সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সেবা দেখল, লনের চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে রাজেন। ওকে দেখতে পেয়েই ডাকল
ঃ শোন-। ঘাড় ফেরালো সেবা। মরাল গ্রীবা ভঙ্গি। রাজেন সোজা দাঁড়িয়ে বলল-
ঃ অনেকক্ষণ থেকে বসে আছে। কোথায় ছিলে সারাদিন?
সেবা এ প্রশ্নে কোনো উত্তর দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করল না।
শুধু বলল-
ঃ সামুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
রাজেন এগিয়ে এলো দু’পা।
বলল-
ঃ সামুর কাছে তো আসিনি। তুমি কি খুব ব্যস্ত ?
সেবা বলল-
ঃ আমি খুব টায়ার্ড।
ভেতরে চলে গেল সেবা। ওর গমনপথের দিকে চেয়ে থেকে গেট দিয়ে বের হয়ে গেল রাজেন। আজ ক’দিন থেকেই সেবাকে একটা কিছু বলার জন্য ছটফট করছিল রাজেন। কিন্তু কিছুতেই যেন আর সুযোগ হচ্ছিল না। এ বাড়ির ছেলে সামুর বন্ধু হিসেবে বহু বছর থেকে যাওয়া-আসা রাজেনের।
ডিপার্টমেন্টের পিকনিক ছিলো আজ। সারাদিন হৈচৈ-এর ক্লান্তির চেয়ে আজকের ঐ ঘটনাই যেন বেশি করে ভাবিয়ে তুলেছে ওকে। কাঁধের ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে ভেতরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল সেবা।
চারদিকটা কেমন অন্ধকার হয়ে গেছে। দুরের ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু আলো। অন্ধকারে দাঁড়িয়েই নিজের দু’গালে, মরাল গ্রীবা কাঁধ বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগল সেবা, আর কি এক অব্যক্ত অনুভ‚তিতে শিউরে উঠতে লাগল। এ যেন এক অসম্ভব অপরিকল্পিত ঘটনা। সেই উষ্ণ নিঃশ্বাস সেই তপ্ত হাতের স্পর্শ থেকে কিছুতেই যেন নিজেকে আলাদা করতে পারছে না সেবা।
ঃ সেবু এলি?
ভেতর থেকে ছোটমার ডাক শোনা গেল।
চমকে উঠল সেবা। যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো।
বলল-
ঃ এই তো এলাম ছোটমা। একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি-
তারপর বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে একটু উঁচু গলায় বলল- একটু পরে রুমে এক কাপ কপি পাঠিয়ে দিও ছোটমা, প্লিজ।
বাথরুমে ডুকল সেবা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা-মা দু’জনকে হারিয়েছিল সে। এরপর থেকে চাচা-চাচীর বুকের মাঝখানটিতে স্থান করে নিয়েছিল সে। ওর চেয়ে মাস দু’একের ছোট চাচাতো ভাই সামুই হচ্ছে ওর পরম বন্ধু ও আপনজন। কোনোদিনই বাবা-মা ভাই-বোনের অভাব অনুভব করেনি সে।
আর সে জন্যই সারাদিন পর বাড়ি ফিরে জোর গলায় বলতে পারল-
ঃ ঘরে এক কাপ গরম কফি পাঠিয়ে দিও ছোট মা।
চাচীই হচ্ছে সেবার ছোটমা।
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে সব ক্লান্তি সব যেন ধুয়ে ফেলতে চাইল সেবা।
ডিসেম্বর মাস।
তবুও খুব একটা ঠান্ডা নয় পানি। বিশেষ করে সেবার আজকের মানসিক অবস্থার কাছে তো একেবারেই নয়।
মানুষটিকে অর্থাৎ জগলুল হায়দারকে কখনোই পছন্দ করত না সেবা। নতুন লেকচারার হিসেবে এর মধ্যেই কয়েকটা ক্লাস নিয়েছেন তিনি। বহুবার বহুভাবে তার সাথে চোখাচোখি এবং মুখোমুখিও হয়েছে সেবার। ক্যাম্পাসের অনেকের চোখেও পড়েছে ব্যাপারটা। সেবা কৌশলে এড়িয়ে যায় সবসময়।
শক্ত চোয়াল, আর পেশীবহুল পেটানো শরীর জগলুলের। অধ্যাপক হিসেবে একেবারেই মানায় না ওকে। কেউ কেউ উক্তি করে, জিওগ্রাফি না হয়ে জিমন্যাস্টিক টিচার হলে খুব ভালো মানাতো জগলুল স্যারকে। কিন্তু কারো কথায় কান দেয়ার মানুষ না জগলুল হায়দার।
ওনার ক্লাসে অনেক বেশি মনযোগী হয় সেবা। কিছুটা ইচ্ছে করেই।
কোন ছুতোয় কোনোরকম অভিযোগ যেন করতে না পারে জগলুল স্যার।
কিন্তু জগলুল হায়দারের তীক্ষè কটা চোখ যেন সন্ধানী দৃষ্টি।
শুধু সেবাই নয় আরো অনেকে যেন না পারতে করে এই ক্লাস।
কিন্তু সব কিছুতো আর মানুষের ইচ্ছা মত হয় না-
আর তাই বোধহয় ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে আকস্মিকভাবেই জগলুল হায়দারের শরণাপন্ন হতে হলো সেবাকে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ছাত্র-শিক্ষক সবাই যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল চারদিকে। সেবা বান্ধবী নীরাকে নিয়ে একটি কুল গাচের নিচে এসে দাঁড়াল। এতো টসটসে বড় বড় কুলে নুয়ে পড়েছে বিশাল গাছটা। নীরা কাছাকছি একটু উঁচু ডালের ফাঁক দিয়ে ঝুলে থেকে ঝাঁকাতে লাগল গাছটাকে। আর সেই সাথে টুপটাপ অনবরত কুল পড়ে ভরে গেল গাছের তলাটা।
সেবার পরনে ছিল লাল রংয়ের সিল্ক। হঠাৎ ও দেখল দুর থেকে একটা ষাঁড় এগিয়ে আসছে ওর দিকে। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি সেবা। মনের আনন্দে কুল নিয়ে কোঁচড় ভরছিল সে।
কিন্তু চোখ পড়ল প্রথমে নীরার এবং দেখতে পেয়েই ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় চিৎকার করে উঠল-
ঃ সেবা ষাঁড়-
ঃ ষাঁড়!
নিরিবিলি এলাকা। কেউ কোথাও নেই।
সেবা ভয়ে প্রাণপন ছুটতে লাগল সামনের দিকে। কিন্তু সিল্কের শাড়ি পরে অত কি ছোটা যায়? তারপরেও দৌড়াতে লাগল। পেছন পেছন সমানে চিৎকর করতে লাগল নীরা। সেবু শাড়ি খুলে ফেল। প্লীজ সেবু শাড়ি খুলে ফেল। কিন্তু সেবুর তখন নাভিশ্বাস উঠছে ঐ ষাঁড়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। দু’একবার হোঁচট খেয়ে পড়েও গেল।
এমনি সময় উল্টোদিক থেকে আসতে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো জগলুল হায়দার এবং মুহুর্তের মধ্যে ছুটে গেল সেবার কাছে। তারপর টান দিয়ে খুলে ফেলল সেবার লাল শাড়ি, তারপর একহাতে শাড়িটা পোটলা করে ছুঁড়ে দিলো দূরে। আর চট করে সেবাকে জাপটে ধরে কাছেই একটা মাটির ঢিবির আড়ালে কাত হয়ে রইল। প্রায় অজ্ঞানের মত জাগলুলের বুকের মাঝখানটিতে পড়ে রইল সেবা।
চারদিকে কেউ কোথাও নেই।
শীতের হিমেল হাওয়া যেন কেমন উওপ্ত করে দিল দু’টি মানুষের মন। কিছুক্ষণ পর সেবাকে স্বাভাবিক করবার জন্য বারবার ওর গাল চিবুক গলায় হাত দিয়ে স্পর্শ করতে লাগল জগলুল ওর ইচ্ছে হলো আরো কিছুক্ষন সেবা নামের অহংকারী মেয়েটি এমনি করে পড়ে থাকুক না ওর বুকের মাঝখানটিতে। জগলুল বার বার দেখতে লাগল সেবাকে। কি আশ্চর্য ভীত এবং বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে ওকে। অথচ অহঙ্কারী মেয়েটার সারা মুখ জুড়ে কি পরিচ্ছন্ন সৌন্দর্য। একটু যেন নড়ে উঠেছে সেবা। জগলুল নিজের অজান্তেই যেন আলতো চুমু দিল সেবার কপালে।
আর অমনি চোখ খুলল সেবা এবং নিজেকে ঐভাবে আবিষ্কার করে রীতিমতো চমকে উঠল।
এ যেন অবিশ্বাস্য-
হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ফেলল- সেবা বলল,
ঃ আপনি আমাকে
জগলুল ওকে সালমাতে চেষ্টা করল। বলল-
ঃ ভুল বুঝবেন না আপনাকে ঐভাবে না বাঁচালে এতক্ষণে ঐ ষাঁড়ের গুতোঁয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত আপনার দেহটা। আমি ওদিক দিয়ে যাচ্চিলাম। আর কোনো উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে আমি....।
কুন্ডুলী পাকানো লাল শাড়িটা হাতে নিয়ে একসময় এগিয়ে এলো নীরা বলল নে ধর। কোনোরকমে জড়িয়ে নে। জগলুল হায়দার উঠে কাপড় থেকে ধুলা ঝাড়তে লাগল।
বলল-
ঃ স্যরি, রিয়েলি আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি। এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
সেবা তেমনি বসে রইল মাটিতে। নীরা বলল
ঃ জগলুল স্যার না হলে সত্যি আজ তোকে ।
শাড়িটা বুকের উপর ধরে উঠে দাঁড়াল সেবা। চোখ তুলবার সাহস হলো না। মুখ নিচু করে কোনোরকমে বলল-
ঃ থ্যাঙ্ক ইউ-থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।
জগলুল তাকালো সেবার মুখের দিকে। তারপর একটু হাসবার মতো মুখ করে বলল, ইটস ওকে!
কিন্তু চোখ তুলতে সাহস হলো না সেবার। কিছুক্ষণ পর বুঝল চলে গেছেন জগলুল স্যার। চলে গেছেন সেবার কুমারী শরীর আর মনে এক অব্যক্ত রোমাঞ্চকর অনুভ‚তি দিয়ে এরপর সবার মতো বাড়ি ফিরে এসেছে সেবা।
শরীর মনে দু’টোই যেন ক্লান্ত বিধ্বস্ত। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে... অশ্রান্ত ভিজেও একটুও যেন বিস্মৃত হয়নি সেই অব্যক্ত স্পর্শ। বাথরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় খোলা হাওয়ায় দাঁড়াল সেবা। না একটুও ঠান্ডা লাগছে না ওর। বরং মুহুর্মুহু শিহরিত হচ্ছে সেই ঘটনার কথা মনে হতেই ।
ফোন বেজে উঠল।
রিসিবার তুলে রাজেনের কণ্ঠ শুনে বিরক্ত হলো সেবা।
বলল-
ঃ বলছিতো রাজেন আই এ্যাম সো টায়ার্ড।
ঃ প্লিজ সেবা ফোন রেখো না।
ঃ ও পাশের কণ্ঠ। এবার খাটে বসল সেবা। বিরক্ত হয়ে বলল।
ঃ বল কি বলবে।
ঃ তুমি কি একবার নিচে আসবে। আমি শুধু একটা কথা-
সেবা এবার ফেটে পড়ল রাগে।
বলল-
ঃ আর ইউ ম্যাড রাজেন? তুমি জান আমি সারাদিন পর বাইর থেকে এসেছি।
আর একই কথা তুমি বারবার বলছ।
ঃ সেবা প্লিজ।
কি যেন ভাবল সেবা।
তারপর বলল-
ঃ ওকে। তুমি ওপরে এসো।
ওপর ফ্যামেলি রুমের দরজায় এলো রাজেন। মুখ ভরতি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গোফ। চুল এলোমেলো। অবিন্যস্ত দৃষ্টি চোখের।
সেবা সরাসরি তাকালো ওর চোখের দিকে।
বলল-
ঃ বল কি বলবে।
রাজেন চোখ তুলল।
দেখল নীল রংয়ের রাত্রিবাস পরা সদ্যস্নাতা সেবা কে।
স্বচ্ছতা আর সৌন্দর্য যেন টলমল করছে একই সাথে। সেবা আবার বলল-
ঃ কি হোল বল ?
রাজেন ঢোক গিললো অস্থির ভাবে। তারপর বলল-
ঃ আই লাভ ইউ সেবা !
কোথায় যেন হোঁচট খেল সেবা। বিস্মিত চোখ-মুখ ওর
বলল-
ঃ কি বললে ...।
আবার বল ...।
ঃ আই লাভ ইউ।
ঃ হোয়াট! বিরক্ত হলেও একটু হাসল ছোট ভাই সামুর বন্ধু রাজেনের কথা শুনে। বলল-
ঃ তুমি কি বলছ জানো?
ঃ সেবা প্লিজ...আসি মরে যাব।
সেবা একটা হাত ধরল রাজেন। কোনো উত্তর না দিয়ে এক মুহূর্ত সময় নিলো সেবা। তারপর হঠাৎ দাঁতে দাঁত চেপে অন্য হাতে কষে চড় লাগাল রাজেনের গালে।
নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। রাজেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে এবং এক সময় নিচে নেমে গেল।
একটু পরেই দরজায় টোকা দিলেন ছোট মা।
একেবারে খেয়ে বিশ্রাম নিলে ভালো হতো সেবু।
সেবা ততক্ষণে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। আর যেন পারছে না সে।
একটার পর একটা আকস্মিক ঘটনার অত্যাচারে একেবারেই যেন জর্জরিত।
তবু ও বলল-
একেবারেই ক্ষিধে নেই ছোট মা। আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
কিন্তু সত্যি কি তখনি ঘুমুতে পারল সেবা !
পিকনিকের ঘটনা আর রাজেনের অকল্পনীয় কথা অস্থির করে তুলল সেবার মনটাকে মাথার ভেতরটা কেমন টনটন করে ব্যথা করতে লাগল। না: আর যেন পারে না সেবা।
মাথার ভেতরে যেন সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও যেন সব কিছু ভুলে থাকতে চায় সেবা।
দু’হাতে বালিশটা আঁকড়ে ধরে অন্য কোথাও হারিয়ে যেতে চেষ্টা করল সেবা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন