মো. আমিনুল হক, মধুপুর (টাঙ্গাইল) থেকে
ইতিহাস ঐতিহ্যখ্যাত মধুপুর গড়ের শালবন ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত ও জবর দখল হয়ে ৪৫ হাজার একর থেকে ৯ হাজার একরে এসে দাঁড়িয়েছে। শালবনের চারিদিকে বাণিজ্যিকভাবে আনারস ও কলার চাষের ফলে দিন দিন কমছে শালবনের আয়তন। বাড়ছে জবর দখল। কমছে বন। উদ্ধারে নেই কোন পদক্ষেপ। ফলে বনের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। কমছে বনের আয়ুষ্কাল। জবর দখলের কবলে পড়ে রূপ হারাচ্ছে দেশের একমাত্র পত্রঝরা এ বন। জীববৈচিত্র্য পড়ছে হুমকির মুখে। প্রাণবৈচিত্র্য রয়েছে নানা প্রতিকূল পরিবেশে। বন্য প্রাণীদের খাদ্যের অভাবে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। খাদ্যের অভাবে বন্য প্রাণী দিন দিন কমে যাচ্ছে। একসময় এ বনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার (বাঘ) ছিল। ছিল হাতি, হরিণ, মায়া হরিণ, বানর, হনুমান ও গুইসাপসহ নানা প্রাণী। এ বনে ছিল প্রায় দুই শতাধিক পাখির অভয়ারণ্য। বনে ঢুকলে শোনা যেত পাখির নানা কুজন। বনের পরিবেশ বিপন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে এখন আর আগের মতো পাখি ও প্রাণীর দেখা মেলে না। সামাজিক বনায়নে বিদেশি প্রজাতির গাছ রোপণের ফলে এসব গাছের ফুল-ফল পাখিরা খায় না। ফলে পশু পাখিদের খাদ্যের অভাব দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। ট্রাক্টর দিয়ে সামাজিক বনায়নে চাষাবাদ করার কারণে গুল্মলতাও বিদায় নিয়েছে এ বন থেকে। শালবনের পাতা পরে মধুপুর বনের মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পেত। বর্তমানে সামাজিক বনায়নে লাগানো আকাশমণি, মেনজিয়ামসহ বিভিন্ন বিদেশি প্রজাতির গাছের পাতা পচে না। বরং এসব পাতা যেখানে পড়ে সেখানে আর অন্য কোন গাছ জন্মাতে চায় না। অপরদিকে খাদ্যের অভাব থাকার কারণে বন্য প্রাণীরা লোকালয়ে খাদ্যের সন্ধানে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। সামাজিক বনায়নে ও কৃষিপ্লটে উৎপাদিত আনারস ও কলার বাগানে কীটনাশক ও বিষ প্রয়োগের ফলে মাটির জীব-অনুজীব নষ্ট হচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। দিন দিন বনের জমি জরব দখলের কারণে বাড়ছে চাষাবাদ। রাবার বাগান করার ফলেও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সামাজিক বনায়নে শতকরা ১০ ভাগ দেশি প্রজাতির গাছ লাগানোর নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। দেশি প্রজাতির গাছ লাগানো হলেও ধীরে ধীরে তা তুলে ফেলা হয়। অন্যদিকে জবর দখলকৃত জমিতে রাতারাতি চাষাবাদ ও বাড়িঘর করা হচ্ছে। বনবিভাগের ৪৫ হাজার একরের মধ্যে রাবার বাগানের জন্যে ১৫ হাজার একর, ফায়ারিং রেঞ্জের জন্য ১ হাজার একর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এখন বন রয়েছে ৯ হাজার একরের মতো। বাকি জমি জবর দখল হয়ে গেছে। জবর দখলকৃত জমিতে হাটবাজার থেকে শুরু করে পাকাবাড়িও নির্মাণ করা হয়েছে। সরেজমিন মধুপুর শহর থেকে ৮ কিঃমিঃ উত্তরে অরণখোলা রেঞ্জে গিয়ে কথা হয় সামাজিক বন কমিটির সদস্য, কমিউনিটি ফরেস্ট ওর্য়াকার ও বিট কর্মকর্তা আমিনুল হকের সাথে। বিট কর্মকর্তা জানালেন, অরণখোলা রেঞ্জের অধীনে জমির পরিমাণ রয়েছে ৯৬৭ একর। তাদের দখলে রয়েছে ৮৯৩ একর। এরমধ্যে সামাজিক বনায়ন রয়েছে ৭০০ থেকে ৭২০ একরের মতো। সেগুণ বাগান রয়েছে ৫০ একরের মতো। তিনি জানালেন, জবর দখলে রয়েছে ৭৪ একর। রেঞ্জ অফিসের ৩ দিকে বাড়িঘর, বাজার, পাকা বাড়িসহ নানা প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতামূলকভাবে গড়ে উঠছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই। সামাজিক বনের প্লটের মধ্যে বাড়ি তোলে বিশাল জমি দখল করেছে তা বিট অফিসের সামনেই। তবুও কর্তা ব্যক্তিদের চোখে পড়ে না। জবরকৃত জমিতে প্রথমে মাটির দেয়াল, ঝুপড়িঘর তোলে জমি দখল জায়েজ করে। ধীরে ধীরে বন অফিসের কাছাকাছি ও অফিসের সামনে পাকা বিল্ডিং রাতারাতি উঠছে তবু এদিকে কর্তা ব্যক্তিদের কোন নজর নেই। জবর দখলকৃত জমি আবার কার্টিজমূলে উচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে জবর দখলকারীরা উৎসাহিত হয়ে কর্তা ব্যক্তিদের সাথে আতাঁত করে চলছে। বনবিভাগ জবর দখলকারীদের উচ্ছেদের জন্য কোন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। উচ্ছেদের জন্য কোন নোটিশ পর্যন্ত জারি করা হয়নি আজ পর্যন্ত। স্থানিয় জনগণ মনে করেন এভাবে চলতে থাকলে ৭৪ একর জমি চিরতরে ভূমি খেকোদের কব্জায় চলে যাবে। তখন উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে। জবর দখল, পাকা বাড়ি নির্মাণ কাজে বনবিভাগের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে দেখা দিয়েছে জনমনে নানা প্রশ্ন। অপরদিকে, স্থানীয় বনবাসী হতদরিদ্র, গারো, কোচ, ভূমিহীনরা সাংবাদিকদের জানান, সরকারি বিধান মতে সামাজিক বনায়ন এক হেক্টরের পরিবর্তে এক একর করে স্থানীয় দরিদ্র সংখ্যালঘু পরিবারের মধ্যে প্লট বরাদ্দ দেয়ার জন্য দাবি জানিয়েছেন। টাঙ্গাইল বিভাগের বন কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, ৪৫ হাজার একরের মধুপুর শালবন এখন ৮-৯ হাজার একরে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি সবাইকে মধুপুরের বন রক্ষার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন