মুন্শী আবদুল মাননান
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) যেভাবে পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশী হত্যা করে বিশ্বের আর কোনো সীমান্তে সেভাবে মানুষ হত্যা করার নজির নেই। সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের জানমালের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই। শুধু হত্যাকা-ই নয়, বিএসএফ যখন তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, গরু-ছাগল ও ফসলাদি লুট করে, মেয়েদের ওপর নির্যাতন চালায়, কখনো বা অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ অবস্থা চলছে বছরের পর বছর ধরে। এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বহু আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের তরফে হত্যা- নির্যাতন-অনুপ্রবেশ বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে আশ্বাস বাস্তবায়িত হতে দেখা যায় নি। একবার এক আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এ মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ‘মৃত্যুর উপত্যকায়’ পরিণত হয়েছে। খবরে এ-ও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, প্রতি বছর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যত মানুষ নিহত হয়, বিশ্বের আর কোনো সীমান্তে তত মানুষ নিহত হয় না।
সীমান্ত এখনো মৃত্যুর উপত্যকাই হয়ে আছে। মাঝে-মধ্যেই সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা ঘটছে। কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। বহুল আলোচিত ফেলানী হত্যার কথা অনেকের স্মরণ থাকার কথা। দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় এ ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। বিএসএফের সদস্যরা কতটা অমানুষ, নিষ্ঠুর ও বেপরোয়া হতে পারে, ওই ঘটনাটি ছিল তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকদের ধারণা, সীমান্তে বিএসএফের প্রতিটি হত্যাকা-ের যদি পক্ষপাতহীন তদন্ত হতো, ঘাতকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হতো, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো, তাহলে সীমান্তে হত্যাকা- নিত্যকার সাধারণ ঘটনায় পরিণত হতো না। বিস্ময়কর বাস্তবতা এই যে, আজ পর্যন্ত বিএসএফের হত্যাকা-ের একটিরও কোনো তদন্ত ও বিচার হয়নি। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ফেলানী হত্যার বিচারের নামে একটা বড় ধরনের প্রহসন হয়েছে। দু-দু’বার বিচার হলেও ঘাতক বিএসএফ সদস্যের কোনো শাস্তি হয়নি। তার দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। আইনের শাসন বলবৎ থাকলে অপরাধ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কমে যায়। অপরাধীরা সতর্ক ও সাবধান হয়ে যায়। শাস্তির ভীতি তাদের অপরাধ সংঘটনে বিরত রাখে। যখন বিচারহীনতা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়, যখন আইনের শাসন যথাযথভাবে কাজ না করে তখন অপরাধ ও অপরাধীরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সীমান্তে এই বাস্তবতাই আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যক্ষ করছি।
সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা, আমাদের আজকের লেখার বিষয় নয়। মূল বিষয়ে প্রবেশের জন্য এটি ভূমিকা মাত্র। সীমান্ত অরক্ষিত, মানুষ হত্যা নিত্য ঘটনা যা সীমান্তকে মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত করেছে। ওয়াকিবহাল মহল অবশ্যই লক্ষ্য করে থাকবে, কেবল সীমান্ত নয়, গোটা বাংলাদেশই এখন অরক্ষিত হয়ে পড়েছে; তার নাগরিকদের কোনো নিরাপত্তা নেই। দেশটাই যেন এখন মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে। কে যে কখন দুষ্কৃতী ও সন্ত্রাসীদের শিকার হবে, শিকার হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর, তার কোনো ঠিক নেই। খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা অবলীলায় সংঘটিত না হচ্ছে। ভাইয়ের হাতে ভাই, পিতার হাতে পুত্র, পুত্রের হাতে পিতা বা মাতা, মাতার হাতে পুত্র বা কন্যা, বন্ধুর হাতে বন্ধু, স্ত্রীর হাতে স্বামী, স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে প্রতিপক্ষ, ব্যবসায়ীর হাতে ব্যবসায়ীও খুনের শিকার হচ্ছে। বলা যায়, খুনের একটা সয়লাব চলছে। গত কিছুদিনে শিশুহত্যা ব্যাপক নাগরিক উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র গত তিন মাসের একটি চিত্র তুলে ধরেছে তার এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৩২ জন নিহত হয়েছে। তাদের ১৫ জন র্যাবের গুলিতে, ৮ জন পুলিশের গুলিতে ও ৯ জন ডিবি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। এ সময় ১৬ জনকে সাদা পোশাকধারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে, যাদের মধ্যে ৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্য তাদের আটকের কথা অস্বীকার করেছে। তিন মাসে ১৫২ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩৭০ শিশু। এ সময়ে ২৮০টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। ঐসব ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩৫ জন কর্মী নিহত ও ৩,৮৭৬ কর্মী আহত হয়েছে। একই সময়ে ৩৩ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছে। ওদিকে এ সময়ে বিএসএফের গুলিতে ৪ জন নিহত ও ১৩ জন বাংলাদেশী আহত হয়েছে। কারা হেফাজতে এ সময় মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ১০ নারী, ১৮ গৃহকর্মী হয়েছে নির্যাতনের শিকার। একই সময়ে ১০ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪৬ নারী। ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে ১০ নারীকে। দু’জন ধর্ষিতা আত্মহত্যা করেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই তথ্য-পরিসংখ্যান চিত্র সব নয়, এর বাইরেও অনেক কিছু আছে, যা জানার বাইরে কিংবা জানলেও অনেকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে শত শত। হামলা, ভাংচুর, সন্ত্রাসের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। পৌরসভা নির্বাচনকে নির্বাচন না বলে দখলবজই বললেও কম বলা হয়। এই দখলবাজিতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই প্রধানত জড়িত। তারা বিনা ভোটে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চায়। এ জন্য বিরোধীদলের লোকদের তারা মাঠ ছাড়া করার সব ব্যবস্থাই নিয়েছে। আইন-শৃংখলা বাহিনী তাদের পক্ষেই ভূমিকা রেখেছে। দেখা গেছে, পৌরসভা নির্বাচনের গেল দুই পর্বে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ও নৌকা প্রতীক পাওয়া প্রার্থী ও বিদ্রোহী ও প্রতীক বঞ্চিত প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যেই অধিকাংশ সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। যারা হতাহত হয়েছে তাদের একাংশ ক্ষমতাসীন দলের লোক। বাকীরা সাধারণ মানুষ। এদের সংখ্যাই বেশী এবং এরা ঘটনা ও পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। দেখা গেছে, নির্বাচন কেন্দ্রিক সংঘাত-সংঘর্ষের সময় আইন-শৃংখলা বাহিনী গুলি চালিয়েছে এবং এতে অনেকে হতাহত হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি আইন শৃংখলা বাহিনীর। সংঘাত-সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা রোধ কিংবা আইন-শৃংখলা রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত আইন-শৃংখলা বাহিনীকেই দায়ী করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইন-শৃংখলা বাহিনী তার আচরণ ও কার্যকলাপের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস এবং অনিয়ম-দুর্নীতির এহেন অভিযোগ নেই, যা আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যের ওপর আরোপিত হয়নি। আইন-শৃংখলা বাহিনী এক ধরনের দায়মুক্তি ভোগ করছে। এ কারণে এর এক শ্রেণীর সদস্য রীতিমত ধরাকে সরাজ্ঞান করছে। তারা কারণে-অকারণে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করছে। তাদের ভয়ে মানুষ সন্ত্রস্ত ও আতংকিত। ক’দিন আগে বাঁশখালিতে চার ব্যক্তি পুলিশের গুলিতে নিতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, গুলি না চালিয়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো কিনা। পুলিশের গুলিতে হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেই বলা হয়, আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে। বাঁশখালির ঘটনায় দেখা গেছে, বিক্ষুব্ধরা পুলিশের প্রতি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছে, কোনো দেশীয় অস্ত্র কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি। বলা বাহুল্য, ইট-পাটকেলের জবাব গুলি হতে পারে না। এই যে চারজন মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হলো, তারা আর ফিরে আসবে না। তাদের পরিবার-পরিজনের যে ক্ষতি হলো, তা কোনোদিন পূরণ হবে না। পুলিশ বা আইন-শৃংখলা বাহিনীর মূল দায়িত্ব নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দান ও সাহায্য করা এবং আইন-শৃংখলা সুরক্ষা করা। এর ব্যতিক্রম যখন ঘটে তখন মানুষের আস্থা আইন-শৃংখলা বাহিনীর ওপর থেকে উঠে যায়। আইন-শৃংখলা বাহিনী জনগণের কাছে আতংকে পরিণত হলো কেন, সেটা অবশ্যই একটি বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া না গেলে এবং যথাযথ প্রতিকার না হলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শুভ পরিবর্তন আসবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
অনেকে অভিযোগ করে থাকেন, দেশ এখন পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সরকার ও পুলিশের ভাবমর্যাদার প্রশ্নে এ অভিযোগের নেতিবাচকতা বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। পুলিশের সার্বিক আচরণ ও ভূমিকা এবং দুর্নীতি ও দুষ্কৃতির সঙ্গে এক শ্রেণীর পুলিশের সম্পৃক্ততা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুলিশের সুনাম ও মর্যাদাকে প্রায় তলানিতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সরকার তার ক্ষমতা সুরক্ষার জন্য পুলিশকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করছে। তার অনেক অপকর্মকেই বরদাশত করছে। পুলিশে ব্যাপক দলীয়করণের কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। পুলিশ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, কোনো দলীয় প্রতিষ্ঠান নয়। এই সীমারেখা উঠে যাওয়ার কারণে পুলিশের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সেবা ও সহযোগিতা মানুষ পাচ্ছে না। নাগরিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলা রক্ষায় পুলিশের অপারগতা ও ব্যর্থতার সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসী, দুষ্কৃতি ও অপরাধীরা। তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেশজুড়ে এবং খুন, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, ডাকাতির মতো অপরাধ সংঘটিত করছে অবলীলায়। একই কারণে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে নানা রকম অপরাধ হু হু করে বাড়ছে।
দেশের আর্থিক খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, দুষ্কৃতী, লুটপাটও সীমা ছাড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের বিপুল পরিমাণ অর্থ যখন ভিন দেশের ক্যাসিনোতে চলে যায় তখন বুঝা যায়, আর্থিক খাতের বিশেষত ব্যাংকিং খাতের নিরাপত্তা কতটা ভংগুর অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। এটা অবশ্য শুরু নয়। অর্থ লুটপাটের বহু ঘটনাই ইতোমধ্যে ঘটেছে। লুণ্ঠিত অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। শেয়ার বাজার থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুটপাটের কথা কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এর আগেও শেয়ার বাজার লুণ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয়বার লুটপাটের ফলে আজ অবধি শেয়ারবাজার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কত টাকা লুটে নিয়ে গেছে তা কারো অজানা নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নির্বিচারে অর্থ লুণ্ঠিত হয়েছে। গত ৮ বছরে দেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লুট হয়েছে ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। ওয়াশিংটন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্নিটির তথ্যমতে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অংকে যা ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০১৪-২০১৫ সালে অর্থ পাচার আরও বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশের ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের শিক্ষা,স্বাস্থ্য, পরিবহন, পল্লী উন্নয়ন, শিল্প ও ভৌত অবকাঠামো খাতের মোট উন্নয়ন বাজেটের সমান। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যারা অর্থ সম্পদ গড়ে তারাই মূলত এ টাকা পাচার করে।
ব্যাংকিং খাত থেকে ভুয়া কাগজপত্র ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের নামে এ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত চার দশকে ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। আরো কতভাবে যে টাকা পাচার হয়েছে ও হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। পাচার হওয়া অর্থ ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের যে টাকা চলে গেছে তাও ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। সর্বশেষ বিশ্বময় আলোড়ন সৃষ্টিকারী পানামা পেপারসেও বাংলাদেশের অন্তত ৩০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথনৈতিক দুর্বৃত্তাচার ও লুটপাটে আমরা যে কোনো দেশের চেয়েই পিছিয়ে নেই, এটা তার আর একটি বড় প্রমাণ।
খুন, সন্ত্রাস, গুম, অপহরণসহ গুরুতর অপরাধগুলোর যেমন সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার ও দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না তেমনি অর্থনৈতিক খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচারের তদন্ত, বিচার, শাস্তি হতে দেখা যায় না। সব ক্ষেত্রেই তদন্তের কথা বলা হয়, কিন্তু তা আর শেষ হয় না। তদন্তও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত ও বিলম্বিত হয়। ফলে বছরের পর বছর বিচার ঝুলে থাকে। দুষ্কৃতী-অপরাধীদের সাজা হয় না। এই যে বিচারে বিলম্ব বা বিচারহীনতা। তার ফলে দুষ্কৃতী-অপরাধীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্ম হয়েছে যে, যেকোনো অপরাধ করে রেহাই পাওয়া যায়। এ ধারণাই অপরাধ বৃদ্ধির বড় কারণ। নাগরিক নিরাপত্তা ও আর্থিক খাতের নিরাপত্তা ভেঙে পড়ার পেছনে আইনের শাসনের অভাবকে সহজেই দায়ী করা যায়। আইনের শাসনের মূল কথা হলো, আইনের চোখে সবাই সমান। অপরাধী যে অপরাধই করুক না কেন, আইনে বর্ণিত শাস্তি তাকে পেতেই হবে। বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক অবস্থান কিংবা অন্য কোনো পরিচিতি বিবেচ্য হবে না। আইনের এই শাসন যদি কার্যকর থাকে তাহলে অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধ কমে যেতে বাধ্য। নাগরিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক খাতের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে অবশ্যই দ্রুত বিচার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। সরকার দেখাতে চাইছে, দেশে উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বলছে, সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কাজে সরকার তার সর্বোচ্চ প্রয়াস নিয়োজিত করেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে, এমন আশাবাদ সম্প্রতি ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। সরকারের অভিপ্রায় বা লক্ষ্য, প্রচেষ্টা ও সুফলÑ কেউ এ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চায় না। এই সঙ্গে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মানুষের জানমালের অনিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক খাতের দুরবস্থার কথাও এড়িয়ে যেতে চায় না। সরকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রাচার ও রাজনৈতিক ব্যাপারে গুরুত্ব দেবে, নাগরিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে মনোযোগী হবে, অর্থনৈতিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করার দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে, এটা সবাই প্রত্যাশা করে। যেকোনো মূল্যে দেশকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের করে আনতে হবে এবং প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন