সউদী আরব বর্তমানে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। দেশটির আধুনিকায়ন ও বিশ্বের কাছে তাকে উন্মুক্ত করে তোলায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন তরুণ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)। সউদী অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের ক্ষমতা কাটছাঁট করতে রিয়াদের পরিকল্পনার মূল ব্যক্তি হিসেবে তাকেই মনে করা হয়।
২০১৭ সালের অক্টোবরে রিয়াদে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের তিনি বলেছিলেন, আমরা আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি- এক মধ্যপন্থী ইসলামের দেশ যা সকল ধর্ম ও বিশে^র জন্য উন্মুক্ত। মধ্যপন্থার পথে সউদী আরবের প্রত্যাবর্তনে তার উচ্চাকাক্সক্ষার ব্যাখ্যায় তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, গত ৩০ বছর যা ঘটেছে তা সউদী আরবের উপযুক্ত নয়। তিনি উগ্রপন্থার দিকে সউদী আরবের মোড় নেয়াার ঘটনার জন্য খোলাখুলি ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব ও তেহরানের মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে দায়ী করেন। তার এ মন্তব্য দু’টি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারা স্বীকার করেছেন যে সউদী আরব যে ইসলামকে অনুসরণ করে তার বাখ্যায় আধুনিকায়নের অভাব আছে, দ্বিতীয়ত, তার কথায় এ মতের প্রতিফলন ঘটেছে যে দেশে বর্তমানে যে ধর্মীয় ব্যবস্থা রয়েছে তা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিঘœ সৃষ্টিকর এবং তরুণ প্রজন্মের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার কথা সত্তে¡ও তার বক্তব্যে সউদী আরবের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির জন্য বিদেশের ঘটনা, বিশেষ করে ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবকে দায়ী করার বিষয়টির প্রতিফলন ঘটেনি। আসলেই কি ইরানি বিপ্লব সউদী আরবকে উগ্র রক্ষণশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল?
১৯৭৯ সালে সউদী আরব
১৯৭৯ সালটি সকল দিক থেকেই সউদী ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ। এ বছর একদল বিদ্রোহী মক্কায় কাবা শরীফ দখল করে। দুর্নীতি ও পাশ্চাত্যের দাসতে¦র কারণে সউদী রাজ পরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। এক বেদুইন ও ন্যাশনাল গার্ডের সাবেক সদস্য জুহায়মান আল-ওতাইবি ২০ নভেম্বর প্রায় ৫শ’ সশস্ত্র ব্যক্তি। কাবা শরীফ অবরোধ করে। লোকটি তার শ্যালক মোহাম্মদ আল কাহতানিকে ইমাম মেহেদী বলে ঘোষণা করে। ১৯৭০ দশকের ঘটনা যদিও সউদী আরবে প্রভাব ফেলে , কিন্তু দেশটি তখনো উগ্র রক্ষণশীল হয়ে ওঠেনি।
দু’সপ্তাহ ব্যাপী কাবা অবরোধের ঘটনায় শ’ শ’ হাজি, বিদ্রোহী যোদ্ধা ও সউদী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হন। এ বছরেরই গোড়ার দিকে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণে কানাঘুুষা ছড়িয়ে পড়ে যে হেরান থেকেই এর নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। পরে এ সন্দেহ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। স্বঘোষিত ইমাম মাহদী মোহাম্মদ আল কাহতানি এবং অবরোধ ঘটনার নেতা আল-ওতাইবি ইরানের ঘটনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হননি। কারণ, তারা শিয়া বিরোধী ছিলেন।
কাবা শরীফ অবরোধের ঘটনা যখন ঘটে সউদী রাজ পরিবার তখন অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন। ৪ বছর আগে বাদশাহ ফয়সাল (শাসনকাল ১৯৬৪-৭৫) নিহত হয়েছিলেন। তিনি সউদী আরবে আধুনিকতার সূচনা করেন। তার সময় দেশে প্রথম টিভি সম্প্রচার শুরু হয়, তিনি আর্থ-সামাজিক সংস্কার বাস্তবায়ন করেন এবং মেয়েদের স্কুলসহ জনশিক্ষার উন্নয়ন ঘটান। নিজ ভাতুষ্পুত্রের হাতে তিনি নিহত হন। অধিকাংশ ধর্মীয় গোষ্ঠি তার আধুনিকায়ন উদ্যোগকে স্বাগত জানায়নি।
কাবা অবরোধের ঘটনা সউদী আরবকে বিরাট ধাক্কা দিয়েছিল। এদিকে ইরানি বিপ্লবী নেতা খোমেইনি এ অবরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে দায়ী করেন। মুসলিম বিশে^র মানুষ তার কথা বিশ্বাস করে ও প্রচন্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় সউদী শাসক পরিবার শংকিত হয়ে ওঠে। দু’টি পবিত্র স্থানের রক্ষক হিসেবে মুসলিম বিশ্বে তাদের কর্তৃত হুমকির সম্মুখীন হয়।
এ সংকটের প্রেক্ষিতে সউদী কর্তৃপক্ষ আধুনিকায়ন উদ্যোগ থেকে সরে আসে ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতাশালী করে। সরকার কঠোর ধর্মীয় বিধি কার্যকর শুরু করার ব্যবস্থা নেয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় দোকান বন্ধ না রাখলে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নারীদের কার্যত জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। সউদী ধর্মীয় পুলিশ মানুষের উপর আরো বেশি করে মনিটরিং শুরু করে।
১৯৭০ দশকের ঘটনা সউদী আরবকে প্রভাবিত করলেও দেশটি তখন উগ্ররক্ষণশীল হয়নি। দেশটির ইসলামের কট্টরপন্থার সাথে সম্পৃক্ততা আসলে আঠারো শতকের ঘটনা যখন সউদী পরিবার এক উগ্ররক্ষণশীল আলেমের সাথে জোট গঠনের চুক্তি করে।
ওয়াহাবিবাদ হচ্ছে সে সময়ে আরবের নজদ অঞ্চলের প্রভাবশালী আলেম ও গোত্র নেতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের (১৭০৩-১৭৯২) প্রচারিত শিক্ষা ও মতবাদ। তিনি ঐক্য নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যা সমকালীন আলেমগণ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মুসলমানদের কুরআন ও হাদিসে প্রত্যাবর্তনের আহবান জানাতে থাকেন। তিনি সূফি আচার ও পীর ভক্তি বাক্তিল ঘোষণা করে বলেন, কুরআনে এসবের অস্তিত¦ নেই। তিনি তার ভাষায় অনৈসলামিক রীতি পালনকারীদের কাফের ঘোষণা ও ইসলামী শারিয়া কঠোর ভাবে মেনে চলার আহবান জানান।
অনেকে আবদুল ওয়াহাবের মতবাদকে নতুন কিছু নয়, বরং হাম্বলি মযহাবের অত্যন্ত উগ্ররক্ষণশীল রূপ বলে মনে করেন। যাহোক, তার ধর্মীয় জজবা শেষ পর্যন্ত তাকে সউদী পরিবারের ঘনিষ্ঠ করে তোলে।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নীতি সউদী তরুণদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক, তবে ক্ষমতার জন্য তাদের ভ‚মিকা গুরুত¦পূর্ণ নয়।
আবদুল ওয়াহাব যখন মক্কা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে তার মতবাদ প্রচারের ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তখন মুহাম্মদ ইবনে সউদ আজকের রিয়াদের উপকন্ঠে আল -দিরিয়া এলাকার শাসক ছিলেন। ১৭৪৪ সালে আবদুল ওয়াহাব মদিনা থেকে পালিয়ে আল দিরিয়ায় আসেন ও ইবনে সউদের কাছে নিরাপত্তা চান। উভয়ে ক্ষমতা ও দায়িত¦ ভাগাভাগি করে একটি জোট গঠনের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সামরিক ও রাজনৈতিক দিক দেখবেন মুহাম্মদ ও ধর্মীয় দিক দেখবেন আবদুল ওয়াহাব। ধর্মীয় বৈধতা পেয়ে মুহাম্মদ ইবনে সউদ আল দিরিয়ার বাইরে তার শাসন সম্প্রসারিত ও প্রথম সউদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।
আবদুল ওয়াহাবের মৃত্যুতে ক্ষমতা ভাগাভাগি এ চুক্তি পালনের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। আবদুল ওয়াহাবের বংশধরগণ (শাইখ পরিবার) সউদী শাসনে ধর্মীয় বিষয়ের দায়িতে¦ ছিলেন ও রয়েছেন। আজ পর্যন্ত উত্তরাধিকারীদের অনুমোদন প্রদান ও বাদশাহর সিদ্ধান্ত অনুমোদনের মাধ্যমে সউদী শাহী পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈধতা প্রদান করছেন তারা। বিনিময়ে শাইখ পরিবার রাষ্ট্র কাঠামোতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকাসহ রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করে চলেছেন।
ওয়াহাব-সউদ চুক্তি ২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে। এখন কি তার শেষ সময় এসে গেছে? শাহী পরিবারের কি এ চুক্তির আর প্রয়োজন নেই?
গত কয়েক বছর ধরে সউদী শাহী কর্তৃপক্ষ ধীরে ধীরে ও সতর্কতার সাথে শাইখ পরিবারের ক্ষমতা কমিয়ে আনছে। উদাহরণ স্বরূপ, ২০১০ সালে বাদশাহ আবুল্লাহ ফরমান জারি করেন যে শুধু রাষ্ট্র অনুমোদিত আলেমরাই ফে ায়া দিতে পারবেন।
বাদশাহ সালমান ও তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানের আমলে তাদের বিরুদ্ধে আরা কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে কমিটি ফর দি প্রমোশন অব ভার্চু অ্যান্ড দি প্রিভেনশন অব ভাইস-এর কাছ থেকে গ্রেফতারের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। বাদশাহ দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় সংস্থা জ্যেষ্ঠ আলেম পরিষদে অধিকতর মধ্যপন্থী আলেমদের নিয়োগ প্রদান করেছেন। ২০১৭ সালে আলেমদের মতামত উপেক্ষা করে মিউজিক কনসার্টের অনুমোদন দয়া হয়েছে, নারী-পুরষ মিশ্রিত অনুষ্ঠানের অনুমতি ও ৩৫ বছর পর সিনেমা প্রদর্শনের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
তবে সউদী ক্ষমতা কাঠামোতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটা এখনো বাকি। দেশের আইন ব্যবস্থা ইসলামী আইনের আওতায় পরিচালিত। আবদুল ওয়াহাবের অনুসৃত ঐতিহ্যবাহী ইসলামের কঠোর শারিয়া আইন সেখানে অনসৃত হচ্ছে। এখন সউদী-ওয়াহাবি চুক্তি ভঙ্গ মানে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের ধারা থেকে সরে যাওয়া।
এখন সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে দেশে সংস্কার বাস্তবায়ন ও দেশটিকে বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করার জন্য ওয়াহাবি শিকড়ের সহায়তা নেয়ার আর দরকার আছে কিনা। উপসাগরীয় দেশগুলোতে সার্বিক ভাবে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের গুরুত¦ হ্রাস পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সউদী আরবও ধীরে ধীরে সেই মডেলই আলিঙ্গন করছে।
আধুনিকায়নের জন্য দেশের ধর্মীয় এলিটদের সাথে বহু দশকের চুক্তিভঙ্গ কারো কারো কাছে দুর্নীতি ও নতুন করে পশ্চিমা প্রভাব আলিঙ্গন বলে আখ্যায়িত হচ্ছে। এমনও হতে পারে যে এমবিএস-র অনুসৃত নীতি বহু সংখ্যক ভিন্নমতের আলেমকে বিদ্রোহী করে তুলতে পারে।
এমবিএস-র নীতি তরুণদের জন্য অনুক‚ল, কিন্তু তারা ক্ষমতার চাবিকাঠির অধিকারী নয়। ক্ষমতাধিকারীরা হচ্ছে রক্ষণশীল শাসনে কয়েক দশক ধরে বাস করা বয়স্ক জনেরা , ক্ষমতা ও সুবিধা বঞ্চিত শাহজাদারা ও সউদী পরিবারকে বৈধতা প্রদানকারী আলেম গোষ্ঠি।
তাদের অনেকেই নিজেদের প্রান্তিকীকৃত বলে উপলব্ধি করছেন যা তাদের উগ্রবাদের দিকে চালিত করতে ও ১৯৭৯ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন