বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক উদ্ধার, এর সাথে জড়িতদের গ্রেফতার এবং কোনো কোনো মাদক ব্যবসায়ীর সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধ’-এর ঘটনা ঘটেছে। এতে গত এক সপ্তাহে ২২ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের মাদক। মাদকের বিরুদ্ধে এই অভিযান ইতিবাচক হলেও ‘বন্দুকযুদ্ধ’-এর ঘটনা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে প্রাণহানি কাম্য নয়। অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি বিধান করতে হবে। বন্দুকযুদ্ধ ছাড়া কি মাদক দমনের অন্য কোনো পন্থা নেই? তবে এ কথা অনস্বীকার্য, সারাদেশে মাদক যেভাবে সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করেছে, তাতে ‘ড্রাস্টিক অ্যাকশন’ ছাড়া গতি নেই। এ অ্যাকশন কোন উপায়ে হবে এবং কীভাবে হবে তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদক ব্যবসার যারা মূল হোতা তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। মাদকের যে ‘চেইন’ সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কিছু মাদক উদ্ধার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে কিছু লোক নিহত হলেও অন্যরা এ সময় সাবধান হয়ে যাচ্ছে। তারা মাদক ব্যবসা আপাতত বন্ধ করে আত্মগোপণে রয়েছে। অভিযান বন্ধ বা সহনীয় পর্যায়ে এলেই তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশে মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে। এক সময় ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে যেমন বানের পানির মতো ফেনসিডিল দেশে প্রবেশ করত, এখন মাদকের নতুন সংস্করণ ইয়াবা প্রবেশ করছে মিয়ানমার থেকে। এই মাদক এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সীরা এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি শ্রমিক ও গাড়ি চালকদের মধ্যেও ইয়াবার বিস্তার ঘটেছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের ভবিষ্যত যে তরুণ শ্রেণী, তাদের মধ্যে ইয়াবা আসক্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যে পরিবারের তরুণটি মাদকাসক্ত সে পরিবারে কী অশান্তি ও দুর্দশা সৃষ্টি হয়, তা আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। মাদকাসক্ত পুত্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে কোনো কোনো অভিভাবক পুলিশের হাতে পুত্রকে তুলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাদকের প্রসার এবং এর সাথে জড়িতেদের নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু বছর ধরেই লেখা হচ্ছে। তাতে ফল খুব কমই পাওয়া গেছে। এর কারণ হচ্ছে, যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা, তাদেরই একটি শ্রেণীর প্রশ্রয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা অবাধে ব্যবসা করে চলেছে। রাজধানীতে প্রায় ৫৪টির মতো স্পটে নিয়মিত মাদকের হাট বসে। এ খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরও এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। লেখালেখি হলে কিছুদিন রাখঢাক করে মাদক বেচাকেনা হয়, তারপর আবার তা পুরোদমে চলতে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যর নিয়মিত যোগযোগ এবং মাসোহারার সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো সদস্য সরাসরি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে কোনোভাবেই মাদকের আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতারা এ অভিযোগ তুলেছে। দুঃখের বিষয়, যে ছাত্র সংগঠন এবং তার নেতৃবৃন্দ শিক্ষার্থীদের আলোর পথে দিক নির্দেশনা দেয়ার কথা, তারাই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত হয়ে অন্ধকার পথে যাত্রা শুরু করেছে। শুধু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনই নয়, কক্সবাজারের এক এমপি তো রীতিমতো ‘ইয়াবা স¤্রাট’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ থাকলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বলা হয়ে থাকে, ইয়াবার মূল রুট কক্সবাজার-টেকনাফ তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া মাদক ব্যবসার সাথে বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের কোনো না কোনো নেতা জড়িয়ে আছে। ফলে মাদকের বিস্তার ঠেকানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতির মধ্যেই মাদক ও এর ব্যবসার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে। আমরা মনে করি, মাদক ব্যবসায়ী এবং এদের পৃষ্ঠপোষক ও নেটওয়ার্ক যতই শক্তিশালী হোক না, যে কোনো মূল্যে তা নির্মূল করতে হবে।
মাদক নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়। এর কোনো বিকল্প নেই। তবে এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত নয় যা বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এ পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের বিস্তারিত বিবরণ জনসম্মুখে তুলে ধরা অপরিহার্য। তারা মাদকব্যবসায়ী বলে ঘোষণা দিয়ে দায় সারলে হবে না। মাদকের সাথে তাদের যথাযথ সম্পৃক্ততা আছে কিনা, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরতে হবে। আবার মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে নিরীহ কেউ যাতে এর শিকার না হয়, এ দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। রাজনৈতিক শত্রæতার জের ধরে মাদকের নামে যাতে কাউকে ক্রসফায়ারে পড়তে না হয় এ ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, গুলি করে মাদকের মতো সর্বগ্রাসী একটি সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এতে সাময়িক স্বস্তি হয়তো পাওয়া যাবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে বা পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে না। এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরী। পরিবার ও সমাজের অভিভাবকদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সন্তান এবং এলাকার তরুণদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। তারা কোথায় যায়, কী করে, কাদের সাথে মেলামেশা করেÑএ ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে এলাকাভিত্তিক মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। পাশাপাশি নিজেদের বাহিনীর যারা মাদক ব্যবসাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং নিয়মিত মাসোহারা নিচ্ছে তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সর্ষের মধ্যে ভূত থেকে গেলে, সে ভূত কখনোই তাড়ানো যায় না। কাজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লক্ষ্য হওয়া উচিত মাদকের সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকুক এবং যতই প্রভাবশালী হোক, তাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ হওয়া।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন