্রহী প্রার্থীকে অবশ্যই আসমানে দরখাস্ত করতে হবে। রিযক বৃদ্ধির হাতিয়ার, মহান রবের দরবারে দোয়া ও ইস্তিগফার। সরকারী বাজেট বিভিন্ন এজেন্সি ও সংস্থার মাধ্যমে সরকার জনগণের মাঝে পৌছেঁ দেন। অনুরূপভাবে আল্লাহপাক সৃষ্টিজগতের বাজেট সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর কাছে পৌছাঁন। এ হচ্ছে বিধাতার বিধান। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও এজেন্সি সরকারী বাজেটের মালিক নয় বরং বাহকমাত্র, মালিক হচ্ছে সরকার। অনুরূপভাবে সৃষ্টিজগত হচ্ছে মাধ্যম তথা বাহকমাত্র। রিযক তথা জীবিকার প্রকৃত মালিক হচ্ছে রায্যাক, রব তথা মহান আল্লাহ। হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেন, “সেই ব্যক্তি সফলকাম, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, আর তাকে পরিমিত জীবিকা দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহপাক তাকে যা দিয়েছেন তাতে সে সন্তুষ্ট”-মুসলিমঃ ১০৫৪।
জীবিকা তথা রিযক কোনো সম্মান বা মর্যাদার মাপকাঠি নয়। আবার হতভাগা বা অশুভ লক্ষণের আলামতও নয়। কী অনুগত! কী অবাধ্য! কী মুমিন! কী কাফের! কী ভাল! কী মন্দ! সবাইকে জোয়ার ভাটার ন্যায় প্রাচুর্র্য ও অভাব, সুখ ও দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে। এর মাধ্যমে আল্লাহপাক অবাধ্য ও কাফেরকে অবকাশ দেন আর অনুগত ও মুমিনের পরীক্ষা নেন। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, “যদি আল্লাহর নিকট মাছির ডানার সমান দুনিয়ার মূল্য থাকত, তাহলে তিনি কোনো কাফেরকে এক ঢোক পানিও পান করাতেন না” তিরমিজিঃ ২৩২০। অন্য হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক উম্মতের জন্য ফিতনা রয়েছে, আমার উম্মতের ফিতনা হচ্ছে মাল”-তিরমিজিঃ ২৩৩৬। আরেক হাদিসে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, “ ছাগলের পালে দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছেড়ে দিলে ছাগলের যতটা ক্ষতি করে, দ্বীনের জন্য তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক সম্পদ ও সম্মানের প্রতি লোভ-লালসা” তিরমিজিঃ ২৩৭৬। হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেন, “মুমিনের বিষয়টি আশ্চর্যজনক, তার প্রত্যেকটি বিষয় কল্যাণকর, এটা মুমিন ব্যতীত অন্য কারো ভাগ্যে নেই, যদি তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, আল্লাহর শোকর আদায় করে, এটা তার জন্য কল্যাণকর, আর যদি তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে ধৈর্য ধারণ করে, এটাও তার জন্য কল্যাণকর”- মুসলিমঃ ৫৩২২। প্রাচুর্য ও সচ্ছলতার সময় একজন মুমিন যাকাত-সাদকা প্রদান করে আল্লাহর শোকর আদায় করবে। অভাব ও অসচ্ছলতার সময় ঈমান ও ধৈর্যের পরিচয় দেবে। সুতরাং অভাব ও প্রাচুর্য উভয় মুমিনের জন্য কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক।
মৃত্যু থেকে বাচাঁর জন্য মানুষ এমন কোনো পথ, পদ্ধতি ও কৌশল নেই যা অবলম্বণ করে না। অথচ আজ পর্যন্ত কেউ কী মালাকুল মাওত তথা আজরাইল (আঃ) এর হাত থেকে বাচঁতে পেরেছে? মৃত্যু থেকে বাচাঁর জন্য মানুষ কত চেষ্টাই না করছে! প্রাণপন চেষ্টা করেও রবের নির্ধারিত মৃত্যু থেকে কেউ রেহাই পাইনি এবং পাবেও না। অতএব, চিরসত্য রিযক ও মৃত্যু এ দু’টি বিষয় বান্দার ইচ্ছাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীণ নয়। তা একমাত্র মহান রব তথা প্রতিপালকের হাতে। এটি বিধাতার শাশ্বত বিধান। তারই নিয়ন্ত্রণাধীণ ও ইচ্ছাধীন। আল্লাহপাক জন্মের আগেই জীবিকা নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহপাক জন্মের আগেই আমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করে রেখেছেন। আল্লাহপাক জন্মের আগেই মৃত্যুর সময় ও স্থান অবধারিত করে রেখেছেন। অতএব, যে বিষয়টি হাতের নাগালের বাইরে, নিজ ইচ্ছাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীণ নয়, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা, হতাশা ও অনুশোচনা কখনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।
বুখারী শরীফে ‘আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সত্যবাদী স্বীকৃত রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেকেই আপন মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত শুক্রানু হিসেবে জমাট থাকে। তারপর চল্লিশ দিন রক্তপিন্ড। তারপর চল্লিশ দিন গোশত পিন্ডাকারে থাকে। তারপর আল্লাহপাক একজন ফেরেশতা পাঠান তার জন্য চারটি বিষয় লিখে দেয়ার দেওয়ার জন্য। তার রিযক কী হবে, তার মৃত্যু কবে হবে? সে কী দুর্ভাগা হবে, নাকি সৌভাগ্যবান হবে”- সহিহ বুখারীঃ ৬৫৯৪। ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত, রাসূল(সাঃ) বলেন, “জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলা কিংবা সত্য কথা বলার সময় কারো ভয় পাওয়া উচিত নয়, কারণ এর মাধ্যমে না আয়ু কমে যাবে, না তাকে তার রিযক থেকে দূরে সরিয়ে দিবে”- বায়হাকি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
md kawsar ১ এপ্রিল, ২০১৮, ১০:৩৭ পিএম says : 0
apnader kotha ami gorbito masaallah
Total Reply(0)
মোঃ: মিজানুর রশীদ ৪ এপ্রিল, ২০১৮, ৯:৩১ এএম says : 0
এখানে আপনি বলতে চাইছেন, আল্লাহ তায়ালা আমাদের রিজিক নির্ধারিত করে দিয়েছেন আর এ কারণে আমাদের জিবিকার জন্য বেশি ছুটাছুটি করার দরকার নেই। আমি আজকে আমার দেশ ছেড়ে অনেক দূরে। আল্লাহ তাআলা আমার রিজিক এখানে বরাদ্দ করে রেখেছেন বলেই তো অনেক কষ্ট করে এখানে আসতে হয়েছে তাহলে। এখানে আসার জন্য যে আমাকে অনেক ছুটাছুটি করতে হয়েছে সেটা কি আল্লাহ তায়ালাই আমাকে করান নি।
Total Reply(0)
Kamrul Hassan ৪ এপ্রিল, ২০১৮, ৭:১১ পিএম says : 0
Alhamdhulillah ! Ya Allah Apni Shokoler Rejeker Moddhe Borkot bariye din ! Ameen !
Total Reply(0)
মো: মোকছেদুর রহমান খান ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ১০:৫২ এএম says : 0
আলহামদুলিল্লাহ হে আল্লাহ আমাদের রিযিকের বরকত দান করুন।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন