শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মুসলমান হওয়ার কারণেই কি সালমান খানের শাস্তি?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দেশটি তার রাষ্ট্রীয় চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে। অথচ বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখবেন বলে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তার এ কথায় দেশটির দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীও আশ্বস্ত হয়ে তাকে সমর্থন দিয়েছিল। ভারতীয় মুসলমানরা বরাবরই কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে থাকে। তবে এর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে নরেন্দ্র মোদির কথায় আশ্বস্থ হয়ে তারা বিজেপিকে বিপুলভাবে ভোট দেয়। তারা বিশ্বাস করেছিল, বিজেপি মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। মুসলমানদের এ বিশ্বাস এবং ধারণা ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। বিজেপি ও তার সমর্থনপুষ্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস মুসলমানদের বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান নেয়। যে মুসলমানরা বিপুলভাবে সমর্থন দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছিল, সেই বিজেপি ও আরএসএস দ্বারাই তারা হত্যা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতে শুরু করে। গরুর গোশত ফ্রিজে রাখার মতো ঠুনকো অজুহাতে পিটিয়ে মুসলমান মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটায়। তাদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে পশুর জীবন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তারা এতটাই উগ্র হয়ে উঠে যে, মুসলমানদের জোর করে হিন্দু ধর্মে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালায়। আরএসএস-এর এসব উগ্রবাদী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন বিজেপি ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, বরং নীরব ভূমিকা পালন করে আরও উস্কে দেয়। ভারতের মানুষ ‘মহান ভারত’ বলে যে গর্ববোধ করে তার চরিত্র বদলে ক্ষমতাসীন বিজেপি দেশটিকে উগ্র হিন্দুত্ববাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বহু ধর্ম ও বর্ণের ভারতকে অভিহিত করা শুরু করে এক ধর্মের ‘হিন্দুস্তান’ বলে। এ ধরনের মনোভাবের মধ্যে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠে, বিজেপি চায় ভারতে কেবল হিন্দুরাই বসবাস করবে। অন্য কোনো ধর্মের মানুষ বসবাস করতে পারবে না। যেহেতু হিন্দুদের পর মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই পুরোপুরি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে মুসলমানরাই প্রথম প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। ফলে মুসলমান নিধন এবং বিতাড়নে সে মনোযোগী হয়ে উঠে। আমরা যদি আসামের দিকে তাকাই তবে দেখা যাবে, সেখানে প্রায় ৫০ লাখ নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রশ্ন তোলা হয়েছে যারা একই সঙ্গে বাংলাভাষী মুসলমান। আসলে বিজেপি নাগরিত্বেরর ধোঁয়া তুলে প্রকারন্তরে আসামকে মুসলমানমুক্ত করতে চাইছে। আসামে বিজেপির জয়ে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে মুসলমানরাই। এতে এটাই প্রমাণিত হয়, যে মুসলমানরা বিজেপিকে ক্ষমতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সেই মুসলমানদের পিঠেই ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তার মদদপুষ্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ছুরি বসাতে দ্বিধা করছে না।
দুই.
কয়লা ধুলেও যে ময়লা যায় না, তা ক্ষমতায় আসার পর বিজেপির চরিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সে যে উগ্র হিন্দুত্ববাদ ধারণ করে এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী নয়, বরং ভারতকে একটি পরিপূর্ণ হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, তা বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে নজির স্থাপন করেছে। তাই ক্ষমতায় এসে প্রথমেই টার্গেট করেছে মুসলমানদের। দলটির সমর্থনপুষ্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মুসলমানদের উপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গত সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে মসজিদের ইমাম মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদীর ছেলেকে আরএসএস নৃশংসভাবে খুন করে। হিন্দুদের একটি মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে রাশিদীর ছেলে সিরাতুল্লাহ রাশিদীকে হত্যা করে। এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এর অনেক আগে থেকেই আরএসএস মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষ এবং নির্মূলীকরণ কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে। প্রতি পদে পদে মুসলমানদের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। মুসলমানদের স্বাভাবিক ধর্ম-কর্মে বাধ সাধছে। মাইকে আজান দেয়া যাবে না, গরু কোরবানি দেয়া যাবে না-এমন অনেক ধর্মীয় আচার-আচরণে বাধা প্রদান করছে। মুসলমানরাই যে আরএসএস ও বিজেপির প্রধান টার্গেট অতীতে তাদের ভয়ংকর কর্মকান্ড তার সাক্ষ্য বহন করছে। ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, বিজেপি ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো মুসলমানদের প্রতি কী পৈশাচিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। ঐ দাঙ্গায় ইন্ধন এবং তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুজরাটের তৎকালীণ মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। তদন্ত কমিটি তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পেয়েছিল। যদিও ২০১২ সালে বিশেষ তদন্ত টিম তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। তবে সর্বজন মত ছিল, এই দাঙ্গায় মোদি সরাসরি উস্কানি দিয়েছিলেন। গুজরাটের গোধরায় একটি ট্রেনে আগুন লাগা এবং তাতে ৫৮ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে এ দাঙ্গা লেগেছিল। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো অভিযোগ করে বসে ট্রেনটিতে নাকি মুসলমানরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। গুজরাটের স্থানীয় পত্র-পত্রিকাগুলোও মুসলমানরা এ কাজ করেছে বলে বানোয়াট ও অসত্য সংবাদ পরিবেশন করতে শুরু করে। মুসলমানরা হিন্দুদের অপহরণ ও ধর্ষণ করছে বলে উল্লেখ করা হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তখন মুসলমানদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা কেন্দ্রের ঠিকানা ও অবস্থান লিফলেট আকারে ছড়িয়ে দেয়। এসব লিফলেট তৎকালীন গুজরাটের প্রশাসন থেকেই উগ্র হিন্দুদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়। আরএসএস, বজরঙ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা গেরুয়া পোশাক পরে ট্রাকে চড়ে সরবরাহকৃত ঠিকানা অনুযায়ী মুসলমানদের হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার উল্লাসে মেতে উঠে। আড়াইশর মতো নারীকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, নারীদের উলঙ্গ করে প্যারেড করানো হয়, গর্ভবতী মায়ের পেট কেটে বাচ্চা বের করে পিষে মারা হয়, শিশুদের জোর করে পেট্রল খাইয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, অসংখ্য মুসলমানের গলা কেটে, দেহ থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে, পেট চিরে পুড়িয়ে মারা হয়। সেখানের গুলবার্গ সোসাইটির এহসান জাফরি নামে এক ব্যক্তি উগ্রবাদী হিন্দুদের কাছে অনুনয়-বিনয় করে তার পরিবারের লোকজনদের বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছিলেন। হিন্দুরা তার আকুতি তো শোনেইনি উল্টো তাকে উলঙ্গ করে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে আসে এবং তাকে ‘জয় শ্রী রাম’ বলার জন্য আদেশ দেয়। তিনি তা না করায় শিরচ্ছেদ করে দেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। তার বাড়ি জ্বালিয়ে পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মারা হয়। উগ্র হিন্দুরা প্রায় দেড় হাজার মুসলমান হত্যা করে। ২৩০টি মসজিদ এবং ২৭৪টি দরগা ধ্বংস করে দেয়া হয়। মুসলমানদের ১ লাখ বাড়ি-ঘর, ১১০০ হোটেল, ১৫০০ ব্যবসা কেন্দ্র ও ৫ হাজার গাড়ি ধ্বংস করা হয়। উগ্রবাদী হিন্দুদের এমন বর্বরতা ইতিহাসে নজিরবিহীন। এসবই হয়েছিল গুজরাটে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় এবং যার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এ ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট নরেন্দ্র মোদিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দাঙ্গার পরও উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচÐ বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিতে থাকে। শিবসেনা নেতা বালথেকারে বলেন, মুসলমানরা ভারতের জন্য ক্যান্সার। ক্যান্সার অনিরাময়যোগ্য। এটা কেবলমাত্র থামানো যায় অপারেশনের মাধ্যমে। তিনি হিন্দুদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ও হিন্দুরা, অস্ত্র হাতে তুলে নাও এবং তোমার মূল থেকে এ ক্যান্সার নির্মূল করো। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আর্ন্তজাতিক প্রেসিডেন্ট প্রভিন টোগাদিয়া বলেন, হিন্দুদের প্রতিপক্ষ প্রত্যেককেই মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তৎকালীণ প্রেসিডেন্ট অশোক সিঙ্গাল বলেন, গুজরাটের দাঙ্গা সফল হয়েছে, যা আগামীতে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হবে।
তিন.
ভারতে মুসলমানদের অবস্থা কি এবং তারা উগ্র হিন্দুদের দ্বারা কীভাবে প্রতিনিয়ত খুন, নিপীড়ন, নির্যাতন, নির্মূলীকরণ এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে, তা উপরের একটি দাঙ্গার চিত্র থেকেই স্পষ্ট হয়। এ ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে মুসলমান বিদ্বেষী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর মুসলমানদের অবস্থা দিন দিন করুণ থেকে করুণতর অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তার রোষ এবং বিদ্বেষ থেকে সাধারণ মুসলমানরা তো বটেই, বলিউডে রাজত্ব করা তিন ‘খান’- আমির খান, সালমান খান ও শাহরুখ খানরাও রেহাই পাচ্ছেন না। অর্থাৎ বিজেপে ও তার মদদপুষ্ট উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলো এখন বলিউডকেও মুসলমানমুক্ত করার মিশন নিয়ে নেমেছে। ২০ বছর আগে ১৯৯৮ সালে রাজস্থানে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ নামে একটি সিনেমার শূটিং করতে গিয়েছিলেন সালমান খান। সেখানে তিনি নাকি দুটি বিরল প্রজাতির কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা করেছিলেন। এ অভিযোগে তখন তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। আর গত বৃহস্পতিবার যোধপুর আদালত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে তাকে পাঁচ বছরের সাজা ও ১০ হাজার রুপি জরিমানা করে। যদিও সালমানের আইনজীবীরা বলেছেন, ভুয়া সাক্ষী ও যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই সালমানকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। গত শনিবার জামিন হওয়ার আগ পর্যন্ত সালমানকে জেল খাটতে হয়। এ নিয়ে সালমান ভক্তদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। বলিউডে তার শুভাকাক্সক্ষীসহ বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার শোয়েব আখতারসহ অন্যরা সালমানের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। আবার যারা সচেতন এবং বিশ্লেষক, তারা সালমানের এ শাস্তি নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন। তারা বলছেন, সালমান মুসলমান বলেই তার বিরুদ্ধে ভুয়া সাক্ষী উপস্থাপন করে সাজা দেয়া হয়েছে। যেখানে উগ্র হিন্দুরা গরুর গোশত রাখার মতো অতি তুচ্ছ কারণে মুসলমান হত্যা করছে, মিছিল করতে গিয়ে মুসলমান শিক্ষার্থীকে টেনে হত্যা করছে, দাঙ্গা বাঁধিয়ে শত শত মুসলমান হত্যা করছে, এমনকি গুজরাট দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদির প্রত্যক্ষ ইন্ধন থাকা সত্তে¡ও তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়, সেখানে সামান্য হরিণ হত্যার দায়ে একজন সুপারস্টারকে জেল-জরিমানা দেয়া হলো কোন যুক্তিতে। তিনি মুসলমান বলেই কি এ শাস্তি দেয়া হয়েছে? ভারতে মুসলমানের জীবনের চেয়েও কি পশুর জীবন অধিক মূল্যবান? পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এ ধরনের মানসিকতা ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুদের মনুষত্বহীনতারই বহিঃপ্রকাশ। অথচ এই সালমান খান ভারতে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নিজ দায়িত্ববোধ থেকে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘বিইয়িং হিউম্যান’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এ সংগঠন থেকে সকল ধর্মের মানুষ সহায়তা পাচ্ছে। সালমান স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমি কখনো জিজ্ঞেস করি না, তুমি কে বা কি, তুমি কোন গোত্র থেকে এসেছ। আমরা প্রত্যেকে এক ছাদের নিচে বসবাস করছি। আমাদের পরিচয় আমরা ভারতীয়। এখানে ভেদাভেদ নেই।’ এমন মানসিকতার একজন সুপারস্টারকে যখন কথিত হরিণ হত্যার অভিযোগে সাজা দেয়া হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার ভক্ত এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে। সালমানের মহানুভবতার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। বেশ কয়েক বছর আগে সিনেমার শূটিংয়ে সালমান প্রত্যন্ত একটি গ্রামাঞ্চলে গিয়েছিলেন। গ্রামের এক কিশোর ভক্ত প্রতিদিন বহু দূর থেকে হেঁটে তার শূটিং দেখতে আসে। এ খবর পেয়ে সালমান তাকে একটি সাইকেল কিনে দেন। কিশোর এই সাইকেল তার গ্রামে নিয়ে দেখায়। পরদিন পুরো গ্রামের কিশোররা সালমানের শূটিং স্পটে এসে হাজির হয়। সালমান প্রত্যেককে সাইকেল কিনে দেন। সালমান তার এ বদান্যতার খবর গোপন রাখতে চাইলেও পারেননি। অথচ ভারত জুড়ে সালমান তার সংগঠন বিইয়িং হিউম্যান-এর মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়ালেও তার এ মানবিকতাকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা আমলে নিচ্ছে না, এমনকি আদালতও বিবেচনায় নেয়নি। তাকে যেভাবে সাজা দেয়া হয় তাতে এটাই প্রতীয়মাণ হয়, সে যতটা না অপরাধ করেছে, তার চেয়ে বড় অপরাধ করেছে মুসলমান হয়ে। ক্ষমতাসীন বিজেপির রোষের শিকার শুধু সালমানই নন, আমির খান এবং শাহরুখ খানও হয়েছেন। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরপরই বলিউডে খানদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু করে। বিজেপি এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেত্রী সাদভী প্রাচি আমির খান, সালমান খান ও শাহরুখ খানকে বয়কট করার জন্য সবাইকে আহŸান জানান। তিনি বলেন, তিন খানের অভিনীত সিনেমা নাকি সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে এবং তরুণদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করছে। প্রাচি উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আহŸান জানান, তিন খানের সিনেমার পোস্টার ছিঁড়ে জ্বালিয়ে দিতে। তার এ কথায় সাড়া দিয়ে উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলো শাহরুখ খানকে ‘পাকিস্তানি এজেন্ট’ হিসেবে মন্তব্য করেছে। অন্যদিকে উগ্রবাদী হিন্দুদের বিরোধিতার কারণে ভারতের পর্যটন শ্লোগান ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র প্রচারণার সাথে আমির খানকে যুক্ত করা হয়নি। এসব ঘটনায় প্রতীয়মাণ হচ্ছে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাধারণ মুসলমানদের ওপর যেমন নিপীড়ন-নির্যাতন নেমে এসেছে, তেমনি বলিউডের তিন মুসলমান কান্ডারি এবং যারা ভারতকে হাজার হাজার কোটি রুপি যোগান দেন, তাদের সরিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তবে সালমান খানের সাজা নিয়ে ইতোমধ্যে বলিউডে তার সহশিল্পী এবং নির্মাতারা তার প্রতি সহানুভূতি ও ভালবাসার প্রকাশ করেছেন। পরিচালক সুভাষ ঘাই তাঁর এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, আমি খবরটা শুনেই খুবই বিস্মিত হয়েছি, তবে ভারতের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমার স¤পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এখনো চ‚ড়ান্ত বিচারের দরজা খোলা রয়েছে। সালমান আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে পছন্দের মানুষ এবং তার মধ্যে মানবীয় গুণাবলী রয়েছে। বলিউড অভিনেতা রাজ কুন্দ্রা ক্ষোভ প্রকাশ করে তার টুইটে জানিয়েছেন, ভারতীয় আইন জরাজীর্ণ এবং পুরনো হয়ে গেছে। এটা পরিবর্তন করা উচিত। যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে মামলা ঠুকতে পারে। মানুষ এক আদালত থেকে অন্য আদালতে ঘুরতে থাকে। সালমান এই বিচার পাওয়ার যোগ্য নয়। বলিউডের প্রবীণ অভিনেত্রী সিমি গারওয়াল বলেন, সালমানের মতো একজন নিখাদ পশুপ্রেমীর পক্ষে পশুহত্যা করা কখনোই সম্ভব নয়। ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের লোকেরা সবটাই জানেন, কিন্তু তারা কেউ মুখ খুলছেন না। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, যিনি বন্দুকের ট্রিগার চালাননি, তিনি কীভাবে হরিণ হত্যা করতে পারেন?
চার.
ভারত অসাম্প্রদায়িক-এ কথা এখন পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। যে দেশে ক্ষমতাসীন দল সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করে, সে দেশ কোনোভাবেই অসাম্প্রদায়িক হতে পারে না। বলা যায়, বিজেপি ক্ষমতায় এসে ভারতের কাগজে-কলমে থাকা ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়েছে। দেশটিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দাপট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের উস্কে দেয়া হচ্ছে। তাদের মূল টার্গেট হয়ে উঠেছে মুসলমান জনগোষ্ঠী। যতভাবে পারা যায় মুসলমান নিধন এবং নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রকাশ্য মিশন চালানো হচ্ছে। সেখানে মুসলমানদের নাগরিক অধিকার খুবই ক্ষীণ। বলা বাহুল্য, নানা ছুতা ও অজুহাতে উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠণকে মুসলমানদের ওপর লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। নির্বিচারে মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভারতকে অখন্ড রাখা নরেন্দ্র মোদির জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ভবিষ্যতদ্বাণী করেছেন, অদূর ভবিষ্যতে ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশে পরিণত হতে পারে। মোদি এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই হিন্দুত্ববাদের জিকির তুলেছেন। তার ধারণা, একমাত্র হিন্দুত্ববাদকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমেই ভারতের অখন্ডতা রক্ষা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানরাই বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের নির্মূল বা বিতাড়ন করতে না পারলে ভারতকে একটি পরিপূর্ণ হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং এর অখন্ডতা রক্ষা করা যাবে না। এজন্য উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলোকে মুসলমান নিধন-নির্যাতনে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং মুসলমানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের জোর করে হিন্দু বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, যে দেশে মানুষের জীবনের চেয়ে পশুর জীবন বড় হয়ে ওঠে, সে দেশকে কোনোভাবেই সভ্য বলা যায় না।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মাহামুদুল আহসান (হাবিব) ১৫ এপ্রিল, ২০১৮, ১:৪৭ পিএম says : 0
এভাবে আমরা চুপ করে থাকলে চলবে না।মুসলিমদের ঐক্যবদ্দ প্রতিরোধ করতে হবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন