\ এক \
আমি সেদিন হাসপাতালের বেডে শয্যাশায়ী। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আমার উত্তরার বাসা থেকে কেউ আমাকে, এই নব্বই বছরের বুড়োকে দেখতে যেতে পারেনি, কারণ তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমায় সমবেত জনতার একটা বিরাট অংশ বিমান বন্দর অবরোধ মানসে ময়মনসিং রোড দখল করে রেখেছিল ছয় সাত ঘন্টা, দিল্লি থেকে আসা একজন বড় মাপের তবলিগ নেতাকে বিমান বন্দরে আটকাতে। হাসপাতাল কক্ষে টেলিভিশনে কিছুটা দেখলাম, আর পরদিন খবরের কাগজে পড়লাম বিস্তারিত। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা অভিমুখে আসা যানবাহনে হাজার হাজার মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছে কখন আবার যাত্র শুরু হবে সেই আশায়, আর ক্ষুধা তৃষ্ণা সহ্য করেছে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারেনি। শিশুরা মাতৃ ক্রোড়ে মলমুত্র ত্যাগ করেছে। কত লোকের কত রকমের বিড়ম্বনা!
ঘেরাও-কারীদের মধ্যে তবলিগ জামাতের এক অংশের কিছু নেতৃস্থানীয় লোকও নাকি ছিলেন। তা’রা কি অনুভব করতে পারেননি তাদের কর্মকান্ডের পরিণাম কতটা ভয়ানক হতে পারে ? দিল্লি থেকে আসা যে নেতা কে অবাঞ্চিত ঘোষনা করা হয়েছিল তিনি নাকি আগের বছরের বয়ানে এমন কি একটা বলেছিলেন যা বয়কট কারীদের মনঃপুত হয়নি। তাই বলে এমন কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকান্ড ? ইসলামের কোন কোন বিষয়ের ব্যাখ্যায় মতভেদ হয়ে আসছে শত শত বছর ব্যাপী, আর এমন কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকান্ডও হয়ত হয়েছে কখনো কখনো।
মালয়শিয়ার বিখ্যাত নেতা, অনেক দিনের প্রধান মন্ত্রী, জনাব মহাথির মোহাম্মদ ১৯শে জুলাই ২০০২ইংরেজী তারিখে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী ফোরামে দেয়া এক ভাষণে বলেছিলেন মুসলমান ধর্মান্ধরা কিভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে সাধারণ মুসলমানদের বিপথগামী করছে। তিনি বলেছিলেন (ক) মসজিদে বিদ্যুতের বাতি জ্বলতনা, আলেমরা বলতেন তা হারাম। (খ) ইঞ্জিন চালিত গাড়ী ব্যবহারও হারাম মনে করা হত, আর কোন লাশ এসব গাড়ীতে বহন করা হতনা। (গ) বেশী দিন হয়নি মালয়শিয়ার কিছু আলেম টেলিভিশনকে হারাম ঘোষনা করেন, যার ফলে অনেকেই তাদের টিভি সেট নদীতে বিসর্জন দেয়। (ঘ) ইসলামের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের নির্দেশকে অমান্য করে এক মুসলমান জনগোষ্ঠি অন্য জনগোষ্ঠীকে হত্যা করছে।ইসলামের দোহাই দিয়ে, কাফের আখ্যা দিয়ে এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে শত্রু ভাবছে। এক ধরণের কট্টরপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গিই যদি সঠিক বিবেচনা করা হয় তাহলে দুনিয়ার কেউই মুসলিম আখ্যায়িত হতে পারবেনা। (ঙ) আমাদের এখন এ ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে যে আমাদের শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞান অর্জনে অবহেলা করে আমরা যান্ত্রিক উৎপাদনে, গবেষণায়, অস্ত্রশস্ত্রের উদ্ভাবন ও উৎপাদনে পিছিয়ে পড়েছি। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া অন্য শিক্ষায় আখেরাতে কোন উপকার নেই সে ধারণা আমাদের ভূল।
শ্রদ্ধেয় মোহাথির মোহাম্মদ অনেক কিছুই বলেছিলেন আন্তর্জাতিক ইসলামী ফোরামে দেয়া তাঁর সেই ভাষণে, যার থেকে বেছে বেছে কিছু কথা উপরে উল্লেখ করেছি। তাঁর পুরো ভাষণটার আমার কৃত বাংলা অনুবাদ দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়েছিল ৩ অক্টোবর, ২০০২ সালে। তিনি যে বলেছেন ‘ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া অন্য শিক্ষায় আখেরাতে কোন উপকার নেই ধারণাটা ভূল’, তা’কি তবলিগ জামাতের ‘ইজতেমা’য় আগতরা, এমনকি আহ্বায়করা আলোচনা করেন ?
ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় আর জ্ঞানীগণ তা করেন। তবে ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’ বলে একটা কথা আছেনা ? যত গন্ডগোলের সৃষ্টি হয় এই আল্প-বিদ্যাওয়ালাদের ব্যাখ্যায়। কালের বিবর্তনেও মতভেদ দেখা দেয়। তবে ইসলামে বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে একটা বড় প্রতিরক্ষা আছে আর তা হল আল্লাহ তায়ালা তাঁর দেয়া সেই কোরআন শরীফের সংরক্ষনের দায়িত্বে রয়েছেন (সুরা: হিজ্র, আয়াত ৯), যে কোরআনে ইসলামের অধিকাংশ মূলনীতি লিপিবদ্ধ আছে, আর তাই বিকৃতির সুযোগ কম রয়েছে।
ইসলাম অবতীর্ণ হওয়ার আগে পৃথিবীতে অনেক ধর্ম এসেছে। হয়ত হিন্দুদের ধর্মটাই প্রচীনতম, আর তাই কালের ব্যবধানে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে, আচরণে বিভেধ অনেক, অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন পূজায় তারতম্য দেখে তা অনুভূত হয়। তাদের বেদ, পুরাণে আল্লাহ ও হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর উল্লেখ আছে বলে কোন কোন হিন্দু লেখক তথ্য প্রমাণ দিয়ে লিখেছেন, যেমন ডঃ বেদ প্রকাশ উপাধ্যায়। আর মরহুম আবুল হোসেন ভট্টাচার্য তাঁর ‘আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম’ গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন আমাদের আল্লাহ, রসুলের নাম হিন্দুদের ‘উপনিষৎ’ ধর্মগ্রন্থে রয়েছে। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) যে আল্লাহ্র সর্বশেষ দূত তাও উল্লেখিত হয়েছে বেদ, উপনিষদে।
খৃষ্টানদের ধর্ম ইসলামের ঠিক আগের, ছয় শতকেরও কম বছর ব্যবধানের। কিন্তুু তাদের প্রথম ‘বিশ্ব ইজতেমা’য়, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তুরষ্কের ইজনিক শহরে ৩২৫ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ১,৭০০ বছর আগে, তাদের ধর্মগ্রন্থ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, এমন এক সিদ্ধান্ত নেয়া হল যা ইসলামের দৃষ্টিতে চরম ভ্রান্ত। খৃষ্টানদের যিশুখৃষ্ট আর আমাদের ঈসা আলাইহিস সালাম একই ব্যক্তি আর তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছিল, আমাদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনে এ বর্ণিত ‘ঈঞ্জিল’ নামের কিতাব। সেই ঈঞ্জিল না পেয়ে খৃষ্টানরা তাদের ‘ইজতেমায়’ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে হিব্রু ভাষায় বিভিন্ন ব্যাক্তির লিখিত যিশুখৃষ্টের সব ভাষণ থেকে শুধু মাত্র মার্ক, মেথিউ, লিউক্ আর জন্ লিখিত সব ভাষণ রেখে বাকিগুলো বিলুপ্ত করে দিতে। এই চারটা আলাদা আলাদা ‘গসপেল’ নিয়েই সংকলিত হল তাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল। এই যে চারজনের লিখিত ভাষণগুলো গৃহিত হল, তা’রা কিন্তুু কেউই ঈসা (আঃ) এর কালের লোক নন, অনেক পরের, অন্যের কাছে শোনা কথা থেকে রচিত তাদের ‘গসপেল’ সমূহ। (মরহুম আহমদ দীদাত তাঁর Is The Bible God’s Word’ বইতে দেখিয়েছেন তাদের একজনের লেখার সঙ্গে অন্য জনের লেখায় কতযে বেমিল রয়েছে)। আমার একটা বই আছে, বিখ্যাত প্রকাশকPENGUIN BOOKS এর প্রকাশিত THE FOUR GOSPELS. এই বইয়ের Introduction অনুচ্ছেদে এক যায়গায় আছে: Mathew and Luke have included in their Gospels a great deal of material derived from Mark. অন্যত্র: St. Mark’s Gospel is thought to have been written about AD 65 (that is 65 years after the death of Jesus Christ). Luke এর Gospel সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছেঃ He certainly borrows wholesale from Mark, also apparently from Mathew, but in such a way and with so many curious changes. এদের চারজনের গসপেল সম্বলিত এই ‘বাইবেল’ থেকেই নাকি খৃষ্টানদের Trinity বা ত্রিত্ববাদ অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের মধ্যে পিতা, পুত্র আর পরমাত্মার মিলন’ ধারণার উৎপত্তি হয়েছে।
একটা পরিত্যাজ্য গসপেল কিন্তুু বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়েছিল, আর তা হচ্ছে ‘দি গসপেল অফ বার্নাবাস (The Gospel of Barnabas)। এই বার্ণাবাস ছিলেন যিশুখৃষ্টের (ঈসা আলাইহিস সালামের) সঙ্গে অবিরত থাকা লোক , ইসলামী ভাষায় তাঁর সাহাবী। অনেক কাল পরে তাঁর রচিত এই ‘গসপেলটি’ আবিষ্কৃত হয় আর এই গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ The Gospel of Barnabas প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যের Oxford University Press ১৯০৭ সনে। অনেক চেষ্টায় বর্তমান লেখক গ্রন্থটির ফটোকপি সংগ্রহ করেন বিলেত থেকে এর প্রকাশকের মাধ্যমে। তা বাঁধাই করে দান করে দেয়া হয় ঢাকাস্থ এশিয়াটিক সোসাইটিতে, আর এরই একটি ফটো কপি বাঁধাই করে নিজের জন্য রাখা হয়েছিল। তাও পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরীতে দান করে দেওয়া হয়।(কেউ যদি তথায় গিয়ে তা পড়তে আগ্রহীহন তাই এই লেখা)। অবশ্য ‘বার্ণাবাসের বাইবেল’ নামে নাকি বইটির বাংলা অনুবাদ ও প্রকাশিত হয়েছে।
তাবলিগ অর্থাৎ প্রচার ছিল বলেই ইসলাম আজ দিগন্ত বিস্তিৃত। বলা হচ্ছে মুসলিমরাই নিকট ভবিষ্যতে হবে পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী। হযরত শাহজালাল, শাহ মখদুমরা কত কষ্টই না করেছেন এদেশে এসে ইসলাম প্রচার করতে। হযরত শাহজালাল সাত আটশ বছর আগে যখন দশ-বারোজন সঙ্গী নিয়ে আরব দেশ থেকে রওয়ানা হন, তখন কত সমস্যা বিজড়িত ছিল তাঁদের যাত্রাপথ। তা সত্তেও কতযে তবলিগ-আগ্রহী তাঁদের সঙ্গ নিয়েছিলেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তা বুঝা যায় শেষ পর্যন্ত তাঁরা তিনশ’ ষাট জনের এক বিরাট দলে পরিণত হয়েছিলেন। সিলেট আর সিলেট সংলগ্ন অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে পড়া সেই আউলিয়াগণ ইসলাম প্রচারে এতই সফল কাম হন যে আজ বাংলাদেশের সতের কোটি জন সংখ্যার পনের কোটিই মুসলমান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন