শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

হালদায় সুফল মিলছে

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত মিঠাপানির নদী ও অন্যতম মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদাকে বাঁচাতে এবং হালদার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে বহুমুখী পদক্ষেপের সুফল মিলছে। গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে ডিমের পরিমাণ যেভাবে কমে গিয়েছিল তাতে বড়ই শংঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এবার বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, সাগরের জোয়ার ও মেঘের গর্জন এবং হালদা রক্ষায় প্রশাসনের উদ্যোগসহ বিভিন্ন উদ্যোগের সমন্বয়ে ২০০৬ সালের পর বেশি ডিম দিল ‘মা’ মাছ। ২০০৬ সালে ৩২ হাজার ৭২৪ কেজি ডিম পাওয়ার পর এবার পাওয়া গেল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম। গত বছর তা ছিল মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি এবং এর আগের বছর শুধুমাত্র নমুনা থেকে নামকাওয়াস্তে ৭৩৫ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ১২ বছরে এবার সবচেয়ে বেশি ডিম মিলল হালদায়। তাই এ অঞ্চলের ডিম সংগ্রহকারীদের মাঝে খুশির বন্যা বইছে। দেশের অর্থনীতে সংগ্রহকৃত ডিম গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এক হিসেবে দেখা যায়, প্রায় পৌন চার হাজার কোটি টাকায় আহরিত রেনু বিক্রি হবে। সমৃদ্ধ হবে দেশের মৎস্য খাত।
জনশ্রæতি রয়েছে, পাহাড়ি অঞ্চলের সালদা গ্রামের সালদা নামক ছড়া থেকে হালদার নামকরণ। হালদা নদী পার্বত্য অঞ্চল খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার ১ নং পাতাছড়া ইউনিয়নের পাহাড়ি ক্রিক থেকে উৎপন্ন হয়ে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বয়ে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম শহরের চাঁদগাঁও হয়ে পড়েছে ইতিহাস খ্যাত আরেক নদী কর্ণফুলীতে। হালদা নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ দেশেই উৎপত্তি হয়ে এ দেশেই শেষ হয়েছে। সে হিসেবে এ নদী সম্পূর্ণপরূপে আমাদের। প্রায় ১০০ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে হালদা নদীতে মিলিত হয়েছে ৩৬টি ছড়া। এর মধ্যে খালের সংখ্যা ১৯টি। এটি পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে এবং নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদা বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। এ প্রাকৃতি জিনপুল বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর গুরত্ব অত্যাধিক। দেশের রুই-কাতলা, মৃগেল, কালিবাউসসহ সব ধরনের কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রকৃতিক উৎস হালদা। হালদা নদী কেবল প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য নয়, এটি ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যর যোগ্যতাও রাখে।
হালদা নদী এবং নদীর পানির কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসে, যা বংলাদেশের অন্যান্য নদী থেকে ভিন্নতর। এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক। ভৌত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নদীর বাঁক, অনেকগুলো পাহাড়ি র্ঝণা বা ছড়া। প্রতিটি ছড়ার উজানে এক বা একাদিক বিল, নদীর গভীরতা, কম তাপমাত্রা, তীব্র খরস্রোত এবং অতি ঘোলাত্ব। রাসায়নিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কম কন্ডাক্টিভিটি, সহনশীল দ্রবীভূত অক্সিজেন ইত্যাদি। জৈবিক কারণগুলো হচ্ছে বর্ষার সময় প্রথম বর্ষণের পর বিল থাকার কারণে এবং দুকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে নদীর পানিতে প্রচুর জৈব উৎপাদন মিশ্রণের ফলে পর্র্যাপ্ত খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে যা প্রজনন পূর্ব গোনাডের পরিপক্কতায় সাহয্য করে। অনেকগুলো পাহাড়ি ঝর্ণা বিধৌত পানিতে প্রচুর ম্যাক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান থাকার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুর সৃষ্টি হয়। এই সব বৈশিষ্ট্যর কারণে হালদা নদীতে অনূকুল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছকে বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে যা বাংলাদেশের অন্যান্য নদী থেকে আলাদা। হালদা নদীর বাঁকগুলোকে অক্সেবো বাঁক বলে। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, পানির প্রচন্ড ঘূর্ণন যার ফলে গভীর স্থানের সৃষ্টি হয়। স্থানীয়ভাবে গভীর স্থানগুলোকে কুম বা কুয়া বলা হয়। উজান হতে আসা বিভিন্ন পুষ্টি ও অন্যান্য পদার্থ কুমের মধ্যে জমা হয়। ফলে পানি অতি ঘোলা হয়। মা মাছেরা কুমের মধ্যে আশ্রয় নেয় এবং ডিম ছাড়ে।
বছরের বিশেষ সময় বিষেষ আবহাওয়ায়, বিশেষ তাপমাত্রায় ও লবণসহনীয়তায় কার্প জাতীয় মাছ এখানে ডিম ছাড়ে। বিশেষ করে উপযুক্ত সময়টা হচ্ছে বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাস। এ সময় পূর্ণিমা তিথিতে অঝোর বৃষ্টি ও মেঘের গর্জনের সময় মা মাছ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার এ বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা জো বলে। এ জো এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমাবস্যা বা পূর্ণিমা হতে হবে। সে সাথে প্রচন্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে। এ বৃষ্টিপাত শুধু স্থানীয়ভাবে হলে হবে না। তা নদীর উজানেও হতে হবে। এতে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। জো এর সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, নদীর জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা করা। পূর্ণ জোয়ার শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলকভাবে অল্প ডিম ছাড়ে। ডিমের অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে দেয়।
ডিম সংগ্রহের মৌসুমে হালদার দুপাড়ে সৃষ্টি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। দুপাড়ে সমবেত হয় দূর দূরান্ত থেকে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর। অতীত কাল থেকে হালদা নদীতে উৎসবমুখর এ পরিবেশ চলে আসছে। বিশেষ করে স্থানীয় জেলে ও ডিম সংগ্রহকারীদের আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। তারা সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকে আনন্দঘন এ সময়ের জন্য। জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারি থেকে শুরু হয় ডিম ধরার প্রস্তুতি, এসময় পুকুর তৈরি, কুয়া খনন, নৌকা মেরামত ও পার্টনার সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে। মে-জুলাই মাসে ডিম সংগ্রহের পর রেণুর পরিস্পুরণ, পরিচর্যা, পোনা বিক্রয় চলতে থাকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা বছরের এ ৭/৮ মাস কর্মব্যস্থতায় দিন অতিবাহিত করে।
দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা একটি মা মাছের অবদান পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, হালদা আমাদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক আশীর্বাদস্বরূপ। গবেষকদের মতে, একটি কাতলা মাছ তৃতীয় বছর বয়স থেকে পরিপক্কতা লাভ করে ডিম দেওয়া শুরু করে। কাতলা মাছের ডিমের সংখ্যা ১৫ লক্ষ থেকে ৩৫ লক্ষ (৫ কেজি থেকে ২০ কেজি ওজন) সুতরাং গড় সংখ্যা ২৫ লক্ষ। একটি মা মাছ থেকে এক বছরে চার ধাপে আয় করা যায়। সে মতে, ৫ বছরে অর্থনীতিতে একটি মাত্র মাছের অবদান হিসাব করলে দেখা যায়, মাছটি মোট ১৯ কোটি ৮৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দান করেছে আমাদের অর্থনীতিতে। হালদা নদীতে বিগত ১০ বছর ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত প্রাপ্ত রেনুর পরিমাণ হিসাব করলে দেখা যায় গড় রেনু প্রাপ্তির পরিমাণ ৬০৪.৬৪ কেজি (পোনার সংখ্যা = ৩০ কোটি ২৩ লক্ষ ২০ হাজার)। একই পদ্বতিতে এক বছরে চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮২১ কোটি ১০ লক্ষ ১১ হাজার ২শত টাকা, যা দেশের মৎস্য উৎপাদনের ৬%। সুতরাং সহজেই বুঝা যায়, ডিম সংগ্রহ করে শত শত লোকের জীবিকা অর্জনসহ দেশের অর্থনীতিতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে হালদা নদী।
এ নদী মিঠা পানির অন্যতম উৎস। কর্ণফুলীকে ভরা মৌসুমে পঞ্চাশভাগে পানি সরবারহ করে এ নদী। জোয়ার-ভাটার এ নদীর মিঠাপানি কর্ণফুলীর লবণাক্ততাকে সহনীয় পর্যায়ে রেখে জনমানবের কল্যাণ করছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এ নদীর পানিই চট্টগ্রাম ওয়াসার মাধ্যমে শোধন করে নগরবাসীর জন্য সরবারহ করা হয়ে থাকে। যে ২২ কোটি লিটার পানি ওয়াসা সরবারহ করে তার শতকরা ষাট ভাগ হলো হালদার পানি। এ নদীর তীরবর্তী কয়েক লাখ মানুষের যাতায়াত ও চাষাবাদ এবং জল সেচের মধ্য দিয়ে এ নদী এ অঞ্চলের মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির সাথে শত বছর ধরে সংশ্লিষ্ট। উভয় পাড়ের মানুষের কৃষিকাজ, জীবন-জীবিকা প্রভৃতি মিলিয়ে বছরে প্রায় ১০ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা আয় হয় নদীকে ঘিরে। নদী হিসেবে এককভাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে হালদা। এত গুরত্বপূর্ণ হওয়া সত্তে¡ও নদীটি বিভিন্নভাবে তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দখল-দূষণসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন আজ এ নদীটি। তথ্য সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের ট্যানারী ও বিভিন্ন কলকারখানার বিশাক্ত কালো বর্জ্য ও বিভিন্ন হাটবাজারের ময়লা আবর্জনা হালদায় গিয়ে পড়ে। এতে নদীটি ভরাট হওয়ার পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। এ অবস্থা রোধ করা না গেলে নদীটি মৃত নদীতে পরিণত হবে।
এ ব্যাপারে হালদা বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরীয়া বলেন, ট্যানারী থেকে থেকে যেভাবে দূষিত বর্জ্য হালদা নদীতে পতিত হচ্ছে এতে হালদার জীববৈচিত্র্য কখনও রক্ষা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, হালদাকে রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তা না হলে হলে হালদাকে রক্ষা সম্ভব হবে না।
তবে সুখবর এই যে, অনেক দেরিতে হলেও সরকার হালদাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করতে যাচ্ছে। পরিবেশগত যদি কোন এলাকার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয় তখন পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তখন সে এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণার জন্য সুপারিশ করা হয়। ইসিএ ঘোষিত হলে সংশ্লিষ্ট এলাকাটিকে রক্ষায় অনেকগুলো আইন হয়। সে আইনগুলো মেনে চললে এলাকটি রক্ষা হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Kamal Pasha ৭ মে, ২০১৮, ১:০৮ পিএম says : 0
আলহামদুলিল্লাহ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন