শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আশঙ্কা ও সম্ভাবনার ঘূর্ণিপাকে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কিছু বিপরীত ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে মার্চ মাস শেষ হয়ে গেল। এবার আমাদের স্বাধীনতা ঘোষনার ঐতিহাসিক মাসে বাংলাদেশ স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনের সুসংবাদ পাওয়া গেল। এটি নি:সন্দেহে জাতির জন্য সুসংবাদ। একই সময়ে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের যে কয়টি দেশ গণতন্ত্র থেকে স্বৈরশাসন চলছে তার তালিকায় বাংলাদেশের নামও অন্তভর্’ক্ত হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বের অন্যতম স্বৈরাচারি শাসক হিসেবে তাদের জরিপ রিপোর্ট তুলে ধরেছে আরেকটি বিদেশী গবেষণা সংস্থা। অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাইল ফলক সাফল্য অর্জনের পেছনে দেশের কোটি কোটি কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অবদান রয়েছে। সেই সাথে দেশের শাসকশ্রেনীও এই কৃতিত্বের দাবী করতেই পারেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ৪৭ বছর পেরিয়ে এসে আমরা যখন ব্যাপক কলরবে ক্ষমতাসীনরদের কণ্ঠে বারংবার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা শুনছি , তখন মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্র, সাম্য ও স্বাধীনতার স্পিরিট থেকে বিচ্যুত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের তকমা জুটছে আমাদের সরকারের উপর! সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এ ধরনের জরিপ রিপোর্ট ও ঘোষণাকে বাংলাদেশ বিরোধি ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে বিরোধি দল বিএনপি ও তার জোটের তরফ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব ও গণতন্ত্র বিরোধি অবস্থানের দাবী তোলা হয়েছে। সেই সাথে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর একতরফা ও ভোটারবিহিন নির্বাচনের পর থেকে পশ্চিমা দুনিয়া বার বার তাদের অবস্থানের জানান দিয়েছে। তারা বিএনপির মত বড় দলের সাথে একটি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে দেশে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার উপর জোর দিচ্ছে। বিগত নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন-জাপানসহ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগি ও বাণিজ্যিক অংশিদারদের প্রায় সবাই একযোগেই একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের আহŸান জানিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনীহা, আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অনাগ্রহ, দেশের বেশীরভাগ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ভোটার ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার বাস্তবতা থেকেই সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আঁচ করা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলা হলেও নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের উপযোগি সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ গহনে আওয়ামীলীগ ও মহাজোট সরকারের অনিচ্ছা ও ব্যর্থতা অনেকটাই স্পষ্ট। বিগত নির্বাচনের সময় আলোচনা সাপেক্ষে স্বল্প সময়ের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলা হলেও পরবর্তিতে তা অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এমনকি সংসদের বাইরে থাকা বিরোধিদল বিএনপিও কখনো জোর দিয়ে মধ্যবর্তি নির্বাচনের দাবী তোলেনি। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহনের ঘোষনা দিয়ে একটি ন্যুনতম গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের অনুকুল যে ধরনের পরিবেশ ও নিশ্চয়তা থাকা দরকার, বিরোধি রাজনৈতিক দলগুলো সে দাবী থেকে সরে যায়নি।
বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্নে পর্দার অন্তরালে প্রায় সারা দুনিয়া একমত হওয়ার পরও ভারতের একরৈখিক ভ‚মিকার কারণেদশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা সম্ভব হয়নি। এমনকি একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে রাজি বা বাধ্য করতে ভারতীয় ক‚টনীতিকদের বেশ ‘দৌড়-ঝাঁপ’ করতে দেখা গেছে। একপাক্ষিক নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে এরশাদের অনড়(আত্মহত্যার হুমকি) ভ‚মিকায় ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের ঢাকা সফর, এরশাদের রহস্যজনক অসুস্থ্যতা এবং মিলিটারি হাসপাতালে বসে মনোনয়ন পত্রে স্বাক্ষর করার মত ঘটনাগুলো দেশব্যাপী এখনো রাজনৈতিক স্যাটায়ার হিসেবে স্মরনীয় হয়ে আছে। এবারো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এক এগারো সরকারের সময় দায়ের করা দুর্নীতি মামলায় তড়িঘড়ি খালেদা জিয়ার রায় ঘোষণার পর থেকে এখন নানাবিধ জুডিসিয়াল গোলক ধাঁধা দেখা যাচ্ছে। রায়ের পর কারাগারে নেয়ার দেড়মাস পর উচ্চ আদালতে আপীল শুনানী শেষে খালেদা জিয়ার জামিনের আদেশ দেয়া হলেও গত একমাসেও তিনি বের হতে পারেননি। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে অনেক ব্যক্তি প্রকাশ্য বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ালেও দুদকের মামলার ইতিহাসে সম্ভবত খালেদা জিয়াই প্রথম ব্যক্তি যার সাজা বৃদ্ধির আবেদন করা হয়েছে। গত সপ্তাহে খালেদা জিয়ার জামিন নিস্পত্তির দিন ধার্য থাকার তারিখে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে হাজির করেনি। হাজির না করার কারণ হিসেবে তার অসুস্থ্যতা এবং আদালতে নেয়ার অনুপযুক্ততার কথা বলা হয়েছে। আদালতে হাজির না করার কারণ কর্তৃপক্ষের তরফে ব্যাখ্যা করার আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার অসুস্থ্যতা সম্পর্কে কেউ কিছুই জানতে পারেনি। সঙ্গত কারণেই বিএনপির নেতাকর্মী এবং জিয়া পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য ও প্রকৃত অবস্থা নিয়ে কিছুটা উদ্ভিঘœ হয়ে পড়েছেন। নেত্রীর খোঁজ খবর নিতে এবং সকলের উৎকণ্ঠা নিরসনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েও উপরি মহলের হস্তক্ষেপে নেত্রীর সাথে দেখা করতে পারেননি। এরপর তিনি সংবাদ সম্মেলন করে চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সুচিকিৎসার প্রয়োজনে তার নি:শর্ত মুক্তি দাবী করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি প্রয়োজনে নেত্রীর চিতিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন। তবে মির্জা ফখরুলের সেই বক্তব্য নিয়ে কিছু গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশিত হতে দেখা গেছে। বিএনপি চেয়ারপারসনকে জেলে নেয়ার পর কিছু গণমাধ্যমের ডিসটর্টেড নিউজ সমাজে ও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। আমাদের গণমাধ্যমগুলোর সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যৎকিঞ্চিত ধারনা ও অভিজ্ঞতা থাকায় তাদের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারনা মানুষের বিশ্বাস ও সাধারণ আস্থায় চির ধরাতে পারেনা। সম্ভবত এ কারণেই বিএনপি’র মত রাজনৈতিক দলের ঐক্য ও অখন্ডতা এখনো অটুট আছে। খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার পর থেকেই সরকারীদল ও জোটের কিছু নেতা বিএনপি ভেঙ্গে যাচ্ছে, বিএনপি নেতারা আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টিতে যোগ দিচ্ছে- এমন প্রচারনা চালানোর পর একজন বিএনপি নেতাকেও দলত্যাগ দূরের কথা, ভিন্ন সুরে কথা বলতেও শোনা যায়নি। বরং দলের দুর্দিনে তাদের মধ্যে অভাবনীয় ঐক্য ও সংহতিপূর্ণ অবস্থান দেখা যাচ্ছে। দেশকে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন এবং আগামী দিনে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলতে জনসমর্থনপুষ্ট সরকারীদল এবং শক্তিশালী ও গণমুখী বিরোধিদলের অস্তিত্ব অটুট থাকা প্রয়োজন। উন্নয়ন ও জনসমর্থনের রাজনৈতিক রশি টানাটানির ফলাফল শেষ পর্যন্ত যদি একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে পর্যবসিত না হয়, তাতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্খনীতি ও সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রথম শর্ত হচ্ছে, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে দলনিরপেক্ষ করা এবং সব দলকে জনগনের রায়ের উপর আস্থা রাখা।
এশিয়ায় এবং তৃতীয়বিশ্বে বেশ কিছু রাষ্ট্র আছে যারা দারিদ্র্য জয় করে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল এবং উন্নত রাষ্ট্রে উত্তীর্ণ হয়েছে। অনেক রাষ্ট্রেরই জাতীয় বিপর্যয়, যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এসব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতীয় ঐক্য, গণসংহতি ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের রূপরেখা সামনে রেখে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। আমরা সম্ভবত বিরল ব্যতিক্রম। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি কোটি মানুষের স্বপ্ন পুরণের লক্ষ্যে। অথচ স্বাধীনতার পক্ষবিপক্ষের উদ্ভট তত্ত¡ হাজির করে জাতিকে আরো দুর্বল ও বিভক্ত করে তুলছি কেন? আমরা স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছর পরও দারিদ্র্য জয় করতে পারিনি। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, শোষন ও বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বুকে ধারণ করেই এদেশের মানুষ একাত্তুরে জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। সাড়ে চার দশক পর স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধি অপরাধে জড়িতদের বিচারের একমাত্র কারণ হতে পারে অতীতের ক্ষত মুছে ফেলা এবং এ সম্পর্কিত বিতর্ক বিভক্তি দূর করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। এ ধরনের বাস্তবতায় বিশ্বের বহুদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কনসেনশাসের মাধ্যমে রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করে শান্তির সময়ে যুদ্ধকালীণ বৈরিতা দূর করার উদাহরণ আছে। কিন্তু আমাদের দেশে একটি বিপরীতমুখী প্রবণতা এখনো সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। বিভক্তি ও নির্মূলের রাজনীতি দেশকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে। দেশে শাসনব্যবস্থার মান , জননিরাপত্তা, পুঁজিবাজার, ব্যাংকিং সেক্টর, আর্থিক খাত, বিনিয়োগ, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, বাণিজ্য ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো বিচার বিশ্লেষণ করলে একটি হতাশাজনক চিত্রই বেরিয়ে আসে। তথ্য প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে ব্যাপক সম্পৃক্ততার সুবাদে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে সমকালীণ বৈশ্বিক বাস্তবতার নিরীখে সবকিছু বিচারের আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেও এক তরফা রাজনৈতিক প্রচারনায় নতুন প্রজন্মের মধ্যেও মতাদর্শিক বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই সাথে একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা সামনে রেখে আমরা উন্নয়নশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি এবং স্বাধীনতার সবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতির কথা বলছি। আর মাত্র দুই বছর পর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব। এ সময়ের মধ্যে আমরা হয়তো স্বাধীনতার লক্ষ্য ও প্রত্যাশার সবকিছুই অর্জন করতে পারবনা। তবে এ সময়ের আগেই দেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে নাগরিক সমাজের বিভক্তি, উদ্বেগ, সংশয় ও সংক্ষোভ দূর করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কার্যকর রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের আন্তর্জাতিক চাপ ও ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা আমাদের নেই। মহা সমারোহে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষ পালনে নেতৃত্ব দেয়ার গৌরবজনক ভ’মিকা পালনের সুতীব্র ইচ্ছা আওয়ামীলী নেতৃত্বের থাকতেই পারে। তবে স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতার জন্মশত বার্ষিকীর সময়টা যেন কোন বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের দ্বারা কলঙ্কিত হয়ে স্বৈরাচারী শাসনের বদনাম না হয় সে দিকে নজর দেয়া ক্ষমতাসীনদের জন্য আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অনাস্থার সংকটে পড়েছে। দেশের চলমান বাস্তবতায় সে সংকট আগামীতে আরো ঘনীভ‚ত হওয়ার আশংকা বেড়ে চলেছে। আর মাত্র আটমাসের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার টাইমলাইন স্পষ্ট করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা আরো আগে থেকেই আগামী নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশের প্রায় প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এবং বিভিন্ন জেলায় সরকারী খরচে বড় বড় সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে, সেখানে তিনি উপস্থিত লাখো জনতাকে নৌকায় ভোট দিতে হাত তুলে অঙ্গিকার করাচ্ছেন। তবে যে সব কারণে বিগত সংসদ নির্বাচন দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং জনগণ বর্জন করেছিল সে বাস্তবতা এখনো বিদ্যমান থাকলেও তা’ দূর করার কোন রাজনৈতিক উদ্যোগ বা সরকারের সদিচ্ছার লক্ষ্যণ দেখা যাচ্ছেনা। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বরাবরের মত এখনো সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। সংবিধানে সংসদ বহাল রেখে, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রেখেই নির্বাচন করার বিধান বলবৎ করা হয়েছে। আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটসহ সমমনা দলগুলো শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষনায় এখনো অনড় রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আটকে দেয়া এবং কারারুদ্ধ রাখার প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার নতুন ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারাগারে যাওয়ার আগে যে কোন পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নির্দেশ দিয়ে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার সাজার রায় ঘোষণা, বিচারিক আদালত থেকে হাইকোর্টে নথি প্রেরণ থেকে শুরু করে জামিন আটকে দেয়ার সময়ও দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হাজার হাজার নেতাকর্মীর স্বতস্ফুর্ত উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবে মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূটি থেকে দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের গ্রেফতার করতে ডিবি পুলিশের ফিল্মী স্টাইলের অভিযানে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের এমন ভ‚মিকাকে উস্কানীমূলক বলে মনে করেছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়া তাদেরকে ফাঁদে পা না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, পুলিশের বাড়াবাড়ি সহ্য করেও তারা এটা মেনে চলছে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের এটা একটা বড় উদাহরণ। দুই কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়ার মধ্য দিয়ে কেউ কেউ জোর গলায় বলতে পারেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু যখন দেখা যায় শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি ও আত্মাসাতের মামলার আসামীরা সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও লুটপাটে দৃশ্যমান অভিযোগের আঙুল যাদের দিকে তাদের অনেককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদও করছেনা। তখন লর্ড এ্যাক্টন এবং জর্জ অরওয়েলের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা মনে পড়ে যায়: ‘লর্ড এ্যাক্টন বলেছিলেন, পাওয়ার করাপ্টস, অ্যাবসুলিট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসুলেটলি।’ আর জর্জ অরওয়েলের রাজনৈতিক স্যাটায়ার উপন্যাস এনিমেল ফার্ম’র বিখ্যাত উদ্ধৃতি “অল এনিমেলস আর ইকুয়াল, বাট সাম এনিমেলস আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদারস”- এখন আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাদের কল্পচিত্র হুবুহু মিলে যাচ্ছে। এনিমেল ফার্ম উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণ তৎকালীন রাশিয়ার সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার রূপক হিসেবে তুলে আনা হলেও বর্তমান পুঁজিবাদি রাষ্ট্রব্যবস্থায় এনিমেল ফার্মের সাজুয্য খুঁজে পাওয়া যায়। উন্নয়নশীল প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলোর জনগনের ভাগ্য নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদি চক্র বিপজ্জনক খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। আমাদের জনগন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐক্য গড়ে না উঠলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সব সম্ভাবনা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জালে বন্দি হয়ে পড়তে পারে। কথিত উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বা ক্ষমতার রাজনীতির চেয়ে এই আশঙ্কা থেকে জাতিকে মুক্ত রাখার কার্যকর রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণই এই মুহূর্তে দেশের মানুষের মূল প্রত্যাশা। জনগণের এ প্রত্যাশা বাস্তবায়নের উপরই আগামীদিনের সব সম্ভাবনার গতিপথ নির্ধারিত হবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
chamak tara ৪ এপ্রিল, ২০১৮, ৪:৪৪ এএম says : 0
Allah e jane ai desher kopale ki ase
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন