মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

ইউপি নির্বাচন : ভোট ডাকাতির মহোৎসব?

মেহেদী হাসান পলাশ | প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সারাদেশে চলমান ৬ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ৩৫২টি ইউপির নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। এ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৩ এপ্রিল। দুই ধাপের ফলাফলে দেখা গেছে, ১ হাজার ৩৫২টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা ৯৮৭টিতে জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ১০৮টিতে। দুই ধাপে আ.লীগের ৯৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, আর বিএনপির প্রার্থী ছিল না বা নেই অনেক ইউপিতে। তৃতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২৫ প্রার্থী ইতোমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে প্রথম ধাপে আ.লীগের ৬২ জন ও দ্বিতীয় ধাপে ৩১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মতো এ ধাপেও বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই ৮১ ইউপিতে। এ ছাড়া প্রথম ধাপে ১১৯ ও দ্বিতীয় ধাপে ৭৯ ইউপিতে প্রার্থী ছিল না বিএনপির। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, প্রথম ধাপে গত ২২ মার্চ ৭১২টি, ২৩ মার্চ ১১টি ও ২৭ মার্চ দুটি ইউপির ভোটগ্রহণ হয়। এ ধাপে একটি ইউপির নির্বাচন একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর মৃত্যুর কারণে বন্ধ রয়েছে। ওই ইউপি ছাড়া অন্য ৭২৪টির মধ্যে আওয়ামী লীগ ৫৪০টিতে এবং বিএনপি ৪৭টিতে জয় পায়। এদিকে গত ৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপে ৬৩৯টি ইউপির ভোট গ্রহণ হয়। এর মধ্যে ৬২৯টির ফলাফলে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ ৪৪৭ ও বিএনপি জিতেছে ৬১টিতে। এ ধাপে ১০টি ইউপির নির্বাচন অনিয়ম ও সহিংসতার কারণে স্থগিত হয়েছে। তিন ধাপে ১১৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়াতে এই সংখ্যা ইতোমধ্যে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালের ইউপি নির্বাচনে ১০০ জন চেয়ারম্যান এবং ৬০০ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাণ দিয়েছে অন্তত ৪২ জন মানুষ। আর আহত হয়েছে ২ হাজারেরও বেশি। এদের অনেকেই নির্বাচন-পূর্ববর্তী ও নির্বাচন-পরবর্তী সংঘাতে হতাহত হয়েছে। এ সংঘর্ষ এখনো অব্যাহত রয়েছে। যারা আহত হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছে। আহতদের মধ্য থেকে এখনো অনেকে মারা যাচ্ছে আবার কেউ কেউ মৃত্যুশয্যায় কাতরাচ্ছে। বাড়ছে লাশের মিছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হামলা, মামলা দিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে, জেলে ভরে নির্বাচনে প্রার্থী হতে না দেয়া, নানাভাবে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না দেয়া, যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে না দেয়া, ভোটের আগের রাতেই সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, ভোটকেন্দ্র দখল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, এজেন্ট ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে না দেয়া, জাল ভোট, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, প্রকাশ্যে ভোটদান ও প্রকাশ্যে ভোটদানে বাধ্য করা, দাঙ্গা, সংঘর্ষ, গোলাগুলি, হত্যাকা-ের মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রে অরাজকতা সৃষ্টি, ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া ইত্যাদি উপায়ে প্রকাশ্যেই এবারের ইউপি নির্বাচনে যেসব অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে তা নজিরবিহীন। নির্বাচনে ফলাফল পাল্টে বিজয় ছিনতাই হওয়ায় সরকারি দলের মনোনয়ন বঞ্চিত নেতা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার আলেয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. রহিজউদ্দিন আকন্দ দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। সরকারদলীয় নেতারই যদি এরকম অবস্থা হয় তাহলে সরকারবিরোধী বা সরকারদলীয় নয় এমন প্রার্থীদের নির্বাচনী হালচালের অবস্থা কী তা সহজেই অনুমেয়। তিন ধাপে ১১৮টি ইউপিতে সরকারদলীয় প্রার্থীর বিপরীতে বিরোধী দলের তো দূরে থাক নিজ দলেরও অন্য কোনো প্রার্থীকে ও নির্বাচনে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল যার প্রতিটি ইউপিতে প্রার্থী হওয়ার একাধিক যোগ্য নেতা ও প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন সেখানে তিন ধাপে ২৭৯টি ইউপিতে দলটি প্রার্থীই পায়নি। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ব্যতিক্রম। সেখানে সরকারদলীয় প্রার্থীই খুঁজে পাওয়া যায়নি বিভিন্ন ইউপিতে। এ কারণে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন তৃতীয় ধাপের পরিবর্তে পিছিয়ে ৬ষ্ঠ ধাপে নেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে জারি করা এ সংক্রান্ত নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারেনি সেহেতু নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাঙামাটি জেলার ১০টি উপজেলার ৪৯ ইউনিয়নের নির্বাচন তৃতীয় পর্যায়ের পরিবর্তে ষষ্ঠ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত’ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদিও অন্য একটি পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির ৩৭টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩৬টিতে, অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ২৭টিতে নমিনেশন দিতে পেরেছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতারা পরিষ্কার করে একাধিকবার বলেছেন, পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে তারা অনেক ইউনিয়নে প্রার্থী দিতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, নির্বাচন পেছানোর পর সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে এও বলা হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হলে শুধু ইউপি নির্বাচন কেন ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবে না স্থানীয় আওয়ামী লীগ।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলায় সক্রিয় তিনটি আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র শাখার সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা নমিনেশন নিতে আগ্রহী নন। হুমকির মুখে জীবন বাঁচাতে তারা নির্বাচনী মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। বিষয়টি স্বীকার করে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার জানিয়েছেন, স্থানীয় সশস্ত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের অবৈধ অস্ত্রের ভয়ে পাহাড়ে মানুষ জিম্মি। তাদের হুমকির কারণে অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদে আমাদের দলের অনেকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এমনকি দলীয় বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যানরা পর্যন্ত ভয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কারণ নির্বাচন এলে স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোর অপতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে পাহাড় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তাদের জোর বেশি থাকে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নির্বাচনী প্রচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আগেই সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন পাহাড়ি পাড়াগুলোতে ঘুরে ঘুরে নিরীহ ভোটারদের ভয়, হুমকি প্রদর্শন করে নিজ দলের মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দেয়ার কথা বলছে। তারা এমনও বলছে যে, পুলিশ-সেনাবাহিনী-বিজিবি ভোটের কিছু দিন পাহারা দেবে। কিন্তু ভোটের পর আর তাদের পাওয়া যাবে না। সে সময় তারা থাকবে। তাদের প্রার্থীরা হেরে গেলে ভোটের পর তারা এর প্রতিশোধ নেবে। গত ১৬ মার্চ রাঙামাটির নানিয়ারচরে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে চাওয়ায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান পঞ্চানন চাকমাকে অপহরণ করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। এরপরও এ উপজেলায় একই কারণে আরো কিছু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। একইভাবে দলীয় মনোনয়নের বাইরে প্রার্থী হতে চাওয়ায় বান্দরবানের রুমা উপজেলায় পাহাড়ি সংগঠনের এক নেতাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে তার দলের সদস্যরাই। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে এ ধরনের ঘটনা তত বৃদ্ধি পাবে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
সাধারণত তিন পার্বত্য জেলার উপজাতি অধ্যুষিত ইউপিগুলোতে পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো জয়লাভ করে। তাছাড়া অনেক সময় একাধিক বাঙালি প্রার্থীর বিপরীতে একক পাহাড়ি প্রার্থী দিয়েও আঞ্চলিক সংগঠনগুলো জয়লাভ করে। প্রত্যন্ত ইউপিগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করা পাহাড়ি পাড়া বা গ্রামগুলোর বাসিন্দা বা ভোটাররা সবসময় উপজাতি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বন্দুকের মুখে বসবাস করে। এসব সন্ত্রাসী নিরীহ উপজাতি বাসিন্দাদের ওপর যতই জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস চালাক জীবনের ভয়ে, বন্দুকের মুখে তারা তাদের নির্দেশিত পথেই চলতে বাধ্য হয়, তাদের মনোনীত প্রার্থীকেই ভোট দিতে বাধ্য হয়।
পার্বত্য বিশেষজ্ঞদের মত, শুধুমাত্র নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও ভয়হীন নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না তিন পার্বত্য জেলায় প্রবলভাবে বিরাজমান পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী নিরীহ উপজাতীয় বাসিন্দাদের দিকে তাক করা পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের বন্দুকের নলগুলোকে নিষ্ক্রিয় বা ধংস করা না যাবে ততদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে সক্ষম হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে পাহাড়কে অস্ত্রমুক্ত করা সময়ের দাবি। এ দাবি সরকারি দল আওয়ামী লীগের, এ দাবি বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের, এ দাবি বাঙালির, এ দাবি নিরীহ ও সাধারণ পাহাড়ির, এ দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্বরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানের কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি জেএসএস সহ-সভাপতি ও সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদারও স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানের কথা বলেছেন। কাজেই নির্বাচনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানের দাবি কতিপয় সন্ত্রাসী বাদে দল, মত, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে ১৬ লাখ পার্বত্যবাসীর। তিন পার্বত্য জেলায় জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সরকারের আন্তরিকতা ও প্রশাসন, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছাড়া এ কঠিন কাজে জয়লাভ সম্ভব নয়।
তবে রাঙামাটিতে নির্বাচন পেছানো হলেও বাগেরহাটে কেন পেছানো হলো না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের অবস্থা এতটাই খারাপ এবং প্রার্থীদের এত বেশি বাধা দেওয়া হচ্ছে যে নির্বাচন কমিশনে আসতে হলো। বাস্তবে দুই দফার নির্বাচন দেখে মনে হয়েছে, দখলের মহোৎসব চলছে। সবার চোখের সামনে কেন্দ্র দখল হচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক যে তাদের দলের প্রার্থীদেরও বাধা দেওয়া হচ্ছে। মেরে ভুট্টা ক্ষেতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, নির্বাচন কমিশন তাদের লজ্জার ভূষণ জাদুঘরে জমা দিয়েছে। সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ৫ জানুয়ারির প্রার্থী ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কফিনে ঢোকানো হয়েছিল। আর এবারের সহিংসতা আর ভোট ডাকাতির ইউপি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কি সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি মারতে চাচ্ছে? স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেছেন, নির্বাচনের আগের রাতে চেয়ারম্যানের ভোট রাতেই হয়ে যায়। ফলে রক্ত ঝরছে। আগের রাতে সিল মারা, দখল, জালভোট ও জোর করে কেন্দ্র দখল করে ভোট এবং ফলাফল ঘোষণার পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতা চলছেই। তৃণমূলের এই জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সময় ঘরে ঘরে সংঘর্ষের ঘটনা দৃশ্যমান হচ্ছে। ভোটের পরেও চলছে ভোট নিয়ে সংঘর্ষ। এতে সামাজিক কলহ বাড়ছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ নির্বাচনকে বিকৃত আখ্যা দিয়ে বলেন, এতকাল মনোনয়ন বাণিজ্য ছিল উপরের তলায়, এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য তৃণমূলে ছড়িয়ে গেছে। আগে নির্বাচনের দিন সহিংসতা ঘটত, কিন্তু এবার সহিংসতা দীর্ঘমেয়াদি এবং সহিংসতা দেখা দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদের মধ্যে বেশি। তিনি আরও বলেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কমিশন বলেছে, তারা ব্যর্থতার দায় নেবে না। এখন কমিশন যদি দায় না নেয় এ দায় কে নেবে?। এমনকি চলমান নির্বাচন নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেছেন, ইসি ইচ্ছা করলে নির্বাচন বাতিলও করতে পারে, গ্রহণও করতে পারে। যে কারও চাকরি খেতে পারে। কিন্তু এ কেমন কমিশন, লড়েও না, চড়েও না। আগায়ও না পিছায়ও না। একটা কিছু কর, গোলাপি একটা কিছু কর। নির্বাচনে সংখ্যালঘু প্রার্থী ও ভোটারদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের সাথে জড়িত সংগঠনগুলো।
নির্বাচনে সহিংসতা, জাল ভোট প্রদানের অভিযোগ কম বেশি সব সময়েই ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে মইনুদ্দীন- ফখরুদ্দীন সরকারের এক্সিট রুটের নীলনকশায় নির্বাচিত আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশে নির্বাচনের সংজ্ঞা-ই যেন পাল্টে গেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা ভোটের নির্বাচনের মাধ্যমে এ সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনকে আদৌ নির্বাচন বলা যায় কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ইতিহাসের পাতায় এ নির্বাচনগুলো কী ভাষায় বর্ণিত হবে তা খুঁজে বের করতে বোধ করি ঐতিহাসিকদেরও দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। উপজেলা নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন একই ধারায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পূর্বে প্রার্থীরা জয়লাভ করতে জালভোটের সাহায্য নিলেও লজ্জায় তা করত লুকিয়ে ছাপিয়ে। কিন্তু এখন সরকারদলীয় প্রার্থীর লোকেরা ভোটকেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে মেরে ব্যালট বাক্স ভরছে। প্রয়োজন হলে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই পরোক্ষে স্বীকার করেছে, এখন আগের রাতেই ব্যালটে ছিল মেরে বাক্স ভরা হয়। নির্বাচনের সাথে জড়িত কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও অনেক ক্ষেত্রে এই অপকর্মে সহায়তা করছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সরকারী দলের প্রার্থি ও তার সমর্থকগণ, কর্মকর্তাগণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যগণ এখন ভোট ডাকাতিকে নিয়মে পরিণত করে ফেলেছেন। ফলে ভোটের মতো পবিত্র নাগরিক আমানত ডাকাতি করতে এখন তাদের চক্ষু লজ্জা হয় না। বিবেক, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানসিকতা তাদের আটকাতে পারে না। জয়লাভ যখন মোক্ষ, তখন অষষ ঋধরৎ রহ খড়াব ধহফ ধিৎÑ নীতিতে অবাধে চলছে ভোট ডাকাতি। এ পরিস্থিতিতে বর্তমান নির্বাচনগুলোকে ভোট জালিয়াতি, ভোট চুরি না বলে ভোট ডাকাতি বলা অধিক সঙ্গত। বর্তমান সরকার ও তার দল এই অপকর্মটিকে এমন শৈল্পিক ও দক্ষতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, তার মোকাবেলা করা বা প্রতিরোধ করার মতো শক্তি ও কৌশল জাতীয় পর্যায়ে বর্তমানে অনুপস্থিত। এই অনুপস্থিতির কারণেই সরকারি দল অবাধে ভোট ডাকাতির মতো অপকর্ম চালিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকা এক্ষেত্রে শিয়াল ও কুমিরের হালচাষের গল্পের মতো। কুমির আখ চাষ করে আগা নিলেও হারে, আবার ধান চাষ করে গোড়া নিয়ে হারে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও হারে, না নিলেও হারে। কারণ নির্বাচন ঠেকানোর মতো সাংগঠনিক শক্তি তাদের নেই। কী করলে ভালো হবে সেটা নির্ধারণ করাই বিএনপির জন্য এখন ভার হয়ে গেছে। সে কারণে কখনো বলা হচ্ছে, নির্বাচন বয়কট করব, আবার কখনো বলা হচ্ছে নির্বাচন চালিয়ে যাব। এই দোদুল্যমানতা, সিদ্ধান্তহীনতায় আরো বেশি মার খাচ্ছে দলটি।
ইউপি নির্বাচন কার্যত একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু তবুও সংঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রধান কারণ দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ায় মনোনয়ন বাণিজ্য এখন তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নির্বাচনে জয়লাভের টিকিট হাতে পাওয়া এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় প্রার্থীরা টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন কিনছেন। বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কেনা মনোনয়নের জয়লাভে যখন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে তখনই যে কোনো উপায়ে জয়লাভ করতে গিয়ে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এ মনোনয়ন বাণিজ্য নির্বাচন পরবর্তী নাগরিক সেবার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচনের ফলে সমাজ দেহে রাজনৈতিক বিভক্তি তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে দলীয় সমাজ ব্যবস্থা জন্ম দিচ্ছে। গ্রামগুলো এখন আওয়ামী লীগ সমাজ, বিএনপি সমাজ, জামায়াত সমাজ রূপে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এতে করে সংঘাত, হানাহানি সৃষ্টির সুযোগ ও মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সরকারকে দেশের কথা ও জনগণের কল্যাণের কথা সর্বাগ্রে ভাবতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ইউপি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ওপর সরকারের ক্ষমতায় থাকা না থাকার প্রশ্ন জড়িত নয়। কাজেই সরকার ইচ্ছা করলেই এ নির্বাচনকে সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, সংঘাতমুক্ত করে নিজের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করতে পারে। দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশাও এটা।
email: palash74@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
খোরশেদ আলম ১০ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:১৩ এএম says : 0
আমার মতে এগুলোকে নির্বাচন বলা যায় না।
Total Reply(0)
Asma ১০ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:১৬ এএম says : 0
vai agulo bole kono lav nai.......................
Total Reply(0)
তোফাজ্জেল হোসেন ১০ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:২১ এএম says : 0
বিএনপিসহ সকল দলের উচিত নির্বাচন বয়কট করা।
Total Reply(0)
আবির ১০ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:২৩ এএম says : 0
মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ না হলে কখনোই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে না।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন