সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মতভেদ ও মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য-৪

মুফতি মো. আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
ইমাম আহম্দ ইবন হাম্বল (র) ও ইমাম শাফেয়ী (র) ঃ
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) এর ছেলে আব্দুল্লাহ (র) একদা জিজ্ঞাসা করলেন, আব্বাজান ! শাফেয়ী (র) কে? আমি দেখছি আপনি তাঁর জন্য অনেক দু’আ করে থাকেন। তিনি জবাবে বললেন, বৎস! শাফেয়ী এর প্রতি মহান আল্লাহর অনেক রহমত বর্ষিত হোক! তিনি এ জগতের জন্য আলোকবর্তিকা এবং মানুষের জন্য কল্যাণ-বরকতস্বরূপ ছিলেন। এ দু’টি বস্তুর বিকল্প তাঁর অনুরূপ আর কেউ হতে পারে?
মুহাদ্দিস ইয়াহ্ইয়া ইবন মুঈন (র) তাঁর এক সাক্ষাতে ইমাম আহমদ (র) এর পুত্র সালেহকে বললেন, আপনার পিতার তেমন লজ্জাবোধ পেলাম না। কারণ আমি তাঁকে দেখতে পেলাম, শাফেয়ী (র) বাহনে উপবিষ্ট আর তিনি তাঁর বাহনের লাগাম ধরে পায়ে হেটে চলছেন। বিষয়টি ইমাম আহমদ (র)- কে অবহিত করা হলে তিন বললেন, “ইয়াহইয়া ইবন মুঈনের সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ ঘটলে বলে দিবে, আমার আব্বাজানের বক্তব্য হচ্ছে, কারও কাছ থেকে ফিক্হ বিদ্যা শিক্ষা করতে হলে একদিকে তাঁর দরবারে যেতে হয় অন্যদিকে তাঁর সেবাও করতে হয়।” (আল-ইন্তেক্বা’)
ইমাম আহমদ (র) বলেন, আমাকে যখন এমন কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় যা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট হাদীস আমার কাছে অজ্ঞাত, তখন আমি বলে দেই, “ ইমাম শাফেয়ী (র) বিষয়টি সম্পর্কে এমনটি বলে থাকেন”। কেননা, তিনি কুরাইশ বংশীয় ইমাম ও আলেম ছিলেন।” (আদাবুশ শাফেয়ী: পৃ-৮৬। )
দাঊদ ইবন আলী ইসফাহানী (র) বলেন, আমি ইসহাক ইবন রাহ্ওয়ে (র)- কে বলতে শুনেছি, একবার মক্কা শরীফে ইমাম আহমদ (র) এর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটলো। তিনি বললেন, আসুন ! আমি আপনাকে এমন এক মনীষীকে দেখাবো যার অনুরূপ কাউকে আপনার দেখার সৌভাগ্য ঘটেনি। অতঃপর তিনি ইমাম শাফেয়ী (র)- কে দেখালেন।
অন্যদিকে ইমাম শাফেয়ী (র)-ও ইমাম আহমদ (র) এর মর্যাদা ও জ্ঞান-বিদ্যার খ্যাতির স্বীকারোক্তি প্রদান করতেন। একদা তিনি ইমাম আহমদ (র)- কে সম্বোধন করে বললেন, “ তোমরা হাদীস ও রিজাল শাস্ত্রে আমার চেয়েও বেশী জ্ঞান সম্পন্ন। যখন কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া যায় তা আমাকে বলে দেবে ! হোক তা ক‚ফা শহরবাসী বা বসরা শহরবাসী বা সিরিয়াবাসী কারও সূত্রেই। সহীহ হাদীস যা ই পাওয়া যাক তা আমি গ্রহণ করে নেব।”
ইমাম শাফেয়ী (র) যখন ইমাম আহমদ (র) এর কাছ থেকে কোনো হাদীস বয়ান করতেন তখন সম্মানার্থে তাঁর নাম উল্লেখ না করে এভাবে বলতেন (“আমাদের বন্ধু/সঙ্গীদের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হাদীসটি বয়ান করেছেন) “হাদ্দাছানা-ছেকাতু-মিন আসহাবিনা”
(“একজন প্রামান্য ব্যক্তি তা আমাদের অবগত করেছেন”।) “আম্বাআনাছ-ছেকাতু”Ñ,
(“একজন মজবুত ব্যক্তি আমাদের সংবাদ দিয়েছেন।”) “আখবারানাছ-ছেকাতু”। ( মানাকিবে ইমাম আহমদঃ ইবনে জওযী ঃ পৃ-১৬৬)
ইমাম আবূ হানীফা (র) সম্পর্কে ফিকহ ও হাদীস বিশেষজ্ঞগণের অভিমত
ইমাম শা’বী (র) হাদীস শাস্ত্রে ‘আমীরুল-মুমিনীন’ উপাধিতে পরিচিত ছিলেন; কিন্তু তিনি ইমাম আবূ হানীফা (র)-কে অত্যধিক সম্মান প্রদর্শন করতেন। তাঁর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের আসন বিষয়ে প্রশংসা করে বেড়াতেন। তিনি যখন ইমাম আবূ হানীফার ইন্তেকালের সংবাদ শুনলেন তখন বললেন, “তাঁর সঙ্গে তাঁর বিশাল জ্ঞান ভান্ডারও কুফা নগরী থেকে বিদায় নিয়ে গেল! মহান আল্লাহ তাঁকে ও আমাদেরকে নিজ করুণার চাদরে আবৃত করে দিন!”
জনৈক ব্যক্তি মুহাদ্দিস ইয়াহ্ইয়া ইবন সাঈদ আল-কাত্তান (র)-কে ইমাম আ’যম (র) সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম! তাঁর কাছ থেকে আমরা অনেক উত্তম বিষয়াদি গ্রহণ করতাম।”
ইমাম আবূ হানীফা (র) এর গুণগান বিষয়ে বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক (র) এর অনেক বর্ণনা বিদ্যমান। একদা জনৈক ব্যক্তি ইমাম আবূ হানীফা (র)সম্পর্কে কিছুটা ব্যতিক্রমী উক্তি করতে চেয়েছিল। তাৎক্ষণিক তিনি বললেন, সাবধান! তুমি ইমাম আবূ হানীফা (র)-কে দেখলে তখন বুঝবে তিনি কত উঁচু মানের বুদ্ধিজীবী ও গ্রহণযোগ্য মনীষী!”
ইমাম শাফেয়ী (র) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন ইমাম মালেক (র) উসমান (র) সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে বললেন, তিনি একজন ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তি। তারপর ইবনে শুবরুমা (র) সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, তিনিও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তি। অতঃপর ইমাম আবূ হানীফা (র) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, “তিনি যুক্তি-বুদ্ধি প্রশ্নে এমন অসাধারণ মনীষী ছিলেন যে, তিনি যদি মসজিদের এ স্তম্ভগুলো স্বর্ণের বা কাঠের বলে প্রমাণ করতে চাইতেন তাহলে তুমি তাই বাস্তব বলে ধরে নিতে বাধ্য হবে।”-এ থেকে ইমাম আ’জম (র) এর মেধা, জ্ঞান ও বিচক্ষণতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইমাম শাফেয়ী (র) কর্তৃক বর্ণিত এই উক্তি যে, “সারা জগতের মানুষ ইমাম আবূ হানীফা (র) এর ‘ফিকহ জ্ঞানের’ কাছে ঋণী”। ( আল-ইনতেক্বা:পৃ.১৩৬)
ফজল ইবন মূসা সীনাঈ (র)- কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যারা ইমাম আবূ হানীফা (র) এর সমালোচনা করে তাদের ব্যাপারে আপনার কি অভিমত? তিনি জবাবে বললেন, “ যে সব জ্ঞান-বিদ্যা সম্পর্কে এ লোকগুলো অজ্ঞ ও অপরিচিত ছিল, ইমাম আবূ হানীফা (র) তাঁর সবগুলো গবেষণা করে পরিবেশন করে দিয়েছেন এবং এদের জন্য কিছুই বাদ রেখে যাননি। যে-কারণে এরা হয়তো না-জানার কারণে অথবা হিংসাদ্বেষের কারণে তাঁর সমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছে।”
মোট কথা চার মাযহাবের ইমামগণ অথবা অপরাপর গবেষক পর্যায়ের মনীষীবৃন্দের মাঝে জ্ঞান-গবেষণার প্রয়োজনে মতভেদ বা মতবিরোধ থাকলেও তাঁরা পরস্পরের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আন্তরিক মহব্বত, ভালোবাসা প্রশ্নে এক অসাধারণ নজীর রেখে গেছেন। যা থেকে আমরা এ যুগের ছোটখাটো আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির ও গবেষকগণ বঞ্চিত। তাঁরা একে-অন্যের প্রতি সুধারণা পোষণ করতেন; একে অপরের যোগ্যতা-অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করতেন: দলাদলি ও হিংসা- দ্বেষপূর্ণ সমালোচনা হতে দূরে থাকতেন এবং জাগতিক স্বার্থের পরিবর্তে আল্লাহ তা’আলাকে সন্তুুষ্টির লক্ষ্যে সময় ব্যয় করতেন। প্রশ্নকারীর উত্তরদানে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সতর্কপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে “জানি না”-বলেই তাঁরা সন্তুষ্ট থাকতেন এবং নাম-ডাক ও খ্যাতিকে ভয় পেতেন। তাঁদের এমন আদবপূর্ণ শিষ্টাচার প্রকাশ পাওয়ার কারণ হচ্ছে, তাঁদের মাঝে প্রবৃত্তির অনুসরণ ও অহমিকা বোধের পরিবর্তে বিনয় ও ন¤্রতার প্রাধান্য ছিল। আর এসব উঁচু মানের আদব ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীই তাদের পূঁজি ছিল ; যা দ্বারা ঐতিহাসিক গ্রন্থাদি পরিপূর্ণ।
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পরবর্তী অবস্থা
হিজরী চতুর্থ শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতির উল্লেখ করে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী (র) লিখেনঃ
“খোলাফায়ে রাশেদাগণ একদিকে সমকালীন শাসকও ছিলেন, পাশাপাশি নবী-প্রতিনিধি বিশেষজ্ঞ আলেম ছিলেন। সার্বিক পরিস্থিতি তৃতীয় শতাব্দী পেরিয়ে সম্মুখপানে এগুতে থাকলো তখন রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ এমনসব লোকদের হস্তগত হলো যারা জাগতিক বিষয়াদিতে অবশ্য অভিজ্ঞ ছিলেন কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান-বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না। যে-কারণে শাসকগোষ্ঠির বিচার-ফায়সালা ও ধর্মীয় বিষয়াদি প্রশ্নে আলেম বিচারকদের সহযোগিতা গ্রহণ ব্যতীত বিকল্প ছিল না। তখন জনগণ মনভরে প্রত্যক্ষ করলো, কিভাবে ধর্মবিশেষজ্ঞ আলেম বিচারকগণের সম্মান, মর্যাদা প্রদান করা হচ্ছিল! এমতাবস্থায় কিছুলোক জাগতিক সম্মান-মর্যাদা অর্জনের মানসে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনকারী হয়ে গেল। ফাতওয়া ও ইফতার জ্ঞান অর্জন করে মুফতী পদে আসীন করার জন্য নিজেকে পেশ করতে শুরু করলো। তাঁদের মাঝে কিছু সংখ্যক তা থেকে বঞ্চিত থাকলো এবং কিছুসংখ্যক নিজ মন্দ উদ্দেশ্যে সফল হলো। এরা সরকারের কাছে মাথানত করে নিজেরা হেয় প্রতিপন্নের কাতারে উপনীত হলো। ইতোপূর্বে এঁদেরকে তালাশ করা হতো আর এখন এরা নিজেরা তালাশে জড়িয়ে পড়লো। প্রথমে এঁরা শাসক আমীর থেকে দূরে অবস্থান করে সসম্মানে ছিলেন এখন নিজেরা শাসকদের নৈকট্য অর্জন করে অপমান-অমর্যাদা সহ্য করতে লাগলেন। তবে হ্যাঁ কিছুসংখ্যক আলেমগণ ব্যতিক্রম ছিলেন যাঁদের মহান আল্লাহ তেমন সংশ্রব থেকে রক্ষা করেছেন।” (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন