মনসুর আলী, আদমদীঘি (বগুড়া) থেকে
বাংলার ইতিহাসের স্মরণীয় এক নাম রাণী ভবানী। রাণী ভবানীর জন্মস্থান ছাতিয়ান গ্রাম। ছাতিয়ান গ্রামের প্রাচীন নাম ছিল মহনগঞ্জ। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা থেকে ৫কিলোমিটার পশ্চিমে ছাতিয়ান গ্রামে এই রাণী ভবানী জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান জমিদার বাড়িটি এখন সুধুই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন ভেঙে পড়ে রাণী ভবানীর এই জন্মস্থানের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। দখল হয়ে যাচ্ছে জমিদার বাড়িসহ আশেপাশের জমি। রাণী ভবানীর জীবনের তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ান গ্রামে ছিলেন এক জমিদার। নাম তার আত্মারাম চৌধুরী, স্ত্রীর নাম তমাদেবি চৌধুরী রাণী। একজন রাজা জমিদারের যা যা থাকার কথা সব কিছুই ছিল জমিদার আত্মারাম চৌধুরীর। কিšুÍ দীর্ঘদিন রাণী তমাদেবির সন্তান না হওয়ায় জমিদার পরিবার দুঃখ-বেদনা অনুভব করতেন। এক পর্যায়ে তমাদেবির স্বামী আত্মারাম চৌধুরীর বাড়ির পার্শ্বে সিদ্ধশ্বরী মন্দিরে সন্তানের বাসনা নিয়ে প্রতিদিন সিদ্ধিতে বসতেন। দীর্ঘদিন ধ্যানে বসার এক পর্যায়ে স্ত্রী তমাদেবি চৌধুরী রাণী কন্যা সন্তান প্রসব করেন। সেই কন্যা সন্তানের নাম রাখা হয় ভবানী। সেই সময় খুশিতে জমিদার আত্মারাম চৌধুরী এলাকার বহু গরিব-দুঃখী মানুষকে জমি দান করেন। দিন দিন বড় হতে থাকে ভবানী। ভবানী ছোট বেলা থেকে পূজা-অর্চনা করতো এবং মানুষের সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। নারীরা সাধারণত বিয়ের পূর্বে কৃতিত্ব অর্জন করতে পারে না, কিšুÍ এক্ষেত্রে ভবানী ছিলেন এক ব্যতিক্রম নারী। ভবানী ছোট বেলা থেকেই ছাতিয়ান গ্রামের গরিব-দুঃখী মানুষের কষ্ট নিবারণ করতেন। এবাদত বন্দেগী করার জন্য মসজিদ, মন্দিরসহ পড়ালেখার জন্য এলাকায় স্কুল নির্মাণ করার ব্যবস্থা করেন। সেই সময় মানুষের পানির অভাব মিটাতে এলাকায় ৩৬৫টি পুকুর খনন করেছিলেন এবং সেই পুকুরগুলোর সাথে তার স্মৃতি জড়িত রাখতে প্রতিদিন একটি করে পুকুরে গোসল করতেন। যেভাবে ভবানীর বিয়ে হয়ে রাণী হলেন। ভবানীর পিতা আত্মারাম চৌধুরী নাটোরের জমিদার রামাকান্তের চেয়ে ক্ষুদ্র জমিদার ছিলেন। রামাকান্তের মতো এক বিরাট জমিদার যে কিভাবে ছোট জমিদার আত্মারাম চৌধুরীর কন্যাকে বিয়ে করলেন। সে সর্ম্পকে ছাতিয়ান গ্রাম এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানান, সে সময় ছাতিয়ান গ্রামে ছিল অনেক বন-জঙ্গল। সেই বনে বাঘ, হরিণসহ প্রভৃতি প্রাণী ছিল। সেইসব বন-জঙ্গলে একদিন নাটোরের জমিদার রামাকান্ত ছাতিয়ান গ্রামের বন-জঙ্গলে শিকার করতে এসে এলাকায় টা¤ু^ টাঙ্গান। সে সময় একদিন ভোরে টাম্বু থেকে শিকারে বের হয়ে দেখতে পেলেন একটি ফুট ফুটে সুন্দরী মেয়ে ফুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে গাছ থেকে ফুল তুলছে। রাজা মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মেয়েটি আত্মারাম চৌধুরীর একমাত্র কন্যা। নাম তার ভবানী। রাজা রামাকান্ত তখন শিকার না করে নাটোরে ফিরে যান এবং মেয়েটিকে বিয়ে করার কথা পিতা রামজীবনকে জানান। রামজীবন ছেলের কথা শুনে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নিজেই আত্মারাম চৌধুরীর জমিদার বাড়িতে আসেন এবং বিয়ের মতামত জনতে চাইলে ভবানী কয়েকটি শর্তে বিয়েতে রাজী হন। প্রথম শর্ত ছিল বিয়ের পর তিনি পিতার বাড়িতে এক বছর অবস্থান করবেন, দ্বিতীয় শর্ত ছিল ছাতিয়ান গ্রাম জমিদার বাড়ি থেকে নাটোর জমিদার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করে পুরো রাস্তা লাল শালু কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দিতে হবে, যার উপর দিয়ে তিনি স্বামীর বাড়িতে যাবেন। তৃতীয় শর্ত ছিল এলাকার গরিব-দুঃখী প্রজাদের ভূমি দান করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রাজা রামজীবন সকল শর্ত মেনে নিয়ে ভবানীর পিতা জমিদার আত্মারাম চৌধুরীকে নাটোর থেকে ছাতিয়ান গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করতে বললেন এবং রাস্তা তৈরি হলেই বিয়ের দিন ধার্য করা হবে বলে বাড়িতে ফিরে যান। এক পর্যায়ে ভবানীর পিতা ছাতিয়ান গ্রাম থেকে নাটোর পর্যন্ত একটি কাল্পনিক রাস্তা তৈরি করতে যে ব্যক্তিদের জমির প্রয়োজন হয় তাদের শরণাপন্ন হলে কেউ পয়সার বিনিময়ে কেউ বা বিনা মূল্য জমি দিয়ে দিলে ছাতিয়ান গ্রামের জমিদার তার বাড়ি থেকে নাটোর পর্যন্ত লাল শালুর কাপড় বিছিয়ে রাস্তা তৈরি সম্পন্ন পর ভবানীকে বিয়ে করে নাটোর রাজপ্রাসাদে নিয়ে যায়। আর সেই থেকে ভবানী হলো রাণী ভবানী। রাণীর শেষ জীবনে তখকার নাটোর রাজ্যের অধীন ভূমির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার বর্গ মাইলেরও অধিক। মোট ১৩৯ পরগনার ১৭৪১৯৮৭ টাকা নবাব সরকারের রাজস্ব ধার্য ছিল। ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামাকান্ত ১৮ বৎসর বয়সে স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করেন। তার সময়ে ১৬৪ পরগনা নাটোর রাজ্যের অধিকারভুক্ত হয়। ১৭৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামাকান্ত রাণী ভবানী ও তার একমাত্র কন্যা তারাকে রেখে ৩২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। এরপর নাটোর রাজ্যভার রাণী ভবানীর উপর পড়ে। পরবর্তীতে রাণী ভবানী রঘুনাথ লাহরীর সাথে তারার বিয়ে দেন এবং রাণী ভবানী তার জামাতার হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে নবাব সরকার জামাতার নামে জারি করেছিলেন। কিন্তু ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে সেই প্রিয় জামাতার মৃত্যু হওয়ায় আবার তাকে রাজ্যভার গ্রহণ করতে হয় এবং একমাত্র কন্যা তারা বাল্য বিদবা হয়ে তার সাথে বাস করতেন। দত্তক পিতা রামাকৃঞ্চ রায়ের ঔদাসীন্য হলে তার সম্পত্তি নিলাম হয়ে যায়। রাণী ভবানী বিশাল জমিদারীর মালিক হয়েও সাধারণ বিধবার বেশে থাকতেন। সেই রাণী ভবানীর জন্মস্থান ছাতিয়ান গ্রামের জমিদার বাড়িটি এখন সুধুই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো এই জমিদার বাড়ি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মানুষ এসে ভিড় জমায়। সরকারি উদ্যোগে জমিদার বাড়িটি সংস্কার করা হলে একদিকে ধ্বংস ও দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা হবে। অন্যদিকে বদলাবে এই জমিদার বাড়ির এলাকার পরিবেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন