সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

দারিদ্র্য বিমোচনে বায়তুলমাল

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


\ এক \
বায়তুলমাল ইসলামী আদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্রের মূল আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ইসলামের অর্থনৈতিক সৌন্দর্য ও রাষ্ট্রের কল্যাণ বিকাশে এ প্রতিষ্ঠান অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। বায়তুলমাল অধুনা রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা স্টেট ব্যাংকের সম্পূরক একটি শব্দ। এতে গচ্ছিত সম্পত্তিতে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রেরা কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি সাধারণ জনগণ সবার অধিকার সমানভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে কোন একজন নাগরিকও যাতে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তার নিশ্চয়তা প্রদান করাই এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ স.-এর আমল থেকে সর্বশেষ খিলাফাতের পতন পর্যন্ত ইসলামী শাসনব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে যেসব জনকল্যাণমূলক খাতে বায়তুলমালের অর্থ ব্যবহার করা হতো, দারিদ্র্য বিমোচন তার অন্যতম।
ইসলামে বায়তুলমালের ধারণা অতি ব্যাপক। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা এবং মানুষের খিলাফাতের মৌলিক বিশ্বাসের ওপরই বায়তুলমালের ধারণা ভিত্তিশীল। বায়তুলমাল ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কোষাগার। রাসূসুল্লাহ স. ও খিলাফাতে রাশেদার যুগে সমাজের যাবতীয় প্রয়োজন বায়তুলমাল থেকেই পূরণ করা হতো। ইসলামী আদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্রের একজরন নাগরিকও যাতে মৌলিক চাহিদা পূরণ হতে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করা বায়তুলমালের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। সমাজের অসহায়, অভাবী, দরিদ্র, নিঃস্ব, পঙ্গু, দুঃস্থ, আশ্রয়হীন, পিতৃহীন, বিধবা সহ সব ধরনের গরীব-দুঃখীকে আর্থিক সহায়তা দান ও তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে বায়তুলমাল কাজ করে। যাকাত গ্রহীতা নির্ধারিত আট শ্রেণি ব্যতীত অন্যান্য মুখাপেক্ষী মানুষের চাহিদা যখন বায়তুলমালের যাকাত খাতের মাধ্যমে সম্ভব না হয়, তখনই তাদের অভাব পূরণে বায়তুলমালের অন্যান্য খাতের সহযোগিতা নেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যয়ভার মেটানোর পর যে অর্থ বায়তুলমালে উদ্বৃত্ত থাকে, তা থেকে সমাজের দুঃস্থ, গরীব, অসহায়, অক্ষম ব্যক্তিদের আর্থিক সাহায্য, বিনা সুদে ঋণদান ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের দারিদ্র্য মোচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
বায়তুলমালের ব্যুপত্তিগত অর্থ ধনাগার, কোষাগার, মাল বা দৌলতের ঘর। পরিভাষায় ইসলামী রাষ্ট্রের কোষাগারকে বায়তুলমাল বলা হয়। কিন্তু এর দ্বারা শুধু সে ইমরাতকেই বোঝায় না, যেখানে সরকারি ধন-সম্পত্তির কাজ-কারবার পরিচালনা করা হয়, বরং ইসলামী রাষ্ট্রের যে বিভাগটি রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের খাতসমূহের নির্বাহ ও পরিচালনার গুরম্ন দায়িত্ব পালন করে, ব্যাপক অর্থে তাকে ‘বায়তুলমাল’ বলা হয়। বিভিন্ন মনীষী বায়তুলমাল-এর বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তন্মধ্যে আমির মুহাম্মদ নায্যার জালউত একটি সমন্বিত সংজ্ঞা প্রদানের প্রয়াস নিয়েছেন। তিনি বলেন: স্বতন্ত্র আর্থিক সত্তা, যা ফাঈ, যাকাত, সাধারণ সম্পদ ও বিধানগত দিক থেকে এর সমপর্যায়ের বস্তু সংগ্রহ, নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ ও হিসাবরক্ষণ করে এবং জনসাধারণের অভাব মোচন ও প্রয়োজন পূরণের জন্য শারঈ নস (কুরআন ও সুন্নাহর উদ্ধৃতি) ও ইজতিহাদের নির্দেশিত খাতে কোন প্রকার অন্যায়ের আশ্রয় ব্যতীত ব্যয় করে। মোটকথা, ‘বায়তুলমাল’ ইসলামী রাষ্ট্রের এমন এক সবম বিভাগ, যা নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার পূরণার্থে রাষ্ট্রের সকল আয় ও ব্যয়ের জন্য দায়িত্বশীল। ‘বায়তুলমাল’ রাষ্ট্রের সকল মুসলিমের সাধারণ সম্পত্তি। ‘আল-হাদিয়া’ নামক ফিক্হ গ্রন্থে বলা হয়েছে: বায়তুলমালের সম্পত্তি মুসলিম জনসাধারণেরই সম্পত্তি। বায়তুলমালে সঞ্চিত রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদে সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত। রাষ্ট্র প্রধান, রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা সাধারণ মানুষ কেউই একচেটিয়া এর মালিক হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ স.-এর বাণীতে সে কথাই ঘোষিত হয়েছে। তিনি স. বলেছেন: আমি তোমাদের দানও করি না, বারণও করি না, আমিতো বণ্টনকারী মাত্র। আমাকে যেরূপ আদেশ করা হয়েছে আমি জাতীয় সম্পদ সেভাবেই দিয়ে থাকি।
মদীনা নগরে মহানবী স.-এর পবিত্র হাতে প্রথম যেদিন ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়, মূলত সে দিন থেকেই রায়তুলমালের সূচনা হয়। এর মূল নাম ছিল ‘বাইতু মালিল মুসলিমীন’ বা ‘বাইতু মালিল্লাহ’। পরবর্তীতে মুসলিমীন শব্দটি বাদ দিয়ে এটিকে কেবল ‘বায়তুলমাল’ কোনরূপ ধন-সম্পদ সঞ্চয় করে রাখা হতো না। তার সুযোগও তখন ছিল না। কারণ, তখন সাধারণ নাগরিক ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় আয় ছিল অতি সামান্য। ফলে রাসূলুল্লাহ স.-এর হাতে কোন সম্পদ আসার সাথে সাথেই তিনি তা অভাবীদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন।
সর্বপ্রথম আবূ বকর সিদ্দিক রা.-এর আমলে ‘বায়তুলমাল’ বাস্তব রূপ লাভ করে এবং আবূ ‘উবায়দা রা. কে এর পরিচালক বা ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তখনও জাতীয় প্রয়োজনের তীব্রতা হেতু যে মাল-সম্পদই তাঁর কাছে আসত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তা মুসলিমদের মঙ্গালার্থে ব্যয় করে ফেলতেন। এ কারণেই তখনকার বায়তুলমালের দরজা সব সময় তালাবদ্ধ থাকতো। আবূ বকর রা.-এর ওফাতের পর যখন ‘উমর রা. কয়েকজন সাহাবীর সাহায্যে বায়তুলমালের হিসাব নিকাশ নেন তখন তিনি তা একদম শূন্য দেখতে পান”। ‘উমর রা. -এর খিলাফতকালে যখন মিসর এবং ইরাক থেকে খারাজ (ভূমিকর) ও জিযিয়া প্রভৃতি আসতে শুরু করে, তখন তিনি কেন্দ্রে এবং প্রদেশগুলোতে যথারীতি ‘বায়তুলমাল’ এর শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। ‘উমর রা. ‘আব্দুল্লাহ ইব্ন ‘ইকরামাহ রা. কে ‘আমিরু খাযানা’ (গভর্নর অব দি স্টেট ব্যাংক) নিযুক্ত করে তাঁর অধীনে কয়েকজন সহাবীকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করেন। বায়তুলমালের জন্য যথারীতি ‘রেজিস্টার’ এবং ‘দিওয়ান’ প্রণয়ন করা হয়। অবশ্য কোন এলাকার বায়তুলমালের কি পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত থাকত, তা এখন বলা মুশকিল। ঐতিহাসিক ইয়াকূবী এ সম্পর্কে যে তথ্য দারিদ্র্য বিমোচনে বায়তুলমালের ভূমিকা।
পরিবেশন করেছেন তা হলো, রাজধানীর ‘বায়তুলমাল’ থেকে শুধুমাত্র রাজধানীর বাসিন্দাদের বেতনভাতা প্রভৃতি বাবদ যে অর্থ ব্যয় করা হত, তার সর্বমোট পরিমাণ ছিল বছরে তিন কোটি দিরহাম। খুলাফায়ে রাশেদীন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আদায়কৃত কর এবং গনীমাত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) জমা করে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। যে পরিমাণ সম্পদ বায়তুলমালে আসত, তাঁরা তা মুসলিমদের মাঝে বন্টন করে দিতেন অথবা জনসাধারণের কল্যাণে বিভিন্ন কাজে খরচ করে ফেলতেন। এভাবে সমস্ত মাল খরচ করার পর তাঁরা বায়তুলমালকে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলতেন।
উমাইয়াদের সময় বায়তুলমালের নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘দিওয়ানুল খারাজ’ বা রাজস্ব বিভাগ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় বায়তুলমাল বা সরকারি মালখানা জনগণের সম্পত্তি ছিল এবং এতে রাষ্ট্রের প্রত্যেকের অধিকার ছিল। কিন্তু উমাইয়া খলীফাদের সময় দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া তা খলীফাদের নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হয়। উমাইয়া যুগে যে সকল উৎস থেকে রাজস্ব গৃহীত হতো তা হলোঃ খারাজ, জিযিয়া, যাকাত, উশর, বাণিজ্য শুল্ক, কদর রাজ্য হতে প্রাপ্ত কর, যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তির এক পঞ্চমাংশ, ফাই, বিশেষ কর প্রভৃতি। এ সময় প্রদেশের আয় হতে প্রদেশের প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কাজে খরচ করার পর উদ্বৃত্ত অর্থ দামেশকে কেন্দ্রীয় সরকারি তহবিলে পাঠিয়ে দেয়া হতো। খলীফাগণ তাঁদের ইচ্ছেমত তা থেকে খরচ করতেন।
আব্বাসীয়গণের সময়ও বায়তুলমালের নাম ছিল ‘দিওয়ানুল খারাজ’। এ আমলে রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল খারাজ, জিযিয়া, যাকাত, ‘উশর, বাণিজ্য শুল্ক, আমদানিকর, লকণকর, মৎস কর ইত্যাদি। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দুই-পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রের রাজস্ব খাতে জমা হতো এবং তিন-পঞ্চমাংশ কৃষক পেত। তবে কৃষক নিজ ব্যবস্থাপনায় সেচকাজ করলে তাকে তিনÑচতুর্থাংশ ছেড়ে দেয়া হতো। আঙ্গুল ও খেজুর বাগান সমূহের ক্ষেত্রে কেবল এক-পঞ্চমাংশ রাজস্বরূপে নিয়ে চার-পঞ্চমাংশই কৃষককে দেয়া হতো। রাজ্যের বিশাল এলাকার ভূমি রাজস্ব ছিল কেবল একÑদশমাংশ। সবল-সক্ষম যিম্মীদের নিকট থেকে (যারা সামরিক বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করত না) জিযিয়া কর নেয়া হতো। মুসলিমদের নিকট থেকে ‘সাদাকাত’ খাতে ট্যাক্স নেয়া হতো। বিত্তবান মুসলিমদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করা হতো। রাজস্বের একটি বিরাট অংশ সামরিক বাহিনীর জন্য ব্যয় করা হতো, যারা রাজ্যের আইন-শৃংখলা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকতো। জনকল্যাণে শহরÑনগর, দুর্গ, মসজিদ, মাদ্রাসা, সরাইখানা, পুলÑখাল, জুয়ো প্রভৃতি নির্মাণ করা হলো। শিল্পী, আবিষ্কারক ও কারিগর, হাকীম, চিকিৎসক, কবি, সাহিত্যিক ও শাস্ত্রবিদদেরকে বড় অংকের প্রণোদনামূলক বৃত্তি (ইনাম) ও বেতন-ভাতা দেয়া হতো। সাম্রাজ্যের সকল শিক্ষা ব্যয় রাজ্বস থেকে নির্বাহ করা হতো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন