রোববার, ২৬ মে ২০২৪, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

মাক্সিম গোর্কি

আ ফ তা ব চৌ ধু রী

| প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভের জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল বড়োই তিক্ত। ২৪ বছর বয়সে লেখক-জীবনের শুরুতেই তিনি সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মরণে ছদ্মনাম গ্রহণ করলেন মাক্সিম গোর্কি, যার অর্থ তিক্ত মাক্সিম। কিন্তু জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার অন্তরালে যে কী গভীর ভাবব্যঞ্জনা নিহিত থাকতে পারে সাহিত্যে তা লিপিবদ্ধ করে তারই সাক্ষ্য রেখে গেলেন লেখক মাক্সিম গোর্কি।
দারিদ্রের তাড়নায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ অসমাপ্ত রেখে রুজি-রোজগারের উদ্দেশ্যে দশ বছর বয়সেই পথে বেরিয়ে পড়তে হয় আলেক্সেইকে। সেই থেকে একটানা দীর্ঘকাল তাঁর ভবঘুরে জীবন, হাড়ভাঙা পরিশ্রম ও শোষণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়। এরই মধ্যে দু’দুবার পায়ে হেঁটে রাশিয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়ানোর ফলে বিচিত্র সব মানুষের সংস্পর্শ। কী করে কে জানে এর ফাঁকে ফাঁেক বই পড়াটাও কেমন যেন একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পবিত্র কোরআনে , আরব্য রজনী ও রুশ সাহিত্য থেকে শুরু করে রুশ অনুবাদে বিশ্ব সাহিত্যের ক্লাসিক, হাইনের কবিতা, এমনকি নিটশের দর্শন-একে এক সবই পড়া হয়ে গিয়েছিল তাঁর।
অথচ শুধু প্রতিভাস্ফুরণের কেন, স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ পরিস্থিতি কোনোটাই ছিল না। তাঁর জীবনে, থাকার মধ্যে ছিল তাঁর অদম্য জ্ঞানস্পৃহা আর অটুট মনোবল। পরিণত বয়সে লেখা ‘আমার ছেলেবেলা’ (১৯১১), ‘পৃথিবীর পথে’ (১৯১৫) ও ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’ (১৯৯২৩) নামে আত্মজৈবনিক উপন্যাসত্রয়ীতে লেখক তাঁর সেই বিচিত্র জীবনের কাহিনী আমাদের শুনিয়েছেন। যেভাবে কৌশলে নিজেকে মনোযোগের কেন্দ্রস্থল থেকে আড়ালে সরিয়ে রেখে নিজেরই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, ভবঘুরে জীবনে দেখা মানুষজন ও ঘটনার এক একটি রেখাচিত্র তিনি এঁকেছেন তাতে এই রচনাকে না উপন্যাস না আত্মজীবনী-কোনো কোঠাতেই ফেলা যায় না। লেখকের জাদু লেখনীয় স্পর্শে তা হয়ে উঠেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের অবক্ষয়ী রাশিয়ার জীবনদর্শন। আবার গোর্কির গল্প-উপন্যাস-নাটকে জীবন প্রতিফলিত হয়েছে তারও উৎস এখানে আছে। গোর্কির সমগ্র রচনার মূলমন্ত্রের সন্ধানও এখানেই মিলবে। আমার ছেলেবেলাতে লেখক সেই সারকথাটি প্রকাশও করে গেছেন দ্বর্থহীন ভাষায় ‘আমাদের জীবনকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় শুধু এই জন্য নয় যে, এই জীবনের একদিকে আছে পশুসুলভ প্রচন্ড একটা নোংরামি যা দিনের পর দিন পাহাড়প্রমাণ হয়ে উঠেছে. আশ্চর্য হতে হয় এই জন্যও যে এই জীবনের অন্তরালে এক সুস্থ সৃজনশীল শক্তিও দেদীপ্যমান।
রাজতন্ত্রবিরোধী গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে ভবঘুরে অ্যালেক্সেইয়ের যোগাযোগ বহু দিনের। এক সময় রাজনৈতিক কার্যকলাপের সূত্রে জর্জিয়ার রাজধানী তিফলিস এ এসে পৌঁছলেন। এই সময় আকস্মিকভাবেই জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখে ফেললেন একটি গল্প-১৮৯২ সালে স্থানীয় কাভকাজ পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম লেখা সেই ছোটোগল্প মাকার চুদ্রা। প্রকাশিত হল মাক্সিম গোর্কি ছদ্মনামে। প্রথম লেখাতেই রাতারাতি লেখক খ্যাতি জুটে গেল। এক দু’বছর পরে চেলকাল গল্প প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের ছোটোগল্পের ইতিহাসে তাঁর আসন স্থায়ী হয়ে গেল। এরপর থেকে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যেই তাঁর পেশা হয়ে দাঁড়াল।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ছোটোগল্প উপন্যাস নাটক-সাহিত্যের তিনটি ক্ষেত্রেই গোর্কি সুপ্রতিষ্ঠিত। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তিন খন্ডে রেখাচিত্র ও গল্পসংকলন (১৮৮৯-১৮৯১), উপন্যাস ‘ফোমা গর্দেইয়েভ’ (১৮৯৯) ও তিনজন (১৯০০), নাটক পাতি বুর্জোয়া (১৯০১), নীচের মহল (১৯০২) ও মরশুমি লোক (১৯০৪)।
গোর্কির এই সব রচনার মধ্যে বিপ্লবের সুর এত বেশি চড়া ছিল যে জার সরকারের পক্ষে তাঁকে বেশি দিন বরদাস্ত করা সম্ভব ছিল না। ১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানী পেতের্বুগে জারের শীত প্রসাদের সামনে যে শ্রমিক বিক্ষোভ ঘটে তার জেরে ঘটনার দু’দিন পরে গোর্কি গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হন। ততদিনে তিনি এতটাই বিখ্যাত যে শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বের বুুদ্ধিজীবীরা তাঁর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তার সরকার তাঁকে জামিনে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
১৯০৬ সালের ফেব্রæয়ারিতে গোর্কির ওপর নতুন করে গ্রেফতারি পরওয়ানার আশঙ্কা দেখা দিলে মার্চে তিনি রাশিয়া ত্যাগ করেন। গন্তব্যস্থল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলশেভিক পার্টি থেকে তাঁর ওপর বিদেশের শ্রমিকদের কাছে রুশ বিপ্লবের অন্তর্নিহিত সত্য উদ’ঘাটনের এবং বিপ্লবী সংগ্রামের জন্য অর্থসংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালেই তিনি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস মা ১৯০৬ এবং দুশমন ১৯০৬ নাটক রচনা করেন। যার খসড়া অবশ্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে ১৯০৩ সালে।
এক বছর কাটতে না-কাটতে আমেরিকা ছাড়তে হল। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে আর দেশে না ফিরে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত ইতালির কাপ্রি দ্বীপে বসবাস করতে থাকেন। এখানে বসেই লেখা হল মার দ্বিতীয় খন্ড। সমাজ পরিবর্তনে যথাসময়ে লেখা একটি সাহিত্যসৃষ্টি যে কী বিরাট অবদান রাখতে পারে মার চেয়ে তার বড়ো দৃষ্টান্ত বোধহয় পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে আর কোনো উপন্যাসই পৃথিবীর এত বেশি ভাষায় অনূদিত হয়ে এত বিপুল সংখ্যক পাঠক লাভ করেনি। কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যে এমন প্রবল ও প্রত্যক্ষ প্রভাবও বিস্তার করতে পারেনি। তার কারণ বিংশ শতাব্দীর নতুন সুরটা একমাত্র গোর্কিই ধরতে পেরেছিলেন-সেটা ছিল দিকে দিকে সুপ্ত জনতার জাগরণের যুগ।
মা উপন্যাস এবং দুশমন নাটকের দৃষ্টান্ত সামনে রেখেই আরও কয়েক দশক পরে, ১৯৩২ সালে সোভিয়েত আমলে, সোভিয়েত লেখক সংঘ থেকে ঘোষিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা নামে একটি নতুন শিল্পধারা। এই নতুন শিল্পতত্ত¡টা যে কী গোর্কি তাঁর খাপছাড়া নাটকের একটি কথোপকথনের মাধ্যমে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। নায়ক মাস্তাকভ নামে জনৈক লেখকের মুখে আমরা শুনি ওরা বলবে আমার বুড়ি চরিত্রটা মিথ্যে, আমি জানি ওরা তাই বলবে, গলা ফাটিয়ে বলবে, ওরকম মেয়েমানুষ কখনও হয় না। মানলাম, হয় না। ওরকম মেয়েমানুষ আজ নেই, কিন্তু কাল কেউ না কেউ হবে। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস কর? জবাবে নায়িকা বলে, হ্যাঁ, তুমি ওদের তাই হতে সাহায্য কর তাহলে ঠিকই হবে।
রুশ সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিল এই নতুন আন্দোলন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সোভিয়েত সাহিত্য নামে পরিচিত নতুন সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা তাই গোর্কি। সরকার-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ছিল, ১৯১৩ সালে রমানভ রাজবংশের ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে তাদের ওপর থেকে তা তুলে নেওয়া হলে লেনিনের আগ্রহতিশয্যে গোর্কি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন-তিনি নিজে অবশ্য এ ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর গোর্কি দেশের সাহিত্য ও রাজনীতির ক্ষেত্রে গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু এই সময় থেকে শুরু করে অক্টোবর বিপ্লবের মাঝখানে রাশিয়ায় যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটতে চলেছিল তার মূল্যায়ন নিয়ে বলেশেভিকদের সঙ্গে গোর্কির বড়ো রকমের মত পার্থক্য দেখা দেয়। তাঁর মনে হয়েছিল ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত নৈরাজ্যবাদী প্রাকৃতিক শক্তি বিপ্লবের অগ্রণী ভূমিকার পথ রুদ্ধ করে দিতে পারে। বিপ্লবের পর নতুন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে।
লেনিন তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অবাধ্য গোর্কির জনপ্রিয়তা শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে ১৯২১ সালে লেনিনের উদ্যোগেই আবার তাঁকে দেশ ছাড়তে হল-এ বারে স্বাস্থ্যোদ্বারের অজুহাতে। এ বারেও দীর্ঘকালের জন্য- সেই ইতালিতে। বেশ কিছুকালের মধ্যে- এমনকী মাঝখানে লেনিনের মৃত্যু হলে সেই সময়ও- দেশে আর পদার্পণ করলেন না। পরে ১৯২৮ সাল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিবছরই গ্রীষ্মকালে কিছু সময়ের জন্য রাশিয়া ঘুরে যেতেন। দেশত্যাগী তিনি কখনও হননি-বিদেশ থেকেও দেশের নবীন লেখক গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলতেন। তিনি সোভিয়েত লেখক সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৩৩ সালে তাঁর উদ্যেগে নবীন লেখকদের প্রশিক্ষণের জন্য মস্কোর গোর্কি সাহিত্য ই¯œটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘ আর্তামোনভ বৃত্তান্ত’ (১৯২৫) তাঁর এই পর্যায়ে লেখা উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাস। বিপ্লব- পূর্ববর্তী রাশিয়ার কয়েক শতাব্দীব্যাপী জীবনযাত্রার ব্যাপক চিত্র এই উপন্যাসে বিধৃত।
১৯৩৩ সালে ইতালির পাট চুকিয়ে পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসেন। জীবনের শেষ ৩ বছর তিনি সম্পাদনা, প্রকাশনা, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রচারপুস্তিকা রচনা, শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রচারণা ইত্যাদি কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন।
গোর্কি যে-কোনো বিষয় নিয়েই লিখুন না কেন, তাঁর রচনার মধ্যে যেমন আছে মানুষের বর্তমান রুপ প্রত্যক্ষ করে তার প্রতি প্রবল ধিক্কার, তেমনই আছে সেই মানুষেরই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা ভেবে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। ‘মানুষ’- এই কথাটাই না কত গৌরবের শোনায়।’ ‘নিচের মহল’ নাটকে সাতিন- এর এই উক্তির মধ্যেই গোর্কির রচনার মূল সুর ঝঙ্কৃত। গোর্কি যেমন আমাদের অতীত ও বর্তমান, তেমনই ভবিষ্যৎও। সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন