শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মাদকে আক্রান্ত দেশ

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন | প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গুম, খুন, অপহরণ, সড়ক দুর্ঘটনা, ধর্ষণের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। মাদকের নেশা সর্বনাশা। এই সর্বনাশা নেশা আগামী দিনের কর্ণধার তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে সব শ্রেণিপেশার মানুষকে এক ভয়াবহ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশের আনাচে-কানাচে অবাধে চলছে মাদকের ব্যবহার। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উচ্চবিত্ত পরিবারের মহিলাসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এখন হাত বাড়ালেই গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, সিসা, বাংলা মদ, হেরোইন সহজে পাওয়া যায়। মাদকের ভয়াবহতা কত নিষ্ঠুর কত বেদনাদায়ক হতে পারে তা নিজ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ নেশাগ্রস্থ থাকলে সহজে অনুধাবন করা যায়। সরকারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামালের কাছে এসে বলেন, ইয়াবা না খেলে তিনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেন না। অফিসের কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। সভা-সেমিনারে বক্তব্য রাখতে পারেন না। এ অবস্থা থেকে কীভাবে মুক্তি পেতে পারেন সে জন্য পরামর্শ চান। ডা. মোহিত কামাল বলেছেন, আমাদের কাছে ইয়াবা আসক্ত শতশত রোগী আসছেন। আমরা জরিপ করে দেখেছি, এমন কোন পেশার লোক নেই যে, সেখানে ইয়াবা আসক্ত নেই। এটা বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত।
জাতিসংঘ মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের তথ্য মতে, এই অঞ্চলে ইয়াবা পাচার করে মিয়ানমার। প্রতিবেশী দেশগুলো মাদকের বিরুদ্ধে সর্তক অবস্থানে থাকায় সেসব দেশে মাদক পাচার করতে পারে না মিয়ানমার। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তে অবাধে পাচার করছে ইয়াবা ও মাদক। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর মোতাবেক, ২০১০ সালে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ লাখে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, মাদকের সবচেয়ে বড় শিকার তরুণ ও নি¤œ শ্রেণীর ছিন্নমূল মানুষ। প্রতি ১৭ জন তরুণের মধ্যে একজন মাদকাসক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে মোট মাদকসেবীর মধ্যে ইয়াবায় আসক্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় শতাংশ। ২০১৬ সালে এ হার বেড়ে প্রায় ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সালে জব্দ হওয়া ইয়াবার সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৬০ হাজার পিস আর ২০১৬ সালে সেটা দাঁড়ায় দুই কোটি ৯৪ লাখে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ২০১৭ সালে সেটা দাঁড়ায় তিন কোটি ৮০ লাখ ৯১ হাজার পিসে। ক্ষমতার দাপটে অনেক মাদক ব্যবসায়ীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এমনও পরিবার পাওয়া যাচ্ছে, যার সবাই মাদক কারবারের সাথে জড়িত। একইভাবে কোনো এলাকা কুখ্যাতি অর্জন করছে মাদক চোরাচালানিদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে। এর মূল কারণ হচ্ছে, অল্প সময়ে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া।
কী শহর কী গ্রাম সর্বত্র হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মাদক। সরকারি-বেসরকারি কোন উদ্যোগই মাদক প্রতিরোধ করতে পারছে না বলেই এখনও পত্রিকায় পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে থানায় মাদকের হাট শিরোনাম। একটা সময় গাজার কথা শোনা গেলেও এখন ইয়াবার কথা প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে। ইয়াবা ব্যবসার সাথে সমাজের অনেক নামি-দামী ব্যক্তির নাম যখন পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয় তখন সত্যিই মনে দাগ কাটে। চট্রগ্রামে ১৪ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছে এক নারী ক্রিকেটার। মহানগরীর বাকলিয়া থানাধীন শাহ আমানত সেতুর গোলচত্বর এলাকা থেকে মাদকসহ ওই নারী ক্রিকেটারকে আটক করে পুলিশ। মুক্তা নামের এই ক্রিকেটার ঢাকা মহিলা প্রিমিয়ার লীগে আনসার দলের হয়ে নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন। একটা সময় গোপনে মাদক ব্যবসা চলতো। কিন্তু এখন রাখঢাক ছাড়াই মাদকের ব্যবসা চলছে। আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর নাকের ডগায় বসে মাদক ব্যবসা চললেও বেশির ভাগ সময়ই তাদের নীরব থাকতে দেখা যায়। ফলে বেড়েই চলছে মাদকের কেনাবেচা আর সেবন। মাদকদ্রব্য নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে মাদক সেবনের সঙ্গে ৭০ লাখ মানুষ জড়িত। এর মধ্যে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। মাদক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী ২০২০ সালের ভেতরে দেশে অন্তত কোটি লোক নেশায় আসক্ত হবে। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে এখন ৬৫ লাখ মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ ও ১৬ ভাগ নারী। আরেক জরিপে বলা হয়েছে, মাদকাসক্ত শিশুদের ড্রাগ গ্রহণ ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ৪৪ শতাংশ পথশিশু, পিকেটিংয়ে ৩৫ শতাংশ, ছিনতাইয়ে ১২ শতাংশ, মানব পাচারের সহায়তার কাজে ১১ শতাংশ জড়িত। ঢাকা আহছানিয়া মিশনের এক জরিপ থেকে জানা যায়, তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ ফেনসিডিল, গাঁজা ৩৮ শতাংশ, ইয়াবা ৪১ শতাংশ, হেরোইন ৭ শতাংশ ও ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা গ্রহণ করে ৫ শতাংশ। দুটো জরিপ থেকে জানা যায় দেশে আশংকাজনকভাবে মাদক ও ইয়াবাসেবীর সংখ্যা বাড়ছে।
আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় ইয়াবার ক্ষুদ্র ও সহজে বহনযোগ্য মাদকের কারবার বন্ধ করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বন্যার ¯্রােতের মতো মাদক প্রবেশ করলেও দুর্বল প্রযুক্তির অভাবে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মাদকের ভয়াবহতা প্রতিরোধে যারা মাঠপর্যায়ে দায়িত্বপালন করছেন তাদের ভাষ্যমতে, আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া ইয়াবার মতো মাদকের লাগাম টেনে ধরা অসম্ভব। ইয়াবা ও মাদকের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বিভিন্ন অভিযানে মোট ৩ কোটি ৮০ লাখ ৯১ হাজার ৮৬৫টি ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের ১৫টি স্থান দিয়ে ইয়াবা দেশে ঢুকছে বলে সরকারি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০১১ সালে জব্দ হওয়া ইয়াবার পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৬০ হাজার আর ২০১৬ সালে হয়েছে ২ কোটি ৯৪ লাখ। আর ২০১৭ সালে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটিতে। ফলে প্রতি বছরই প্রায় দ্বিগুণ হারে ধরা পড়েছে ইয়াবা।
দেশজুড়ে মাদকের নেশার আগ্রাসন যেভাবে চলছে তা যদি এখনই বন্ধ করা না যায় তাহলে সামনে আরো দুঃসংবাদ হয়তো আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াবে। কারণ মাদকাসক্ত ব্যক্তি শিক্ষিত হলেও মূর্খের মতো আচার-আচরণ করে। এমনকি ভদ্র ঘরের সন্তান হলেও অভদ্র ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তেলাপোকা কিংবা মুরগী জবাই করতে ভয় যে ভয় পায়, সেই ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে দ্বিধাবোধ করে না। কারণ মাদক গ্রহণের ফলে মাদকাসক্ত মানুষটি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যার বাস্তব নমুনা তো আমাদের চোখের সামনেই আছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জে মাদকাসক্ত ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই খুন হয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে নেশার টাকার জন্য গাজীপুরের শ্রীপুরে এক পাষান্ড বাবা তার কলিজার টুকরা সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছিল। এ ঘটনায় পালিত বাবা-মা ও জন্মদাতা পিতাকে আটক করেছিল পুলিশ। মাদকসেবী সন্তান তার প্রিয় মা-বাবাকে পর্যন্ত খুন করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। একটি দৈনিক পত্রিকার নিজস্ব রিপোর্টে জানানো হয়, গত ১০ বছরে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে কমপক্ষে ২০০ বাবা-মা নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। মাদকসেবী স্বামীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন ২৫০ জনেরও বেশি নারী। নিকট অতীতে রাজধানীর বুকে মাদকাসক্ত কিশোরীর হাতে পুলিশ অফিসার বাবা, সেই সাথে মা খুন হয়েছে।
একটি দেশ বা রাষ্ট্রের বড় সম্পদ হচ্ছে তরুণ সমাজ। তারা বড় হয়ে দেশকে পরিচালিত করবে এটাই তো সবার প্রত্যাশা। কিন্তু সেই তরুণ প্রজন্ম যখন মাদকাসক্তিতে শেষ হয়ে যায় তখন আর কষ্টের সীমা থাকে না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশকে যদি মাদকমুক্ত করতে হয় তাহলে আইনের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। সন্তানের বয়স সাত বছর হলেই বাবা মায়ের উচিত ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব বুঝানো। বিশেষ করে নবী ও রাসূলের জীবনী পড়ার জন্য জোর তাগিদ দিতে হবে। দেশ সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্থিরতা দূর করতে হলে তরুণ-তরুণীদের মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে। পরিশেষে একটি আবেদন ও প্রস্তাব রাখছি, সরকার থেকে শুরু করে দেশের সুশীলসমাজ, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, মসজিদের সম্মানিত খতিব, ইমাম, অভিভাবক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনী সকলের কাছে- আসুন, দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে মাদকের আগ্রাসন থেকে কলিজার টুকরা সন্তানদের রক্ষা করি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন