রাজধানীসহ সারাদেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে ধনবৈষম্য। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরীব আরো গরীব। নানা কারণে মানুষ ভূমিহীন, কপর্দকহীন হয়ে পড়ছে। নি:সম্বল-অসহায় মানুষের কায়িক শ্রমে জীবিকা নির্বাহের সুযোগও সীমিত। এমতাবস্থায় ভিক্ষার মতো অসম্মানজনক বৃত্তি অনেকে বেছে নিচ্ছে। ভিক্ষা আসলে স্বীকৃত কোনো বৃত্তি নয়। মানুষের দান ও করুণার ওপর বেছে থাকার একটা চেষ্টা মাত্র। এটি একটি দিক। অন্য দিকটি হলো, ভিক্ষায় তেমন কোনো শ্রমস্বীকার করতে হয়না। অথচ টাকার অংকে দৈনিক প্রাপ্তি কারখানায় শ্রমিক-মজুর, রিকশাওয়ালা-ঠেলাওয়ালার চেয়ে অনেক বেশি। অনেকে তাই ভিক্ষাকেই বেছে নিচ্ছে রুজি-রোজগারের মাধ্যম হিসাবে। ভিক্ষা এখন লাভজনক ব্যবসাও বটে। ভিক্ষক নয়; কিন্তু ভিক্ষুকদের জড়ো করে কিংবা বাধ্য করে তাদের দিয়ে ভিক্ষা করিয়ে লাভবান হচ্ছে অনেকেই। এটা তাদের কাছে ব্যবসা মাত্র। শিশুদের চুরি বা অপহরণ করে, অঙ্গহানি করে তাদের দিয়ে কিছু নরপশু ব্যবসা করে খাচ্ছে, এমন খবরও অতীতে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতিও এমন একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। দারিদ্রই ভিক্ষুক হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। অন্যান্য শক্তিশালী কারণও রয়েছে। ভিক্ষুকের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে দারিদ্র যেমন দায়ী তেমনি ‘লাভজনক বৃত্তি’ ও দুর্বৃত্তদের নিষ্ঠুর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি বা কুকর্মও দায়ী। দেশে ভিক্ষুকদের সংখ্যা কত তার কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। সমাজকল্যাণ অধিদফতরের হিসাবে সারাদেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা সাড়ে সাত লাখ। তার মধ্যে ৫০ হাজারই রয়েছে ঢাকা শহরে। রোজা, ঈদ ও কোরবানীর সময় এ সংখ্যার সঙ্গে আরো ৫০ হাজার মওসুমী ভিক্ষুক যুক্ত হয়। বেসরকারী সংস্থাগুলোর হিসাবে দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা অন্তত ১২ লাখ। ঢাকা শহরে ভিক্ষুকের সংখ্যা সম্পর্কে সমাজকল্যাণ অধিদফতর যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, অনেকের মতে, তার চেয়ে অনেক বেশী ভিক্ষুক এখানে রয়েছে এবং মওসুমী ভিক্ষুকের সংখ্যাও ৫০ হাজারের অনেক বেশী।
রাজধানী শহরকে ভিক্ষুকমুক্ত করার নানা উদ্যোগ এবং কতিপয় এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হলেও ভিক্ষুকের সংখ্যা মোটেই কমেনি; বরং বেড়েছে। সমাজকল্যাণ অধিদফতরের তরফে যে স্বল্প সংখ্যক ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের আওতায় এনে গ্রামে বা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছিল, তা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। পুনর্বাসিত এবং আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কোনোভাবে ছুটে বা পালিয়ে আসা ভিক্ষুকদের অনেকে ফের ভিক্ষায় ফিরে গেছে। ভ্রাম্যমান আদালতের কার্যক্রমও আর এখন দৃশ্যমান নয়। ফলে নিষিদ্ধ এলাকাসহ ঢাকা শহরের সর্বত্র ভিক্ষুকের ভীড়। রেলস্টেশন, এয়ারপোর্ট, লঞ্চ টার্মিনাল, বাস টার্মিনাল থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, মসজিদ, মাজার, শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান, হোটেল, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থানে নারী-পুরুষ-শিশু ভিক্ষুক অবাধে ভিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা আছে যাতে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সে নির্দেশনাও কার্যকর হয়নি। এখনো যত্রতত্র শিশুদের ভিক্ষা করতে দেখা যায়। রাজধানী দেশের প্রধান শহরই নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। দেশের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। সেই শহরে যদি ভিক্ষুকদের অবাধ অবস্থান ও বিচরণ দেখা যায়, তাহলে বিদেশের চোখে সেই সম্মান ও মর্যাদা আর থাকে না। বাংলাদেশ যে দারিদ্র- পীড়িত দেশ এবং এখানকার মানুষের মধ্যে অসহায়, নি:সম্বল ও কর্মহীনদের একটা বড় সংখ্যা রয়েছে, যেখানে সেখানে ভিক্ষুকের উপস্থিত ও সমাবেশ তারই প্রমাণ বলে তারা মনে করতে বাধ্য হয়। এতে জাতীয় আত্মশ্লাঘাবোধ অবনমিত হয়। অত্যন্ত দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ঢাকা শহর বসবাসের অনুপযুক্ত একটি শহরে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ দূষণ, শব্দ দূষণ, রায়ুদূষণ প্রভৃতি দিক দিয়ে বিশ্বে সবচেয়ে নিকৃষ্ট শহর হিসাবে লাগাতার ঢাকা চিহ্নিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায়। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। ক্ষেত্র বিশেষে অবনতি ঘটছে। বস্তির শহর, নোংরা শহর ও যানজটের শহর হিসাবে এর অখ্যাতি তো আছেই। বলা বাহুল্য, ঢাকাকে বাসযোগ্য, সুশৃংখল, সুন্দর, মনোরম, উপদ্রবহীন ও নিরাপদ শহরে পরিণত করতে হলে বিভিন্ন কর্র্তৃপক্ষের নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা ও প্রয়াস যেমন জরুরী তেমনি নাগরিক সাধারণের সচেতনতা ও উদ্যোগও আবশ্যক।
কারো অজানা নেই, এই শহরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বহু ফুট ওভারব্রিজ এবং কোথাও কোথাও আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে। এসব ব্যবহার না করে পথচারিদের ব্যস্ত রাস্তার মাঝ দিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায় এবং এটা নিত্যদিনের সাধারণ চিত্রে পরিণত হয়েছে। এ কারণে মাঝে-মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকেই আহত, এমনকি নিহতও হচ্ছে। নাগরিক সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার অভাবেই যে এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলো ঘটছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কর্তৃপক্ষীয় দায়ও মোটেই কম নয়। নাগরিকদের নির্দেশনা ও আইন মান্য করতে বাধ্য করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে তার যথেষ্ট দায়িত্বহীনতা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাসগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এদের অনেকগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ। আরো একটি দিক এই যে, বিশেষ করে ফুটওভার ব্রিজে হকার, বখাটে ও ভিক্ষুকদের উপদ্রব সব সময় লেগেই থাকে। এ বিষয়টিও দেখার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। ফুট ওভারব্রিজ বানালেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এদের ব্যবহারযোগ্য ও নিরাপদ করাও কর্তৃপক্ষীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ঢাকা শহর একটি বিশৃংখল শহরের নমুনা। একে সুশৃংখল ও গতিশীল এবং সব ধরনের দৌরাত্ম্য ও উপদ্রব মুক্ত করতে হলে সবগুলো কর্তৃপক্ষের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। নাগরিকদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। ঢাকা শহরকে ভিক্ষুকমুক্ত করা কোনো কঠিন কাজ নয়। অথচ ইতোপূর্বে নেয়া কোনো উদ্যোগ-পদক্ষেপই কাজে আসছে না। আমাদের কথা : ভিক্ষুকমুক্ত করার ঘোষণা দেয়াই যথেষ্ট, ঘোষণাকে কঠোরহস্তে কার্যকর করতে হবে। ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। এবং ভিক্ষুক তৈরির পথ বন্ধ করতে হবে। দেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। আগামী ২০২১ সাল নাগাদ তার উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার কথা। সরকারের লক্ষ্য, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের উন্নীত করা। এসব আশার কথা, তবে এখন ঢাকাসহ দেশের যে চিত্র সেটা এই আশাবাদের সাথে যায় না। এদিকে খেয়াল রেখেই ঢাকাকে নিরাপদ বসবাসের উপযোগী, সুশৃংখল, সৌন্দর্যময় শহরে পরিণত করাসহ গোটা দেশকে সুষম উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে আরো কার্যকরযোগ্য উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন