মো. গোলাম ফারুক, দুপচাঁচিয়া (বগুড়া) থেকে
আমাদের ঐতিহ্যবাহী একটি দিন বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ। হাতেগোনা আর মাত্র কয়েক দিন পরই সেই কাক্সিক্ষত দিন পহেলা বৈশাখ। তাইতো দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলাসহ দুপচাঁচিয়া ও তালোড়া পৌরসভার পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা এখন মহাব্যস্ত এই বৈশাখকে ঘিরে। বিভিন্ন স্থানে এ বৈশাখ পালনের প্রস্তুতিসভাও শুরু হয়েছে। গত ৬ এপ্রিল দুপচাঁচিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পহেলা বৈশাখ পালনের প্রস্তুতিসভা পরিষদের সভাকক্ষে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। উপজেলায় পহেলা বৈশাখ আনন্দঘন পরিবেশে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালনের লক্ষ্যে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ দিকে দিবসটির সাথে মিলিয়ে বর্ণিলরূপে সাজাতে উপজেলার মার্কেটগুলোতে বৈশাখী কাপড় বেচা-কেনার ধুম পড়েছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের ছেলেমেয়েসহ বধূরাও তাদের পছন্দনীয় লাল-সাদা মিশ্রিত রঙ্গের পোষাক ও শাড়ি কিনতে মার্কেটগুলোতে ভিড় করছে। দিনটি পালনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় কর্মসূচি হলো- বৈশাখী মেলা। রাজধানী ঢাকা এবং জেলা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলা বসে থাকে। গ্রামঞ্চলের এই মেলার কদর আরও বেশি। আর এই মেলার মূল আকর্ষণই হচ্ছে মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা ও জিনিসপত্র। মাটির এসব খেলনা আর জিনিসপত্র তৈরির জন্য এক মাস আগে থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে উপজেলার মৃৎশিল্পীরা। তারা কাঁদামাটিকে পুঁজি করে নিজেদের আদি শিল্পকে ধরে রেখেছেন। একসময় এই শিল্পীরা মাটির তৈরি থালা, হাঁড়িপাতিল, বাসনকোসন তৈরির মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখত। কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব, আসছে নতুন প্রযুক্তি। মৃৎশিল্পীরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। উপজেলা সদরের সরদারপাড়া সংলগ্ন কামারপাড়া ও চেঙ্গা পালপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, কুমার সম্প্রদায়ের হিন্দু পরিবারের সদস্যরা এই পহেলা বৈশাখী মেলাকে সামনে রেখে মাটির বিভিন্ন ধরনের খেলনা আর পুতুল বানানো নিয়ে ব্যস্ত। দিনটি যতো এগিয়ে আসছে এই মৃৎশিল্পীরা যেন ততোই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বৈশাখী মেলায় বিক্রির জন্য বিভিন্ন খেলনা বানানোর কাজ চলছে। এদের মধ্যে সিংহভাগই নারী। অনেক বাড়িতে একাধিক শ্রমিকও কাজ করছে। এদের মধ্যে কেউ কাঁদা ঘুটছেন, কেউ চাকতি ঘুরাচ্ছেন, কেউ কেউ আবার তৈরি করছেন নানা ধরনের খেলনা পুতুলসহ বিভিন্ন পণ্য। আবার দেখা গেছে, অনেকে ফিনিসিং কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ব্যস্ততা আছে রং করা আর প্যাকেটিং করা নিয়েও। কোন ধরনের কেমিক্যাল ছাড়াই এ খেলনা ও পণ্যগুলোতে যে রং করা হচ্ছে তাও স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা এবং প্রকৃতির সব উপাদান দ্বারা তৈরি। কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ কাজের ব্যস্ততা যেন ঘিরে রেখেছে সকল মৃৎশিল্পীদের। কুমার পাড়ার মৃৎশিল্পী বিনয় চন্দ্র পাল ও সত্যেন্দ্রনাথ পাল “দৈনিক ইনকিলাব” কে জানান, তারা ৫২ ধরনের ক্রোকারিজসহ বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী তৈরি করে থাকেন। এরমধ্যে গ্লাস, মগ, তরকারির বাটি, প্লেট, মিষ্টির হাঁড়ি, জগ, ফুলদানিসহ খেলনা সামগ্রীর মধ্যে আম, পেয়ারা, কমলা, তাল, পটল, লিচু, কলা, তরমুজ, বেগুন, মাটির ব্যাঙ, হাতি, বাঘ, সিংহ, মাটির তৈরি ব্যাংক. কুমির, বৃদ্ধোর মূর্তি, গনেশ উল্লেখযোগ্য। মেলায় নিজেরা এসব জিনিসের পসরা সাজিয়ে বিক্রির পাশাপাশি পাইকারি মহাজনদের (অর্ডার নেওয়া) সরবরাহ দিয়ে থাকেন। পরিশ্রম বাদ দিয়ে প্রতিটি খেলনাতে তারা পঞ্চাস পয়সা থেকে ষাট পয়সা লাভ করে থাকেন। আগামী ১৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ পালিত হবে। এ দিন থেকে পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে শহর থেকে শুরু করে সারা দেশে গ্রামাঞ্চলে চলবে বৈশাখী মেলা। এসব মেলায় বিক্রি হবে কুমারদের মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা পুতুলসহ বিভিন্ন সামগ্রী। কুমার সম্প্রদায় তাই এ মাসটিকে মৌসুম হিসেবে কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়। মাসটি যতো এগিয়ে আসে তাদের ব্যস্ততা ততো বাড়তে থাকে। শেষ মুহূর্তে কুমার পল্লীগুলো এখন মুখরিত। এ যেন তাদের কাছে আরেক মহোৎসব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন