ভূরুঙ্গামারী (কড়িগ্রাম) উপজেলা সংবাদদাতা : প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ গাছ মানুষের বন্ধু ও পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপকরণ। সুন্দর পৃথিবীকে পরিবেশবান্ধব বাসযোগ্য রাখতে গাছের কোন বিকল্প নেই। তাই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ভারসাম্য রক্ষার্থে যেকোন রাষ্ট্রের মোট ভূ-ভাগের অন্তত পচিশ ভাগ বনভূমির একান্ত আবশ্যকতা বিশ্বজুড়ে জোরালো কণ্ঠে বলে আসছেন। কিন্তু সকল গাছ মানুষের জন্য শুধুই উপকারী কিংবা পরিবেশবান্ধব নয়। যেসব গাছ মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই করে বেশি তেমনই একটি গাছের নাম ইউক্যালিপ্টাস। সারা দেশের ন্যায় বিদেশী প্রজাতির এই গাছটিতে ছেয়ে গেছে কুড়িগ্রামের সীমান্ত উপজেলা ভূরুঙ্গামারী। ইউক্যালিপ্টাস গাছ অন্যান্য গাছের মতো নয়। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ নিঃশ্বাসের সাথে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং বিষাক্ত নাইট্রোজেন ত্যাগ করে থাকে। অন্যান্য সকল গাছ মনুষ্য ত্যাগকৃত ঐ বিষাক্ত নাইট্রোজেন গ্রহণের পর শোধনের মাধ্যমে আবার অক্সিজেন আকারে ত্যাগ করে। পরে যা নিঃশ্বাস গ্রহণে মানুষকে সরাসরি সহায়তা করে থাকে। তাইতো গাছ মানুষের পরম বন্ধু। গাছ হলেও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু ইউক্যালিপ্টাস। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিদিন একটি ইউক্যালিপ্টাস গাছ ৪০ থেকে ৪৫ লিটার পানি শোষণ করে। এছাড়া মাটির নীচে গোড়ায় ২০ থেকে ৩০ ফিট জায়গা নিয়ে চারিদিকে থেকে গাছটি পানি শোষণ করে বলে অন্যান্য ফসল ও ফলদ গাছের ফলন ভাল হয় না। তাছাড়া মুক্ত আকাশে ডানা মেলা পাখিদের ডালে ডালে অবাধ বিচরণেও এই গাছ খুব সহায়ক নয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রে আরও জানা যায়, এটি একটি দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। অল্প সময়ের মধ্যেই বেড়ে উঠে বলে এর চাহিদা অনেক বেশি। জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহারিক মূল্য ছাড়াও গাছটি সোজা লম্বা গড়নের হওয়ায় বৈদ্যুতিক থাম্বা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া গাছটির কিছু ঔষধি গুণের কথাও শোনা যায়। বলা হয়ে থাকে গাছটির পাতা, তেল এবং শেকর মানব দেহের বিভিন্ন রোগ যেমন-সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী, বাত ও যক্ষার জীবাণু নাশক। তারপরও পরিবেশ উপযোগি নয় বিধায় ২০০৮ সালে সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে দেশে ইউক্যালিপ্টাসের চারা উৎপাদন নিষিদ্ধ করে। কিন্তু বাস্তবে কুড়িগ্রাম জেলা জুড়েই চলছে ইউক্যালিপ্টাস রোপণের হিড়িক। গড়ে উঠেছে ইউক্যালিপ্টাসের শত শত বাগান। বিশেষ করে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দশটি ইউনিয়নেই ব্যাপকভাবে ইউক্যালিপ্টাস চারা উৎপাদন ও রোপণ করা হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। নিষিদ্ধ গাছটির চারা উৎপাদনে সরকারি নিয়ম নীতির কোন তোয়াক্কাই করছেন না স্থানীয় নার্সারি মালিকরা। কারণ অন্যান্য বনজ বা ফলদ চারার চেয়ে এই চারা উৎপাদনে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি লাভ হয়। এই লোভে তারা বেশি বেশি চারা উৎপাদন করছেন আর সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে এসব নিষিদ্ধ চারা সকল স্থানে রোপণে উৎসাহিত করছেন। ফলে বিস্তৃর্ণ এলাকায় স্কুল-কলেজ, বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট, খেলার মাঠ, হাট-বাজার এমনকি উর্বর ফসলের মাঠজুরে সবজি, ধান, গম, আলু, সরিষার সাথে সাথে ব্যাপক হারে শোভা পাচ্ছে অপকারি বৃক্ষ ইউক্যালিপ্টাস। উৎপাদন বন্ধে কিংবা জনগণকে রোপণে নিরুৎসাহিত করতে স্থানীয় বন বিভাগ কর্মকর্তাগণ কতটুকু আন্তরিক কিংবা কতটুকু তৎপর বা আদৌ তাদের কোন নজরদারি আছে কিনা সেই প্রশ্নটি যে কোন সচেতন মনে জাগতেই পারে। সবকিছু মিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় সচেতন মহলসহ পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। সরকারের বন বিভাগে দায়িত্বরত ভূরুঙ্গামারী সামাজিক বনায়ন নার্সারি কেন্দ্রের বন কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী বাদশার নিকট এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ইউক্যালিপ্টাস চারা উৎপাদন বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত বিষয়ে আমরা সচেতন আছি। বর্তমানে আমাদের এখানে কোন প্রকার ইউক্যালিপ্টাস চারা উৎপাদিত হয় না। আর বেসরকারি নার্সারিগুলোতে উৎপাদন বন্ধ এবং জনগণকে এই চারা রোপণ না করার জন্য আমরা বিভিন্নভাবে সচেতন করে যাচ্ছি। তবে অত্র উপজেলায় ইউক্যালিপ্টাস চারা উৎপাদন বন্ধে সরকার গৃহীত সিদ্ধান্তের পুরোপুরি সুফল পেতে হলে বন বিভাগের চলমান তৎপরতার সাথে সাথে জোরালো প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এ বিষয়ে ভূরুঙ্গামারী নাগরিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি এডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক প্রামাণিক জানান, পার্শ্ববর্তী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিহার-উড়িষ্যা-অন্ধ্রপ্রদেশ-তামিলনাডু অভিমুখে প্রায় আড়াই হাজার কিলো রেল ভ্রমণে পথের দুই ধারে অচেনা অনেক বৃক্ষই চোখে পড়েছে কিন্তু কোথাও ইউক্যালিপ্টাস গাছ চোখে পড়েনি। পরে জেনেছি পরিবেশ বন্ধু নয় বিধায় ভারতীয়রা গাছটি রোপণে অনাগ্রহী। পরিবেশ রক্ষার সুন্দর চিন্তা থেকেই বাংলাদেশ সরকার ইউক্যালিপ্টাস উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু সেই নিষিদ্ধ ইউক্যালিপ্টাস গাছ সরকারি রাস্তা এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান আঙিনাতেই শোভা পাচ্ছে। যা অনেকটাই স্ববিরোধী অবস্থান। এমনটি হওয়া উচিৎ নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন