শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

মুজিবুর রহমান মুজিব | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০১৮, ৮:৫৬ পিএম

৩০ মে ১৯৮১ সাল- বাংলাদেশের সমকালীন সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে একটি শোকাবহ দিন। বেদনার দিন। ওইদিন রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন- শাহাদাত বরণ করেন স্বাধীনতার মহান ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃ প্রবর্তক, সফল রাষ্ট্রনায়ক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রাম সফরে ছিলেন। বারো আওলিয়ার মুল্লুক, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক চৌকস মেজর স্বদেশ প্রেম ও স্বাদেশীকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ বলে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখেছিলেন সেই বন্দর নগরী চট্টগ্রামেই মাত্র এক দশকের মাথায় ঘাতকদের হাতে শহীদ হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আকস্মিক ও অকাল শাহাদাতে দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকের মাতম উঠে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায়। ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অনুষ্ঠিত হয় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিশাল নামাজে জানাজা। সেটি ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম নামাজে জানাজা। চন্দ্রিমা উদ্যানে চির শয়ানে শায়িত আছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। মহান মালিক তাকে বেহেশ্ত নসিব করুন।
চট্টগ্রামস্থ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া কর্তৃক মহান স্বাধীনার ঘোষণায় তার কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না, একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা হিসাবে দেশ ও জাতির সেই ক্রান্তিকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, বাংলা ও বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ডাক দেন। তিনি তার ঘোষণায় যথাযথভাবেই সেই সময়কার নির্বাচিত নেতা আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষেই স্বাধীনতার ঘোষণাটি দেন। মেজর জিয়া নিজের কোন পদ-পদবি ঘোষণা করেননি, কিংবা দাবিও করেননি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি জেড ফোর্সের অধিনায়ক এবং একটি সেক্টারের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে সৈনিক জিয়া ব্যারাকে ফিরে যান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান নিযুক্ত হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন জেনারেল কে.এম. শফি উল্লাহ, বি.ইউ।
পচাত্তরের সাতই নভেম্বর সংগঠিত হয় বহুল আলোচিত-আলোড়িত ঐতিহাসিক সাতই নভেম্বরের বিপ্লব। এই সিপাহী-জনতার বিদ্রোহের মাধ্যমে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা হয় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। প্রকৃত পক্ষে তখন থেকেই তিনি ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হতে থাকেন। সেনাপ্রধান নিযুক্ত হয়ে জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীতে চেইন অব-কমান্ড ফিরিয়ে আনেন। সেনা সদস্যরা ব্যারাকে ফিরে যান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত হতে থাকে। সেনা শাসন তথা সামরিক আইন থেকে বেসামরিক প্রশাসনীকরণ ও গণতন্ত্রায়নের পথে এগুতে থাকে দেশ ও জাতি। প্রেসিডেন্ট সায়েমের উপদেষ্টা পরিষদে অর্থনীতিবিদ এম. সাইফুর রহমান, ড. এম. এন. হুদা, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ বেসামরিক জ্ঞানী-গুণীজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন স্বাধীনতার মহান ঘোষক-মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। মহামান্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ভার নিয়ে ক্রমান্বয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। ইতিপূর্বে শুধুমাত্র চারটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংবাদপত্র রেখে সকল সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে বাহির্বিশে^ বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশে শুরু হয় উৎপাদন ও উন্নয়নের রাজনীতি। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচী; খাল কাটা, কৃষি উন্নয়ন তথা সবুজ বিপ্লবের শুভ সূচনা ঘটায়। উৎপাদন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। ব্যাংকিং সেক্টর ও মুদ্রা বাজারে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। তাঁর সময় মুদ্রা পাচার ও মুদ্রাস্ফিতি ছিল না। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। যদিও দেশে তখন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি আঞ্চলিক ফোরাম গঠনের স্বপ্ন দ্রষ্টাও ছিলেন তিনি। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রæতা নয়’ এমন পরিচ্ছন্ন পররাষ্ট্রনীতি তার শাসনামলে দৃশ্যমান ছিল।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দেশ যখন উন্নয়ন অগ্রগতি ও প্রগতির পথে তখন বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এক সফরে যান প্রেসিডেন্ট জিয়া। ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ঘাতকদের হাতে শহীদ হন তিনি। যে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে রাত্রি যাপন করেছিলেন বাংলাদেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট সেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ এখন শহীদ জিয়া জাদুঘর। এখানে গেলেই দেখা যাবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সহজ সরল সাধারণ জীবনদর্শন-জীবনাচরণ। তার হাফহাতা সাফারি, ভাঙ্গা স্যুাটকেস, জায়নামাজ প্রমাণ করে কত সাধারণ জীবনযাপন করতেন তিনি। ৩০ মে, রাত্রের নৈশভোজের খাদ্য তালিকাও টাঙ্গানো আছে দেয়ালে- সাদা ভাত মুরগির ঝোল, ডাল, সবজি ছিল দুনিয়াতে তার শেষ খাবার। কোরমা, পোলাও, চিকেন, মাটন, রেজালা, ডেজার্ট দিয়ে ভূরিভোজ নয়, সামান্য ডালভাত ছিল তাঁর প্রিয় খাবার। ব্যক্তি ও প্রেসিডেন্ট হিসাবেও তিনি ছিলেন শতভাগ সৎ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের ঘোর বিরোধী ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তাঁর কট্টর সমালোচকও তাঁর দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির কোন অভিযোগ উত্থাপন করেননি।
প্রচলিত আইন মোতাবেক একজন মৃত ব্যক্তি তার বিষয়-সম্পত্তি, অর্থ-বিত্তের উপর মালিকানা হারালেও তাঁর ওয়ারিশদের উপর তাঁর হক থেকে যায়। লাশের নেক আওলাদ লায়েক ওয়ারিশগণ একজন মরহুমের রুহের মাগফিরাত, কোরআন খতম, নফল নামাজ, দোয়া, দুরুদ পাঠ করেন। গরিব মিসকিন খাওয়ান। বিশেষত দিবসে উৎসবে। দুঃখ ও দুর্ভ্যাগ্যজনকভাবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, পুত্র, সন্তান তথা পরিবারবর্গ আজ সে অবস্থানে নেই। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সহধর্মিনী বেগম খালেদা জিয়া একটি মামলার কারাদন্ড নিয়ে কারাগারে। মামলায়-মামলায় জর্জরিত। প্রথম পুত্র তারেক রহমান বিলেত প্রবাসী-চিকিৎসাধীন। দ্বিতীয় পুত্র আরাফাত রহমান বনানীর কবরস্থানে-কবরবাসী। এই শাহাদাত বার্ষিকীতে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের পক্ষে তাঁর কবর জিয়ারত, ফাতেহা পাঠের সুযোগ নেই।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর তাঁর নামাজে জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। এই যুগেও শহীদ জিয়া আছেন দেশবাসীর হৃদয়ে। মনের মনি কোঠায়, অন্তরে-অনুভবে। আছে তাঁর প্রিয় দল, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সুশীল সমাজ, জাতীয়তাবাদী শক্তি। আশা করা যায়, দেশবাসী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াাকে স্মরণ করবে বিন¤্র শ্রদ্ধায়। ভালোবাসায়।
শহীদ জিয়ার এই শাহাদাত বার্ষিকীতে তাঁর উজ্জ্বল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ও রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন