কবি বন্দে আলী মিয়ার একটি চমৎকার পরিচিত বিধৃত হয়েছে আতাউর রহমানের কবিতার একটি পঙক্তিতে : ‘রাধানগরের প্রবীণ কিশোর....মনে হয় যেন তিনি পর্যটক শ্রান্তি ক্লান্তিহীন’। আমারও বোধ করি তাই মনে হয়েছিল যখন দৈবক্রমে কবি বন্দে আলী মিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ এলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার প্রফেসর গোলাম সাকলায়েনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে এই সুযোগ লাভ। কবি বন্দে আলী মিয়ার সঙ্গে বিশিষ্ট লেখক তসিকল ইসলাম রাজাও ছিলেন সেখানে। সময়টি হলো ১৯৭৬ সালের বসন্তকাল। পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে এসেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে। পরের বসন্তে রাজশাহী চলে আসি চাকরি নিয়ে। দুর্ভাগ্য, কবির সাথে আর সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু প্রথম ও শেষ সাক্ষাতেই কবির কাছে জানার মতো, তাকে উপলব্ধি করার মতো তথ্য ও তত্ত আমার জানা ও বোঝা হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত, তাকে তো চিনি অনেক দিন থেকে। শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে যৌবন- এই পথপরিক্রমায় তিনিও তো আমাদের এগিয়ে নিয়ে এসেছেন অন্যদের সাথে। তার ‘চোর জামাই’ (১৯২৭) যখন এসছিল তখন ‘চোর’ কথাটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল পরিবেশের গুণে, কিন্তু ‘জামাই’ অর্থ ছিল আবছা রহস্যঘেরা। বেশ ভালো লেগেছিল সে বই। তারপর পড়েছি আরো বই, তারও বেশি লেখা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শিশু-কিশোর কাগজে, আরেকটু পরে, বড়দের পত্রিকায়। ‘পাতাবাহার,’ সাঁঝের রূপ-কথা, ‘সোনার কাঠি রুপোর কাঠি’ ‘টো টো কোম্পানীর ম্যানেজার’, ‘শিয়াল পন্ডিতের পাঠাশালা’, ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’ আরো কিসব বইয়ের স্মৃতি উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে এখানো মনের গভীরে। সে সময়টা চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে, তিনি লিখে চলেছেন এন্তার বই। সেকালের সাময়িক পত্রে বইয়ের বিজ্ঞাপন বেরুতো বেশি। ব্যবসায়ী বুদ্ধি কম ছিল তখন প্রকাশক, লেখক, এমনকি পাঠকেরও। তাই বই পড়া না হলেও বই আর লেখক সম্পর্কে জানা যেত প্রচুর। শিশুতোষ গ্রন্থ নয় কেবল, বড়দের জন্যও তিনি লিখেছেন বিস্তর। কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতির চর’ (১৯৩১) রবীন্দ্রাথ ঠাকুরের প্রশংসা-ধন্য। মাসিক মোহাম্মদীতে ক্রমশ প্রাকাশ্য উপন্যাস ‘নারী রহস্যময়ী’ এককালে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। তাঁর নাটক ‘আমানুল্লাহ’ (পরে মসনদ) প্রহসন ‘বৌদিদি রেস্টুরেন্ট’ যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত কাহিনী অবলম্বনে রচিত বড়গল্প ‘শেষলগ্ন’ (নাট্যরূপ ‘নসীবের ফের/গাঁয়ের মেয়ে) যথাযোগ্য সমাদর লাভে বঞ্চিত হয়নি। বন্দে আলীর ‘জীবনের দিনগুলো’ (১৩৭৩) ও ‘জীবন শিল্পী নজরুল’ (১৯৭১) আমার কাছে অত্যন্ত সুপাঠ্য ও মূলবান মনে হয়েছে।
মূল্যবান এরকম অনেক লেখা তার যার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি অদ্যাবধি। কিছু অসুবিধাও অবশ্য ছিল। সাহিত্য ইতিহাসের মারাত্মক ব্যাধি কালভ্রষ্ট দোষ বা এনাক্রনিজম (ধহধ-পযৎড়হরংস) তাকে নানাভাবে আহত করে গেছে। ১৯০৬ সালে জন্ম কবি বন্দে আলী মিয়ার, পাবনার রাখানগরে। মৃত্যু ১৯৭৯ সালে রাজশাহীতে। গ্রামে-গঞ্জে মানুষ। দীর্ঘদিন কেটেছে মহানগরী কলকাতায়-জীবন সংগ্রামে, লেখক হবার সাধনায় লিপ্ত থেকে। শিল্পী হবার প্রয়াসে, উচ্চশিক্ষা লাভে ব্যর্থ বন্দে আলী- অনেকটা অর্থ, কিছুটা পরামর্শের অভাবে। তথাপি এটা অনস্বীকার্য যে, একজন স্বভাব কবি ও আত্মগত শিল্পী প্রতিভা নিয়েই তার জন্ম। কিন্তু প্রতিভার সম্যক লালন ও পরিচর্যা ঘটেনি। অভিপ্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ত হলেও মূর্ত ও মহিমান্বিত হয়ে উঠেনি। অজস্র চিত্র অঙ্কনের পরও তার শিল্পীখ্যাতি জোটেনি। ১৭৫ খানা গ্রন্থ প্রকাশের পরও তার সাহিত্যিক খ্যাতি হয়েছে খন্ডিত। কবিতার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি অন্যান্য রচনায়ও তাঁকে মূলত দেখা যাবে চধংঃড়ৎধষ, ফরফধপঃরপ এবং ফবংপরঃঢ়রাব গ্রামীণ, নীতিশুদ্ধ ও বর্ণনাত্মক সুর তার কবিতা ও কাহিনীতে বিধৃত। পূর্ব উত্তরবঙ্গের লোক-সংস্কতির পরিচ্ছন্ন রূপ হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় ঐতিহ্যের চলিষ্ণু ধারার পরিচয় এবং চিন্তা ভাবনাবিহীন কল্পকথাই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে জীবনব্যাপী সাহিত্য-সাধনায়। প্রেরণ এসেছে হয়তো দক্ষিণা-রঞ্জন মিত্র মজুমদার থেকে সুকুমার রায় যতীন্দ্রমোহন বাগচী থেকে কুমুদ রঞ্জন মল্লিক কিংবা মুসলিম প্রতিভাত্রয়ী কাজী নজরুল, গোলাম মোস্তাফা, জসীম উদ্দীন প্রমুখের কাছ থেকে। কিন্তু নিষ্ঠা, আন্তারিকতা ও বৈচিত্র্যের গুণে স্বকীয় একটি ধারা নির্মাণেও সক্ষম হয়েছেন বন্দে আলী মিয়া। অবশ্য প্রধানত তিরিশের দশক থেকে শেষ পর্যায়ের রবীন্দ্রনাথ ও আন্তর্জাতিক শিল্প সমাজ চিন্তার যোগফলে যে সাহিত্য-ঐতিহ্য ফলপ্রসূ হলো তার সঙ্গে কোনো সাক্ষাৎ সম্বন্ধ ছিল না তার। ফলত সৃষ্টি প্রাচুর্য সত্তেও তাঁর খ্যাতির দিগন্ত ব্যাপ্তি লাভ করল না সীমাবদ্ধ রইল। তবু পাকিস্তান আমলেই তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর তিনি কোনো বিশেষ মর্যদায় ভূষিত হননি। এটা খুবই দুঃজনক। জীবৎকালে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জনপদে তিনি অবশ্য সম্বধিত হয়েছেন আন্তরিকভাবে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন