বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

শিক্ষার উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা

প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাহমুদুল হক আনসারী
শিক্ষা জাতির মেরুদ-, শিক্ষা ছাড়া দেশ জাতির উন্নতি অগ্রগতি আশা করা যায় না। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষার সময়। মনীষীগণ শিক্ষা নিয়ে নানাভাবে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। পৃথিবী সৃষ্টি থেকে মানুষ জানার ও বোঝার জন্য অধীর আগ্রহ নিজে জানতে চায় এবং বুঝতে চায়। না জানাকে জানতে, বুঝতে ও শিখতে চায়। এটা মানুষের স্বভাবজাত প্রভাব, সৃষ্টি, সৃষ্টি কর্তা মানব-দানব, তরুলতা, পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী, চন্দ্র, সূর্য্য, পশুপাখি, সৃষ্টির সব কিছু নিয়ে মানুষের জানার কৌতূহলের কোনো শেষ নেই। সৃষ্টির রহস্য জানতে ও বুঝতে মানুষকে অনেক সাধনা করতে হয়েছে। নানামুখী সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটনে সৃষ্টির রহস্যবিদদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। সৃষ্টির রহস্র উদ্ঘাটনে এখনো থেমে নেই। আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিকূল সর্ম্পকে জানার ও বোঝার কোনো শেষ নেই।
আল্লাহ পাক তার বাণীতে বলেছেন- ‘পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে...’। আর এটাই কোরআনে পাকের প্রথম বাক্য। অর্থাৎ জানতে হলে পাঠ করতে হবে, শিক্ষা অর্জন করতে হবে। শিক্ষা ছাড়া জাতি এক কদম ও সামনে এগুতে পারবে না। জাতির কদর, মায়ের কদর, মাতৃভূমির সম্মান, নিজের অধিকার, অন্যের অধিকার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নিজকে অবশ্যই জানতে হবে, বুঝতে হবে জ্ঞানার্জন করতে হবে। জ্ঞানর্জনের বিকল্প পৃথিবীতে এখনো কিছু আবিষ্কৃৃত হয়নি। শিক্ষা জাতির মেরুদ- ঠিক রাখার জন্য দুনিয়াব্যাপী বিভিন্ন সংস্থা, সমিতি প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীতে মানব জাতিকে উন্নত, জ্ঞানী, নীতি আদর্শবান, চরিত্রবান হিসেবে তৈরি করার জন্য নানমুখী তৎপরতা, কর্মসূচি অব্যাহত আছে এবং চলছে।
পৃথিবী যতদিন থাকবে মানব কল্যাণে এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায় আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়েছে। অর্থনীতির চরম শিখরে পদার্পন করেছে। ওই তুলনায় আমাদের অগ্রগতি বলার মতো না। তবে আমরাও স্বাধীনতার ৪৫ বছরে কর্ম অর্জন করিনি। শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্বলছে। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া শিক্ষার আলো সম্প্রসারিত হয়েছে। বছরের প্রথম দিন থেকেই কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা নতুন বই পাচ্ছে, খেলতে খেলতে আনন্দে মুখরিত হয়ে তারা পাঠশালায় যাচ্ছে। এ ধারা প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। শিক্ষার আমূল পরিবর্তনের জন্য সরকারের সদিচ্ছার কোন কমতি দেখা যায় না। শিক্ষার্থীর সুযোগ যেভাবে দেখছে রাষ্ট্র তেমনিভাবে শিক্ষকদের অধিকারও বাস্তবায়ন করছে।
শিক্ষার কর্মসূচি বাস্তবায়ন একটা অব্যাহত কর্মসূচি, এ কর্মসূচি নিয়মিত সংস্কার হবে, উন্নত হবেÑএটাই স্বাভাবিক। সরকারের কর্মসূচির সাথে শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতা না থাকলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন শতভাগ সম্ভব হবে না। শিক্ষকদের নানা সমস্যা থাকবে এবং সেটা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও অব্যাহত থাকবে। স্বাধীনতার মাত্র ৪৫ বছরের মাথায় রাষ্ট্রের নানা উন্নতি-অগ্রগতি ছোট করে দেখার মতো নয়। উন্নতি-অগ্রগতি আমাদের অনেক হয়েছে, হচ্ছে। তবে একটি স্থানে আমাদের পচন শুরু হয়েছে। এ পচন থামাতে না পারলে অগ্রগতির পরেও ধ্বংস হয়ে যাবে সব অর্জন। দেশে শিক্ষার হার প্রতিদিন বাড়ছে। ডিগ্রির হার বাড়ছে, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা-মসজিদ, মন্দির-গীর্জা বাড়ছে। ধর্মীয় সভা, সমাবেশ, মাহফিল, সেমিনার, আলোচনা-সমালোচনা বাড়ছে, নতুন নতুন ধর্মীয় নেতার আবির্ভাব হচ্ছে। কিন্তু ডিগ্রির সাথে মানুষের মন-মানসিকতার উন্নতি হচ্ছে না। মানুষের, মন-মনন, চরিত্র, উদ্দেশ্য, ভালোবাসা এসব শিক্ষার উন্নতির সাথে সাথে মানুষের মন-মনন থেকে বহু বহু দূরে বিদূরিত হচ্ছে। শিক্ষার আলো মানুষের মন অন্তরকে পরিচ্ছন্ন কলুষমুক্ত, অন্ধকারমুক্ত, হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত করতে পারছে না। পশুত্বের চরিত্র কতিপয় শিক্ষিত নামধারী মানুষের মধ্যে এখনো দেখতে পাওয়া যায়, এখনো নারী দেখলে পুরুষ নামের মানুষেরা হায়নার মতো থাবা মারতে দ্বিধাবোধ করে না। নারীকে মায়ের সম্মান দেখাতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর উদ্যাপন হলো। খুবই ঝাঁক-জমকপূর্ণভাবে জাতি পালন করেছে। শহর-গ্রাম, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, মন্দির গীর্জা সব খানেই তা পালন করা হয়েছ। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও না পাওয়ার অনেক বেদনা পুঞ্জিভূত হয়ে আছে। কেননা এখনো স্বাধীনতার সাধ পায়নি, গ্রামগঞ্জের খেটে খাওয়া মানুষগুলো, তাদের অধিকার তারা জানে না। তাদের প্রাপ্য তারা পেতে চায়। জেলা-উপজেলায় তাদের ইউনিয়নে যে সেবাকেন্দ্র, চিকিৎসাকেন্দ্র চালু আছে তার সঠিক ব্যবহার তারা করতে পারছে না, যথাযথ সেবা কার্যক্রম আমাদের কৃষক সমাজ মেহনতি দিনমজুর জনগণ পাচ্ছে না। তাদের অধিকার তারা পেতে চায়। সরকারের নানামুখী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির সুফল আরো জোরদার করতে হবে। শিক্ষকদের দায়িত্ব আরো কঠোরভাবে পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার আদর্শিক আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মূলনীতি ও নৈতিকতার আদর্শ আরো জোরদার করতে হবে। নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষক, ছাত্র সকলের জন্য সমান প্রযোজ্য, স্কুল-কলেজ, কাপড়-চোপড়ের পরিবর্তনের সাথে শিক্ষার মানকে উন্নত, আদর্শবান নীতি-নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।
দিন দিন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নীতি, আদর্শহীন হয়ে পড়ছে বলে মনে হয়। আমাদের আচার-আচরণ-ব্যবহার অনেক কিছু এখন পরিবর্তন হচ্ছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য ডিগ্রি, সার্টিফিকেট সব কিছুই অর্থ আহরণের জন্য, অর্থ উপার্জনের জন্য, ভালো চাকরি, বাড়িঘর নির্মাণের জন্য। যদি তাই হয় তাহলে আমরা অবশ্যই বিপদের দিকে যাব, আমাদের মগজে পচন ধরেছে। মগজে পচন ধরলে সারা শারীর যেমনিভাবে পচে যায়, তেমনি এ জাতির পচনও সময়ের ব্যবধান মাত্র। শিক্ষা জাতির মেরুদ-Ñএটাকে মাথায় রাখতে হলে অবশ্যই আমাদের একটা নীতি-আদর্শের মধ্যে চলতে হবে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে চালাতে হবে। কেননা এ জাতির উন্নতির জন্য মগজের পচন সারাতে হবে আগে, আর সে জন্য সহসাই ভালো চিকিৎসা দিতে হবে। এখন আমাদের চিকিৎসার দরকার। আমাদের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ শিক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। চলনে বলনে, আচার ব্যবহারে শিক্ষার আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। এ মেরুদ-কে সোজা করতে হবে। আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের ভালো-খারাপ সবদিক অভিভাবকদের চিন্তায় আনতে হবে। তাদের চলাচল আচার-ব্যবহারে নজরে রাখতে হবে। স্কুল-কলেজ, অবসর সময়ে তাদের গতিবিধির প্রতি নজর থাকা চাই। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নজর দিতে হবে। মোবাইলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ইন্টারনেট, ফেসবুক, ব্যবহারে ছাত্রছাত্রী-গৃহকর্মী বয়স অনুপাতে ব্যবহারের বিধি-নিষেধ থাকা চাই। শিক্ষাকে বাণিজ্যের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। শিক্ষার নামে বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে, গলা কাটা ফি আদায় বন্ধ করতে হবে। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সুশৃঙ্খল শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করে নানামুখী শিক্ষা থেকে জাতিকে রক্ষা করে কর্ম ও বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার উন্নতি ঘটাতে হবে।
দেশ স্বাধীন হয়েছে মানুষদের অন্ন, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৌলিক অধিকার পাওয়ার জন্য। অধিকাংশ মানুষ এখনো তার অধিকার থেকে বঞ্চিত; অফিস, আদালত সব ক্ষেত্রেই সেবা প্রত্যাশী নাগরিকরা হয়রানির শিকার হতে দেখা যায়। এ হয়রানি বন্ধ করতে হবে। নাগরিক অধিকার প্রত্যাশীদের সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ঘুষ, দুর্নীতির বিষদাঁত সমূলে ধ্বংস করতে হবে। দুর্নীতিবাজ আমলা, কর্মচারীদের তালিকা করে তাদের সতর্ক করতে হবে। জনগণের রাষ্ট্র, জনগণের কর্মচারী, সেবক হিসেবেই রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের মালিক জনগণের যেন হয়রানি পোহাতে না হয়, ভোগান্তির শিকার না হতে হয় সেটাই রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানদের নিশ্চিত করতে হবে। তবেই শিক্ষার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে, জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
ষ লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ ফাউন্ডেশন

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন