বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

বিদ্বেষ ছড়ানো এবং রক্তাক্ত এ নির্বাচনের কী প্রয়োজন ছিল

প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ
বাংলাদেশের মানুষের মনকে পলি মাটির সাথে তুলনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, পলি মাটি যেমন নরম ও কোমল তেমনি শুকালে তা পাথরের মতো কঠিন হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মানুষের মনও নরম তবে ভিন্ন পরিস্থিতিতে তা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। এখন যে দিনকাল পড়েছে, তাতে মানুষের মনের চরিত্র বদলে গেছে। অধিকাংশ মানুষের মন সবসময় কঠিন হয়েই থাকে। মানুষের মৃত্যু বা নৃশংস খুনও খুব একটা আলোড়িত করে না। কঠিন হয়ে ওঠা মনে রেখাপাত করে না। বড়জোর একটু অবাক হয়। যেন এটাই স্বাভাবিক। প্রতিদিন মানুষ খুন হবে, অপহৃত হবে, পিতার হাতে স্ত্রী-সন্তান, পুত্রের হাতে পিতা-মাতা, মাতার হাতে সন্তান খুন হবে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে, নিগৃহীত হবেÑ এ নিয়েই চলতে হবে। এতে বিস্মিত বা অবাক হওয়ার কিছু নেই। রোজকার ব্যাপার। অথচ এদেশের মানুষের মূল চরিত্র এমনটি নয়। সে অন্যের বিপদে এগিয়ে যায়, সমব্যথী হয়, কেউ খুন হলে মর্মাহত হয়, শিউরে উঠে, কোনো নৃশংস ঘটনায় নিজের কিছু করার না থাকলেও দূর থেকে নিন্দা ও ক্ষোভ জানায়। আশপাশের মানুষের সাথে বেদনা শেয়ার করে, আলোচনা করে, নিজে সচেতন হয়, অন্যকেও সচেতন করে তোলে। মানুষের এ সুকুমার বৃত্তি ও মানবিক গুণে যেন ঘুণে ধরেছে, ভোঁতা হয়ে গেছে। ঘটনা যতই নৃশংস হোক, আগের মতো আর তাদের আলোড়িত করে না। মাঝে মাঝে কোনো কোনো মৃত্যু অবশ্য কিছু সময়ের জন্য নাড়া দেয়। এই যে মানুষের মনকে শক্ত করে তোলা হচ্ছে, এর জন্য কি তারাই দায়ী নাকি তাদের যারা শাসন করছে তারা দায়ী? এ প্রশ্নের উত্তর ব্যাপক ও বহু আলোচনার বিষয়। এ নিবন্ধে সে আলোচনায় না গেলেও পাঠক এ আলোচনা থেকে কিছুটা উত্তর পেতে পারেন।
এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। যেসব মৃত্যু হচ্ছে তার বেশির ভাগই হত্যাকা-। প্রতিদিনের পত্র-পত্রিকা দেখলেই বোঝা যায়, স্বাভাবিক মৃত্যুর খবর খুব কমই আছে। প্রতিদিন এত এত হত্যাকা- ঘটছে যে, আমাদের মন তা সয়ে যায়। খুব বেশি নাড়া দিতে পারে না। একসঙ্গে ডাবল, ট্রিপল, সেভেন মার্ডার না হলে কঠিন হয়ে পড়া মনের ভিত কাঁপে না। এসব হত্যাকা- নিয়ে পত্র-পত্রিকায় কিছু দিন তুমুল হইচই হয় এবং আমরাও আলাপ-আলোচনা করি, তারপর ধীরে ধীরে তা মিইয়ে যায়। মিইয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। শোক নিয়ে মানুষ বেশি দিন বসবাস করতে পারে না। যত কঠিন শোকই হোক না কেন এক-দুই সপ্তাহের মধ্যেই তা কেটে যেতে থাকে। নিহত ব্যক্তি বা ঘটনা স্মৃতির খাতায় ঠাঁই নেয়। তারপর স্বাভাবিক ব্যস্ততায় আমরা ফিরে যাই। আরেকটা বড় ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত যেন নিশ্চল থাকি। এই যে ধাপে ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে, এর জেরে এ পর্যন্ত কত মানুষ যে তার স্বামী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছে, তার সঠিক খবর কি আমরা জানি? যতটুকু জানি, তা পত্র-পত্রিকার খবর থেকে জানি। নিহত হয়েছে গোটা ৪০ আর আহত হয়েছে পাঁচশর মতো। এর বাইরে যে আরও আহত-নিহত রয়েছে, তা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। গাঁও-গেরামের এসব মানুষের মৃত্যু কি আমাদের খুব একটা নাড়া দিচ্ছে? মনে হয় না। আমরা খবরগুলো জানছি, তারপর ভুলে যাচ্ছি। এ নিয়ে খুব একটা আলোচনাও করছি না। কারণ এসব ঘটনা আমাদের মনকে বহুদিন ধরেই আঘাত করতে করতে অনেকটা পাষাণে পরিণত করেছে। আমাদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ এমন স্বার্থপর প্রবাদটিকে খুব বেশি করে আঁকড়ে ধরতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।
দুই.
সমাজে এখনো কিছু সচেতন মানুষ রয়েছেন। যারা বিশিষ্ট তারা টকশোতে গিয়ে মানুষ হত্যাকা-ের বিষয়ে কথা বলেন। যারা আত্মসচেতন তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তবে তাদের সংখ্যাটা খুব কম। ইউপি নির্বাচনে যে এত অনিয়ম, কারচুপি, জবরদখল, প্রতিপক্ষকে ভোটের মাঠছাড়া, বাড়িছাড়া, নিরবংশ করে দেয়ার হুমকি সর্বোপরি সংঘাত-সংঘর্ষে মানুষের মৃত্যুÑ এসব ঘটনা নিয়ে কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন। তাতে অবশ্য খুব বেশি ‘লাইক’ পাওয়া যায় না। এর কারণ ফ্রেন্ডদের এসব খুন-খারাবির কথা ভালো লাগে না। মৃত্যুকে যতভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় ততই ভালো। মন খারাপ করে লাভ কি! এর চেয়ে নিজের প্রতি মুহূর্তের বিভিন্ন ভঙ্গির ছবি আপলোড করে ‘লাইক’ পাওয়ার আনন্দের মধ্যে ডুবে থাকাই ভালো। এমন এক উদাসীনতায় যেন আমরা ডুবে আছি। তারপরও যারা প্রতিবাদ করেন, তারা থেমে যান না। প্রতিবাদ করেন এবং উদাসীন হয়ে যাওয়া মানুষের মনে টোকা দিতে থাকেন। ইউপি নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে উদ্দেশ করে এক সচেতন ব্যক্তি তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘স্যার, যে নির্বাচনে এত মানুষ মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে, বাড়িঘর ধ্বংস হচ্ছে, মা-বাবার বুক খালি হচ্ছে, এ নির্বাচন করার কী দরকার ছিল! নির্বাচনের আগে আমরা তো ভালোই ছিলাম। নির্বাচন না দিলে কী হতো!’ তার এ কথার তাৎপর্য অনেক। আসলেই তো, ইউপি নির্বাচন না হলে কী হতো! কিছুই হতো না। মানুষ মরত না, বাড়িঘর, সহায়সম্বল ধ্বংস হতো না। মানুষ শান্তিতেই থাকত। গ-গোলের মূল হয়ে দাঁড়াল নির্বাচন কমিশনের তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক দুর্লভ আকাক্সক্ষা! যেন তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে, তাদের অকর্মণ্যতা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেবে। কাজেই নির্বাচন করতেই হবে। অথচ বাংলাদেশে এমন অনেক নজির রয়েছে, মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বছরের পর বছর স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন হয়নি। তাতে এমন কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। বরং মানুষের জীবন বেঁচেছে, বাড়িঘর মালামাল রক্ষা পেয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, নির্বাচন কমিশনের এই নির্বাচন যেন গ্রামের মানুষের ওপর এক অভিশাপ হয়ে এসেছে। তাদের প্রাণ যাচ্ছে, প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে নির্বাচন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সে নির্বাচন কি মানুষ চায়? এ প্রশ্নের জবাবে নিশ্চিতভাবেই একবাক্যে সবাই বলবেন, এক নির্বাচন কমিশন ছাড়া আর কেউই চায় না। আর কে না জানে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার মুরোদ এ নির্বাচন কমিশনের কোনোকালেই ছিল না। এমনকি তাদের লাজ-লজ্জা ও হায়া, মায়া-মমতা, বিবেক বলে যে কিছু নেই, তাও সবাই জানে। একবার তো বিশেষজ্ঞদের দেয়া ‘মেরুদ-হীন নির্বাচন কমিশন’ খেতাবের জবাব দিতে গিয়ে এক নির্বাচন কমিশনার ক্লাউনের মতো সাংবাদিকদের সামনে পিঠ টানটান করে দেখিয়ে বলেছিলেন, এই দেখেন আমার মেরুদ- সোজা। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নির্বাচন কমিশন যদি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে অক্ষম ও অপারগ হয়, তবে তার নির্বাচন করার চেয়ে চুপচাপ বসে থাকাই ভালো। এই অক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন করার অর্থই হচ্ছে আগুন নিয়ে খেলা করা। এতে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়, সংঘাত-সংঘর্ষ বাধে, মানুষ হত্যার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ইউপি নির্বাচনে এর সবকিছুই আমরা দেখছি। নির্বাচনের নামে গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। রক্ত বইয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই খবরের কাগজের পাতা ভরে এসব সংবাদ আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুটি ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, খুবই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় মানুষের আহত-নিহত হওয়া ও বাড়িঘর ধ্বংস এবং সম্পদ যে হানি হয়েছে, তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই। হ্যাঁ, একটা বক্তব্য তার কাছ থেকে এসেছে। বলেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাকি তার কথা শুনছে না। কী বিচিত্র কথা! ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই’ এমন নিধিরাম সর্দারের মতো নির্বাচন কমিশন কি সারা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে? মানুষ জানে, নির্বাচনের সময় সংশ্লিষ্ট সব প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকে। কমিশন যা বলবে, প্রশাসন তা করতে বাধ্য। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে কমিশন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই ক্ষমতা তার রয়েছে। অথচ নির্বাচন কমিশনই কিনা বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কথা শুনছে না। তাহলে এই নির্বাচন কমিশনের কি নির্বাচন করার কোনো অধিকার থাকে? নির্বাচনের নামে এই কমিশন যে মানুষের জীবন ও ভোটাধিকার এবং বাংলাদেশের পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে দিচ্ছে, এর দায় কি সে নেবে না?
তিন.
বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যুগ যুগ ধরেই হয়ে আসছে। তবে এবারের মতো এত সংঘাত-সহিংসতা, প্রাণহানি, বল প্রয়োগ ও রক্তারক্তি আগে কখনো ঘটেনি। আমরা জানি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সাধারণত গ্রামের প্রভাবশালী পরিবার থেকেই বেশির ভাগ প্রার্থী হয়ে থাকে। দলীয় প্রতীক না থাকা এবং যে যে দলের আদর্শের হোক না কেন, দলের চেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। আদর্শের মিল না থাকলেও শুধু ব্যক্তি ইমেজের কারণে বিএনপির সমর্থকরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে, আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন জানাত। এটা অনেকটা পারিবারিক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার কারণেই করা হতো। এতে প্রার্থী হেরে গেলে মন খারাপ হতো, জিতলে আনন্দিত হতো। মাঝে মাঝে পরাজিত প্রার্থী ও তার সমর্থকরা হয়তো উত্তেজনার বশে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত, তবে তা গ্রামের মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে অল্প সময়েই প্রশমিত হয়ে আসত। এ নির্বাচন অনেকটা সবাই মিলে একটি পরিবারের অভিভাবক নির্বাচনের মতো ছিল। এটাই বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের স্বাভাবিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি এবার পুরোপুরিই ভেঙে দেয়া হয়েছে। সরাসরি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন দেয়াতে নির্বাচন যেন একেকটি ইউনিয়নে অগ্নিচুল্লিতে পরিণত হয়েছে। এটা সবাই জানেন, আদর্শের প্রতীক যখন সরাসরি চলে আসে, তখন মানুষ যার যার আদর্শ নিয়ে পুরোপুরি বিভক্ত হয়ে পড়ে। আদর্শ সেটা মন্দ হোক আর ভালো হোক, এ ক্ষেত্রে তার অনুসারীরা কোনো আপস করে না। অনেকে বলেন, আগে ভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন হলেও অনেকটা দলীয় আবহেই নির্বাচন হতো। কাজেই সরাসরি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করাই ভালো। তাদের এ যুক্তি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ বা গ্রাম পর্যায়ের নির্বাচনে। আগে ভিন্ন প্রতীকে দলীয় আবহে নির্বাচন হলেও মানুষ আদর্শ বিবেচনা না করে ভালো মানুষটিকেই বেছে নিত। প্রার্থীর আদর্শ পর্দার অন্তরালে থাকত এবং তিনি জিতে গেলে অন্য আদর্শের মানুষ ও দলের কাছে প্রেস্টিজ ইস্যু হতো না। এখন সরাসরি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়াতে দল যদি একজন ক্রিমিনালকে মনোনয়ন দেয়, তবে অপছন্দ হলেও দলের প্রেস্টিজের কথা বিবেচনা করে সমর্থকরা তাকে মেনে নেয়। তাকে জিতিয়ে আনতে প্রয়োজনে প্রশাসনের সহায়তায় প্রতিপক্ষকে বিতাড়িত করা, হুমকি-ধমকি দেয়া, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, ভোটের বাক্স আগেভাগে ভরে ফেলা, ব্যালট ছিনতাই থেকে শুরু করে যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করে না। এখানে কে ভাই আর কে দুলাভাই, কে খালু, চাচা, মামা, দাদাÑ আত্মীয়তার এসব সম্পর্ক তুচ্ছ হয়ে যায়। আগে ভোটে জিতি, পরে আত্মীয়তা দেখা যাবেÑ তাদের মধ্যে এমন মনোভাব সৃষ্টি হয়। এবারের ইউপি নির্বাচনে এই ধারাটাই লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। এতে যে কত বড় সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে, তা সরকার ও নির্বাচন কমিশন বুঝতে পারছে কিনা, তা আমরা জানি না। গ্রামের মানুষের মধ্যে সুদীর্ঘকালের যে সদ্ভাব ও সুসম্পর্ক, এই এক নির্বাচন তা ধ্বংস করে দিচ্ছে। কারণ দুই পক্ষের সংঘর্ষে যে পক্ষের মানুষ মারা যাচ্ছে ও ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হচ্ছে, তারা কি নির্বাচনের পর এই ক্ষতির কথা ভুলতে পারবে? যার হামলায় যে বাড়ির মানুষ মারা গেল, তারা কি কোনো দিন তাকে ক্ষমা করতে পারবে? যে আহত হয়েছে, পঙ্গুত্ববরণ করেছে, যার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এসব মানুষ কি তাদের অতি পরিচিত হামলাকারীদের সাথে পুনরায় সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে? তারা যদি আত্মীয়-স্বজনও হয়, তাহলেও কি সম্পর্ক জোড়া লাগবে? এই যে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণে ঘরে ঘরে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার বীজ বপন করে দেয়া হলো, এতে আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থার যেটুকু মূল্যবোধ অবশিষ্ট ছিল, তা কি আরও নাজুক করে তুলল না? চিরায়ত গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার সম্প্রীতিতে এই যে চিড় ধরিয়ে দেয়া হলো, এর দায় কি বর্তমান নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারবে? দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার আগে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা কি উচিত ছিল না? আর নির্বাচনই যদি করা হবে, তবে নির্বাচন কমিশন কেন চুপ করে বসে থাকবে? কেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বলতে হয়, নির্বাচন কমিশন নড়েও না চড়েও না। কেন তাকে আকুতি জানিয়ে বলতে হবে, একটা কিছু কর গোলাপি, একটা কিছু কর। নির্বাচন কমিশনের এই স্বেচ্ছা অসহায়ত্ববরণ করা কি বরদাশতযোগ্য হতে পারে? অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি, নির্বাচন কমিশন দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পর সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, নির্বাচন প্রথম ধাপের চেয়ে সুষ্ঠু হয়েছে। মানুষের প্রাণহানি কম হয়েছে। কী অদ্ভুত কথা! যেখানে একজন মানুষেরও প্রাণাহানি হওয়ার কথা নয়, বাড়িঘর ধ্বংস হওয়ার কথা নয়, সেখানে মানুষ কম মরেছে, এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে!
চার.
২০০৫ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমাধিস্থ করার জন্য যে কফিন বানানো হয়েছিল, এবারের চলমান ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে তাতে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে, এটা বোধকরি সবাই স্বীকার করবেন। এ নির্বাচন এখন গণতন্ত্রের ‘শবযাত্রা’ ছাড়া কিছু নয়। শুধু দাফন করা বাকি। তবে নির্বাচন শেষে যে দাফন হয়ে যাবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। থেকে যাবে শুধু গ্রামে গ্রামে শোকের মাতম, পুত্রহারা পিতা-মাতার আহাজারি, সম্বলহারা মানুষের চোখের পানি, রক্তাক্ত জনপদ এবং এ রক্তের পথ হেঁটে তথাকথিত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। রক্তাক্ত পথের ওপর দাঁড়িয়েই সাধারণ মানুষ কাঁদবে আর জনপ্রতিনিধি নামক কিছু মানুষ মুখে মানুষের সেবা ও গণতন্ত্রের কথা বলবেন, অন্তরে শোষণের পরিকল্পনা করবেন। আমাদের দেশে ভোটারবিহীন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জোর করে নির্বাচিত হওয়া এবং গ্রামের মানুষের সম্প্রীতির বন্ধনকে সংঘাতে রূপ দেয়ার সংস্কৃতি চালুর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে যেভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হলো, তা আবার কবে নিরাময় শেষে উঠে দাঁড়াবে, আমরা জানি না। যে বিপুল সংখ্যক ভোটার একের পর এক নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি বা ভোট দিতে দেয়া হয়নি, তারা আবার কবে ভোট দিতে পারবে বা আগ্রহী হবে কিনা, তাও অনিশ্চিত। তবে এটা নিশ্চিত, মানুষের ভোটের অধিকার, স্বতঃস্ফূর্ত মতামত প্রকাশের অধিকারকে যারা অপমান করে চলেছে, জনগণ তাদের কখনো ভুলবে না, ক্ষমা করবে না।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন