এল ঈদুল ফিতর, এল ঈদ ঈদ ঈদ
সারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাক’ নিদ।
হ্যাঁ, সুদীর্ঘ একমাস ব্যাপী সিয়ামের কৃচ্ছ্র সাধনার পর পরম পুলকের অফুরান সওগাত নিয়ে আমাদের দ্বারে আজ হাজির হয়েছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। পরওয়ারদেগারে আলম মহান আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন রমজানের রোজা পালনের- আমরা তা পালন করেছি। দীর্ঘ একমাস ব্যাপী পরিচালনা করেছি মহাশত্রু শয়তানের বিরুদ্ধে এবং আভ্যন্তরীণ শত্রু কুপ্রবৃত্তি-নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে অবিরাম জিহাদ। ধৈর্যের, সংযমের, সবরের, শোকরের, তাকোয়া অর্জনের, সহমর্মিতা, সমবেদনা হাসিলের এবং আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়ার সাধনার যে বার্ষিক প্রশিক্ষণ কোর্স- তা আমরা পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছি, তাইতো এ আনন্দ। সংগ্রামে সাফল্য অর্জনের আনন্দ, বিজয় গৌরব অর্জনের আনন্দ। যে সৈনিক শত্রæর মোকাবেলায় ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যায় না, তার যেমন রণবিজয় অর্জনের আনন্দ-উৎসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের নৈতিক অধিকার থাকে না, তেমনি রমজানের এই প্রশিক্ষণে যারা অংশগ্রহণ করেনি, বহিশত্রæ ও আভ্যন্তরীণ শত্রæর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যায়নি, পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দ-উৎসবে অংশগ্রহণের নৈতিক অধিকারও তাদের নেই। আরব্য কবির ভাষায় :
ঈদ তার জন্য নয়, যে রমজানের দিনে পানাহার করেছে
প্রকৃত ঈদ তার জন্য যে তার নেকী আল্লাহতে সমর্পণ করেছে।
নব নব মনোরম লেবাসে পোশাকে, বসনে ভূষণে সজ্জিত হওয়াই ঈদ নয়
প্রকৃত ঈদ তার জন্য যে ভীত সন্ত্রস্থ ছিল কিয়ামত দিবসের।
আতর গোলাব, মিশক আম্বর-চর্চিত হওয়ার নাম ঈদ নয়
প্রকৃত ঈদ তার জন্য যে খালেস তওবা করেছে,
আর পাপাচারে লিপ্ত না হওয়ার কঠোর সংকল্প নিয়েছে।
মহা আড়ম্বরে, দামী বাহনে আরোহণ করে ঈদগাহে আগমনের নাম ঈদ নয়
প্রকৃত ঈদতো তাঁর যে আজীবন পাপাচার-মুক্ত থাকার সংকল্প নিয়েছে।
ঈদ যেমন আনন্দ উৎসবের দিন, তেমনি আত্মসমীক্ষারও দিন। আত্মসমীক্ষার বিষয় হলো যে সকল গুণ অর্জন ও যে সকল দোষ বর্জনের জন্য এ সংযম সাধনাÑ তা কতটা অর্জন ও বর্জন করতে সক্ষম হলাম। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তো জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘বহু রোজাদার এমন আছে যাদের রোজা পানাহার বর্জন তথা উপবাস বৈ কিছুই নয়। আর বহু নৈশ নামাজী এমন আছে, যাদের নামাজ রাত জাগরণ বৈ কিছুই নয়’। মূল লক্ষ্য অনুধাবন, অনুধ্যান না করে কেবলমাত্র নিস্প্রাণ আনুষ্ঠানিকতার দ্বারা কোনো ফায়দা নেই। এরূপ ইবাদত দ্বারা বরং সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ ই হয় বেশি। এজন্যই ইসলামে নিয়্যতের ওপর এ তো বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
মুসলিম জাতির এই পবিত্র উৎসবটির সূচনা হয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরতের পরে। নবীজী সা. যখন হিজরত করে মদীনা গেলেন তখন দেখতে পেলেন, সেখানকার লোকেরা বছরের দুটি নির্দিষ্ট দিনে খেল-তামাশা ও আনন্দ-উৎসব করে থাকে। নবী স. জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে, এদিন দু’টিতে তারা পূর্ব থেকেই খেল তামাশা ও আনন্দ উৎসব করে আসছে। নবীজী সা. তখন বললেন: আল্লাহ তোমাদেরকে এ দু’টি দিনের পরিবর্তে অন্য দু’টি দিনকে উৎসবের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। তার একটি হচ্ছে ‘ঈদুল ফিতর’ অন্যটি ‘ঈদুল আজহা’। কেবলমাত্র খেল-তামাশা, উৎসব-আনন্দ লক্ষ্য হলে তখনকার প্রচলিত প্রথার দিন দুটিই যথেষ্ট ছিল। তা পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ইসলামের আচার-অনুষ্ঠান, ইবাদত-বন্দেগী সব কিছুই স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর। সব কিছুই আল্লাহতে নিবেদিত। সব কিছুর চূড়ান্ত লক্ষ্য আল্লাহর রিজামন্দি বা সন্তুষ্টি। তাই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, অন্যান্য জাতির উৎসব-আনন্দ আর মুসলিম জাতির উৎসব আনন্দের রূপ-প্রকৃতি এক নয়। উভয়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক, সুস্পষ্ট পার্থক্য।
এখন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে সারা বিশ্বের উৎসব আনন্দ দেখার মওকা মিলেছে। থার্টিফাস্ট নাইটসহ অনেক উৎসব অনুষ্ঠানেই দেখা যায় মদখুরী মাতলামীর মচ্ছব। নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা ও উৎকট বেলেল্লাপানা। এ রূপ উৎসব পালনের অনুমোদন দেয় না ইসলাম। ইসলামের উৎসব স্বতন্ত্র মহিমায় মÐিত।
ঈদুল ফিতরের কথাতেই আসা যাক। এ উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় শাওয়ালের চাঁদ উদয় হয়ে যাওয়ার পর থেকে। যে পাঁচটি রাতের ইবাদত আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে বিশেষভাবে মকবুল তার একটি রাত হচ্ছে ঈদের দিনের পূর্বেকার শাওয়ালের প্রথম রাত। মুমিনবান্দাগণ, এ রাতটি কাটিয়ে দেয় আল্লাহপাকের দরবারে শোকরিয়া আদায়, ইবাদত বন্দেগী ও দোয়া-মুনাজাতের মধ্যদিয়ে। সূর্যোদয়ের পরে সামর্থ্যবানরা আদায় করে সাদকাতুল ফিতর। যাতে অভাব ক্লিষ্ট, গরীব মিসকিনরাও পানাহারে পরিতৃপ্ত হয়ে উপভোগ করতে পারে পূর্ণাঙ্গ ঈদের আনন্দ।
হাদীস শরীফে এসেছে: রোজাকে বেহুদা, অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং গরীব-মিসকীনদের আহার্যের ব্যবস্থা করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামর্থ্যবান লোকদের জন্য সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব ঘোষণা করেছন। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পূর্বে তা আদায় করে দিবে আল্লাহ পাক তাকে একটি মঞ্জুরকৃত (মকবুল) সাদাকার সমান সওয়াব দান করবেন। আর যে তা নামাজের পরে আদায় করবে সে একটি সাধারন সাদাকার সমান সওয়াব পাবে। (আবু দাউদ)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘ঈদুর ফিতরের দিন ফেরেশতাগণ রাস্তার মুখে মুখে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলতে থাকেন হে মুসলিমগণ! নেক আমলের তাওফীকদাতা ও তাতে সওয়াব বাড়িয়ে দেনেওয়ালা মহান আল্লাহর পানে তোমরা শীঘ্র এগিয়ে চল। তোমাদেরকে রাতে ইবাদত করার হুকুম দেওয়া হয়েছিল, তোমরা তা করেছ, দিবাভাগে রোজা রাখার হুকুম
দেয়া হয়েছিল, তোমরা তা পালন করেছ এবং তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে আহার করিয়েছ অর্থাৎ গরীব-দুঃখীকে আহার্য দান করেছ, আজ তার প্রতিদান গ্রহণ কর। এরপর যখন তারা ঈদের নামাজ আদায় করে নেয় তখন আবার ফেরেশতা উচ্চস্বরে ঘোষণা করতে থাকেন, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখন তোমরা পবিত্র দেহ-মন নিয়ে ঘরে ফিরে যাও। এ দিন হল পুরস্কার বিতরণের দিন। আসমান-জগতে এ দিনের নাম পুরস্কারের দিন।’ (তিবরানি)।
ইসলামের প্রতিটি অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়েই মহান ¯্রষ্টার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য এবং সাম্য-মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের মহান রূপটি ভাস্বর হয়ে ওঠে। সে কীযে অপরূপ দৃশ্য! প্রভাতে আল্লাহর নেকবান্দারা গৃহ ত্যাগ করে মৃদুস্বরে তাকবীর উচ্চারণ করে করে এগিয়ে চলছে ঈদগাহের দিকে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফেরেশ্তারা দাঁড়িয়ে জানাচ্ছেন তাদের স্বাগত। ঘোষণা করে যাচ্ছেন, তাদের ইবাদত-বন্দেগী কবুলের খোশখবরী।
শুনিয়ে যাচ্ছেন পরম দয়ালু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক তাদের পুরস্কার প্রদানের সুসংবাদ। এভাবে নামাজীরা পৌঁছে গিয়ে ঈদের ময়দানে। ঊর্র্ধ্বে নীল আকাশের শামিয়ানা। নি¤েœ অবারিত ময়দান। ধনী-গরীব, আমীর-ফকীর, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে আদায় করছে সালাত। সালাতের পরে মিলাচ্ছে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ, বুকে বুক। সব মানুষ যে এক আদমের সন্তান, পরস্পরে ভাই ভাইÑ এমন দৃশ্য, তার এমন বাস্তব উদাহরণ দুনিয়ার বুকে আর কোথায় আছে!
আজিকার এই ঈদের খুশী বিলাব সকলে
আজকের মত জীবন-পথে চলব দলে দলে
প্রীতি দিয়ে বিশ্ব নিখিল করব রে মুরীদ।।
আমাদের জাতীয় কবির গানে কী সুন্দরভাবেই না ফুটেছে ঈদের তাৎপর্য ও আহবান!
ওমন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানী তাকিদ।।
তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
জাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙ্গাইতে নিদ।।
আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত-দুশমন্ হাত মিলাও হাতে
তোর প্রেম দিয়ে র্ক বিশ্ব নিখিল ইস্লামে মুরীদ।।
চরম ভয় ও পরম আশাÑ এ দু’য়ের সমন্বিত রূপের যে তীব্র অনুভূতি তার নামইতো তাকোয়া। এই তাকোয়া গুণে গুণান্বিত হওয়ার অনুশীলনের জন্যই রমজানের সিয়াম সাধনা। যিনি যতটা আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারেন তার মনে ততটাই জাগ্রত হয় আল্লাহর রহমাত প্রাপ্তির আশা, আবার তাঁর রুদ্র রূপের শঙ্কায় ও আজাবের ভয়ে ততটাই সে হয় ভীত শঙ্কিত। পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে দুজন প্রখ্যাত সাহাবীর অবস্থা থেকে অনুভব করা যায় এর কিছুটা স্বরূপ। তাঁদের একজন হলেন দ্বিতীয় খলীফা ফারূকে আজম হযরত ওমর রা., অপরজন হলেন চতুর্থ খলীফা শেরেখোদা হযরত আলী হায়দর রা. (যে দশজন সাহাবীকে দুনিয়াতে বসেই বেহেশ্তী হওয়ার সুসংবাদ শুনিয়েছেন প্রিয় নবী সা. এ দু’জন তাঁদের অন্যতম)।
এক ঈদের দিনে একজন সাহাবী হযরত আলীকে শুকনো রুটি চিবিয়ে খেতে দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আজতো পরম আনন্দ উপভোগের দিন, এ দিনে আপনি কেন শুকনো রুটি চিবুচ্ছেন? জবাবে হযরত আলী রা. বললেন, খুশি হওয়া তো তাদের জন্যই শোভা পায়, যাদের গুনাহ মাফ হয়েছে। কিন্তু আমি তো জানি না আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছি কিনা। (গুনীয়াতুত্তালেবীন)।
অনুরূপ এক ঈদের দিনে ওমর ফারূক রা. ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদছিলেন। জনৈক সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, আমীরুল মুমিনীন! আজকে ঈদের এই খুশির দিনে, সবাই তো খুশিতে মশগুল, অথচ আপনি এদিনে এরূপ কাঁদছেন, কেন? তিনি বললেন: আমি একদা প্রিয় নবী সা. কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমজান পেল অথচ আমলের দ্বারা নিজ গুনাহখাতা মাফ করিয়ে নিতে পারল না তার ধ্বংস অনিবার্য। তাদের জন্যই তো ঈদ, সত্যিকার আনন্দ ও খুশির দিন যারা গুনাহখাতা মাফ করিয়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু আমি তো জানি না যে, আমার গুনাহখাতা মাফ করিয়ে নিতে পেরেছি কিনা? (সুবহানাল্লাহ)। একেই বলে তাকওয়া। তাই খুশির সাথে সাথে আমাদের আত্মসমীক্ষাও করে দেখতে হবে যে, আমরা কতটা তাকওয়া গুণে ভূষিত হতে পেরেছি।
এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৪৪২ হিজরীর ঈদুল ফিতরের অনুষ্ঠান। করোনা ভাইরাসের মারাত্মক ছোবলে গোটা বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। দিকে দিকে শোনা যাচ্ছে আক্রান্ত মুমূর্ষু মানুষের মরণ গোঙরানী, স্বজনদের আর্তবিলাপ, কর্মহীন বুভূক্ষ মানুষের আহাজারী। অপরদিকে মুসলিম জাহানব্যাপী অনৈক্য, সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাত। এ অবস্থায় আমাদের মহান আল্লাহর বাণী স্মরণ করতে হবে বারবার। তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য তোমাদের অভ্যুদয়। পবিত্র রমজানের শিক্ষা নিয়ে, ঈদের তাৎপর্য অনুধাবন করে, কর্তব্য সাধনে দৃঢ় পায়ে অগ্রসর হতে হবে সম্মুখ পানে। মহান আল্লাহ আমাদের সে তৌফিক এনায়েত করুন, আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন