দুই \
খুলাফায়ে রাশেদার যুগের পরিসমাপ্তির সাথে সাথে বায়তুলমাল নামক প্রতিষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। উপরে বলা হয়েছে যে, উমাইয়া যুগে এ প্রতিষ্ঠানটি ‘দিওয়ানে খারাজ’ নামে নতুন নাম ধারণ করে এবং এর আয়ের উৎস ও কর্মপরিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। আব্বাসীয়দের সময়ও এটি ‘দিওয়ানে খারাজ’ নামে পরিচিত ছিল। তখন এর আয় ও ব্যয়ের পরিধি আরো ব্যাপকতা লাভ করে। জনগণের কল্যাণের চেয়ে যুদ্ধ, প্রতিরক্ষা সীমান্ত রক্ষা, সাম্রাজ্যের অবকাঠামো উন্নয়ন, বিলাসিতা ইত্যাদি উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলীফাদের কাছে প্রাধান্য লাভ করে।
আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বায়তুলমালের অনুরূপ প্রতিষ্ঠান হলো ‘পাবলিক ট্রেজারি’ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে এর আয় ও ব্যয়ের উৎস ভিন্ন ভিন্ন। সরকারের রাজস্ব বিভাগ, বৈদেশিক দান-অনুদান, বৈদেশিক ঋণ, ভ্যাট, আমদানী-রপ্তানী শুল্ক, প্রাকৃতিক সম্পদ প্রভৃতি বহু খাত থেকে আধুনিক রাষ্ট্র আয় করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তা ব্যয় করে। মহাহিসাবররক্ষণ কর্মকর্তার অধীনে সরকারি একটি বিভাগ এগুলোর হিসাব সংরক্ষণ করে। অন্যদিকে খুলাফায়ে রাশেদার সময় সকল আয় বায়তুলমালে জমা হতো। এবং সেখান থেকে সকল ব্যয় নির্বাহ করা হতো। খিলাফাতের প্রয়োজনীয় ব্যয় মিটানোর পর অতিরিক্ত অর্থ সাধারণের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হতো।
যদিও বায়তুলমাল খলীফা এবং তার প্রতিনিধিদের হিফাযতে থাকত, কিন্তু বায়তুলমারের অর্থের ওপর ব্যক্তিগতভাবে খলীফার অধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত। প্রকৃতপক্ষে তিনি বায়তুল মালের আমীন (রক্ষণাবেক্ষণকারী) ছাড়া কিন্তুই ছিলেন না। তাঁর হাতে মুসলিম জনসাধারণের সম্পত্তি আমানত হিসেবেই থাকত। মালিক ইব্ন আওস বর্ণনা করেন যে, ‘উমর ফারূক রা. তিনটি বিষয়ে শপথ করেছেন।
তিনি বলেছেন: আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, বায়তুলমালের সম্পদে কেউ অপরের তুলনায় অধিক হকদার নয়। আমি নিজেও অপর কারও তুলনায় অধিক হকের দাবিদার নই। আল্লাহ্র কসম! প্রত্যেক মুসলিমেরই এ সম্পদে নির্দিষ্ট হক বা অধিকার রয়েছে। আল্লাহ্র কসম! আমি যদি বেঁচে থাকি, তা হলে সান‘আ পর্বতের রাখাল নিজ স্থানে পশু চরানোর কাজে ব্যস্ত থেকে তার নিজের অংশ লাভ করতে পারবে। ‘উমর রা. এর এ উক্তি প্রসংগে ইমাম শাওকানী র. বলেছেন, এটা এ বিষয়ের দলিল যে, রাষ্টীয় অধিকার প্রশ্নে মুসলিম শাসক সাধারণ মানুষের মতই। গনিমতের সম্পদ প্রভৃতি থেকে তাকে আগে অথবা বেশি দেয়া যায় না। একই ভাবে এ কথারও দলিল যে, ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনস্ত প্রত্যেক মানুষ সে যতদূরেই থাকুক না কেন এবং তার মর্যাদা ও অবস্থান যত ছোটই হোক না কেন সে সামষ্টিক সম্পদ থেকে অবশ্যম্ভাবীরূপে তার হক ও প্রয়োজনানুযায়ী তার অংশ পেয়ে যাবে।
উমর রা. আরো বলেছেন ঃ গ্রীষ্মের এক জোড়া কাপড়, শীতের এক জোড়া কাপড়, নিজ পরিবারের জন্য কুরাইশের একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির সমপরিমাণ অর্থ ছাড়া আল্লাহর সম্পদের মাধ্যে অন্য কিছুই আমার জন্য হালাল নয়। আমিতো মুসলিমদের একজন সাধারণ ব্যক্তি বৈ কিছুই নই। ফারূকে আযম রা. খালিদ রা. -কে লিখে পাঠিয়েছিলেন: ‘এ ধন মাল সরকারি ব্যবস্থাধীন। তা একান্তভাবে গরীব জনগণের জন্য এবং তা তাদের জন্য জমা রেখে তাদের জন্যই ব্যয় করতে হবে’। বস্তুত ‘উমর রা. পূর্বে উল্লিখিত রাসুলুল্লাহ স. এর বাণীর ভিত্তিতেই এ কথা বলেছেন এবং তাঁর ন্যায় চতুর্থ খলীফা আলী রা. এ অর্থই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনিও বলেছেন: জেনে রাখ, তোমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ধন-মালের (বায়তুলমাল) চাবি আমার নিকট রক্ষিত। আরো জেনে রাখ যে, তা থেকে তোমাদেরকে বাদ দিয়ে বা বঞ্চিত করে একটি পয়সাও গ্রহণ করার অধিকার আমার নেই।
বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালে সঞ্চিত ধন-সম্পদের ওপর সর্বÑসাধারণের সাধারণ অধিকার স্বীকৃত। রাষ্টের সীমার মধ্যে কোন একজন নাগরিকও যাতে মৌলিক প্রয়োজন হতে বঞ্চিত না থাকে, তার ব্যবস্থা করা বায়তুলমালের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। তার অর্থ এ নয় যে, বায়তুলমাল লোকদেরকে বেকার বসিয়ে খাওয়াতে থাকবে বরং লোকেরা সাধ্যানুযায়ী কাজ করবে, উপর্জন করবে, সমাজের সচ্ছল অবস্থার লোকেরা তাদের দারিদ্র নিকটাত্মীয় ও পাড়া প্রতিবেশীর প্রয়োজন পূরণ করবে। তারপরও যদি কেউ তার মৌলিক প্রয়োজন পূরণে অক্ষম থেকে যায়, তাহলে তা পরিপূরণে দায়িত্ব হবে বায়তুলমালের।
ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের অপূরণীয় মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রেনায়কের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে ঘোষিত হয়েছে। যে রাষ্ট্রনায়ক এ কাজ করে না, মনে করতে হবে, সে এ দায়িত্ব পালন করছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন