শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসা বাণিজ্য

নিজস্ব প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তা গবেষণা

মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প

মো. আশরাফুল আলম | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

অতি প্রাচীনকাল থেকেই সৌখিনতা ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু মূল্যবান মুক্তা। মুক্তা দিয়ে অলংকারই শুধু নয়, সৌখিন দ্রব্যাদি, প্রসাধন সামগ্রী ও সৌন্দর্যবর্ধক পোশাকেও দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। ওষুধ শিল্পেও রয়েছে এর বিস্তর ব্যবহার। সব মিলিয়ে মুক্তা গবেষণা বর্তমানে একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দিন দিন যেভাবে মুক্তার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও বাড়ছে এর কদর। বেশ কিছু জটিল রোগের চিকিৎসার ওষুধের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হওয়ায়, ওষুধ শিল্পে এর কদরও বাড়ছে ব্যাপক হারে। দেশের আবহাওয়া মুক্তা চাষের উপযোগী হওয়ায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) কেন্দ্রীয় অফিসে আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে মুক্তা গবেষণা কেন্দ্র।
পুকুরে অথবা যে কোনো জলাশয়ে মাছের পাশাপাশি ঝিনুকের দৈহিক কৌশলগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সহজেই মুক্তা চাষ করা যায়। ফলে মাছের সাথে বাড়তি মুনাফা হিসেবে পাওয়া যাবে অতি মূল্যবান মুক্তা। ঝিনুক থেকে তৈরি হয় এই মূল্যবান মুক্তাগুলো। তবে পুকুরে মাছের সাথে মুক্তা চাষে ঝিনুককে আলাদা করে সম্পূরক খাদ্য দিতে হয় না। আলাদা কোনো খরচেরও কথা উঠে না এখানে। কিন্তু ঝিনুক অপারেশন ও মুক্তা চাষের কলাকৌশলই হচ্ছে প্রধান বিষয়। তবে ওইসব কলাকৌশল শেখার জন্য উচ্চ শিক্ষারও খুব একটা প্রয়োজন হয় না। এর ফলে দেশের বেকার যুবক অথবা নারীদের সহজেই সম্পৃক্ত করা যায় মুক্তা চাষে। সে সাথে বিপুল সংখ্যক সুবিধাবঞ্চিতদের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করা সম্ভব। ঝিনুকের ভেতরে কৃত্রিমভাবে মুক্তা তৈরির কলাকৌশল নিয়ে মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প প্রধান অরুণ চন্দ্র বর্মণ জানান, মুক্তা জীবন্ত ঝিনুকের দেহের ভেতরের জৈবিক প্রক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট এক ধরনের রতœ। বাইরের কোনো বস্তু ঝিনুকের দেহের ভেতরে নরম অংশে ঢুকে আটকে গেলে আঘাতের সৃষ্টি হয়। ঝিনুক এই আঘাতের অনুভূতি থেকে উপশম পেতে বাইরে থেকে প্রবেশকৃত বস্তুর চারদিকে এক ধরনের লালা নিঃসরণ করে। ক্রমাগত নিঃসৃত এ লালা পরবর্তীতে জমাট বেঁধে মুক্তায় পরিণত হয়। আর কৃত্রিমভাবে সুস্থ-সবল ঝিনুকের ভেতরে বিভিন্ন ছাঁচের ছোট বস্তু ঢুকিয়ে ইমেজ মুক্তাও তৈরী করা যায়। আর ইমেজ মুক্তা উৎপাদন বর্তমানে একটি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। ইমেজ মুক্তার ব্যবসা দেশের বেকারত্ব দূরীকরণসহ দারিদ্র বিমোচনেও সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে।
গবেষণাগারে মুক্তাচাষের কৌশলটা অনেকটাই সহজ ও সাধারণ হওয়ায় যেকোনো পেশার মানুষ এর সাথে সম্পৃক্ত হতে পারবে বলে গবেষকরা জানান। ইমেজ মুক্তার জন্য বিভিন্ন ছাঁচের মোম বা প্লাস্টিক দিয়ে ইমেজ বস্তু তৈরী করে ঝিনুকের খোলস হালকাভাবে উন্মুক্ত করে ম্যান্টলের নিচে ঢুকিয়ে দিতে হবে। সাবধানতার সাথে ইমেজ ঢুকিয়ে ম্যান্টল গর্ত থেকে বাতাস ও পানি বের করে দিতে হবে। অপারেশনকৃত ঝিনুককে মাছের পুকুরে নেটের ব্যাগে রেখে দড়ির সাহায্যে পুকুরে ১-১.৫ ফুট গভীরতায় ঝুলিয়ে দিতে হবে। ১৫ দিন অন্তর অন্তর অপারেশনকৃত ঝিনুকগুলো পরিষ্কার করতে হবে। ব্যবহার উপযোগী ইমেজ মুক্তা তৈরী হতে ৭-৮ মাস সময় লাগে। শীতকাল ইমেজ মুক্তা আহরণের উপযুক্ত সময়। গবেষণার বর্তমান অগ্রগতি হিসেবে প্রকল্প প্রধান অরুণ চন্দ্র বর্মণ বলেন, বর্তমানে ৪ প্রজাতির মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক সনাক্ত করে মুক্তা চাষ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তবে তাদের মধ্যে marginalis এবং L.corrianus প্রজাতি দুটি ভালো ফলাফল দিচ্ছে। তবে আমাদের দেশীয় ঝিনুকের আকার ছোট হওয়ায় মুক্তার আকার আকৃতিও ছোট হচ্ছে। দেশের বাইরের ঝিনুকের প্রজাতি এনে আমাদের আবহাওয়ায় খাপ খাওয়ানোর জন্যও গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ছাড়াও, বর্তমানে গবেষণাগারে সম্পূর্ণ নিজেদের চিন্তাধারায় বেশকিছু প্রযুক্তিগত কৌশল নেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ঝিনুকের ভেতরে প্রবেশ করানোর জন্য নিউক্লিয়াস তৈরির মেশিন,মুক্তা ছিদ্রকরণ মেশিন, বিভিন্ন ধরনের ছাঁচ তৈরির কৌশল, রং বেরংয়ের মুক্তা উৎপাদনের জন্য মুক্তা কালারিং প্রযুক্তি যা একদমই দেশীয় এবং নিজস্ব প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত। গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টায় মুক্তা চাষের অগ্রগতি লক্ষণীয়। নিজস্ব প্রযুক্তিতে বিভিন্ন রংয়ের মুক্তা তৈরির কৌশল সম্পর্কে মো. ফেরদৌস সিদ্দিকী বলেন, নিজেদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে নিউক্লিয়াস তৈরি করা অনেকে আগেই আয়ত্ত করেছেন গবেষকরা। তবে দেশের বাইরে বিভিন্ন রংয়ের মুক্তার ব্যাপক চাহিদা থাকায় এখন আমরা রংয়ের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। ফলাফলও অনেক ভালো পেয়েছি। আমরাও এখন বিভিন্ন রংয়ের মুক্তা উৎপাদন করতে পারবো। তবে প্রযুক্তিটি দেশীয় এবং পরীক্ষামূলক অবস্থায় থাকায় এখনই তেমনভাবে প্রযুক্তিটি সম্পর্কে বাইরে জানানো হচ্ছে না। সফলতার সাথে সম্পন্ন করার পরই জানানো হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পে কর্মরত বিজ্ঞানীরা মুক্তা তৈরীর সঠিক কৌশলটি আয়ত্ত করাসহ সফলভাবে মুক্তা উৎপাদনে সক্ষম বলে জানান বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ। তিনি বলেন, বর্তমানে মুক্তা গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে মুক্তা উৎপাদনে সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে দেশীয় ঝিনুকের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণে কাক্সিক্ষত আকারের মুক্তা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তবে ছোট আকারের মুক্তার পাশাপাশি ইমেজ মুক্তা উৎপাদনে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে প্রায় ৫শ’ নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন