করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই মহামারি আজ নতুন নয়। যুগে যুগে নানা নামে এরূপ মহামারীতে ধরনীর মানুষ পৃথিবী ছেড়ে দ্রæত চলে গিয়েছে। ৫৪১ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনদোলে জাস্টিনিয়ান প্লেগ নামে ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও আরব অঞ্চসহ ৫ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। ১৩৪৭ সালে আঘাত হানে ‘বø্যাক ডেথ’ নামে জাস্টিনিয়ান প্লেগের ৮০০ বছর পর ইউরোপে আঘাত হানে। এই মহামারিতে প্রায় ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে। গুটি বসন্ত ইউরোপ, এশিয়া ও আরব অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে মহামারি হিসাবে দেখা দেয়। ১৯৮০ সালের পূর্বে পর্যন্ত গুটিবসন্তে আমেরিকা মেক্সিকো ও ইউরোপে অনেক লোক মারা যায়। বৃটিশ চিকিৎসক প্রায় এক শতাবিদ পর গুটি বসন্তের টিকা তৈরি করেন এডওয়ার্ড হেনার।
১৮১৭ সালে রাশিয়া প্রথম কলেরা মহামারি আকারে দেখা দেয়। সেখানে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ১০ লক্ষ। পরবর্তীতে স্পেন, আফ্রিকা, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, ইতালি, জার্মানী, ভারত ও আমেরিকায় কলেরাা মহামারী হিসাবে দেখা দেয়। তাতে প্রায় ২০-২৩ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। জন সেøা নামক এক বৃটিশ ডাক্তার পানি দূষিত হওয়াতে কলেরার বিস্তার আবিষ্কার পর বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে কলেরা কমে আসে।
আজকের বিশ্বে করোনা ভাইরাস কিংবা কোবিড-১৯ মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করছে। বর্তমানেবিশ্বব্যাপী করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা-৩১৭২২৩ জন আক্রান্তের সংখ্যা-৪৮৩৩৩৫০ জন সুস্থ হয়েছেন-১৮৭১৮১৬ জন বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত সংখ্যা ২৩৮৭০জন আমাদের দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৪৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪৫৮৫জন।
ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনা ঃ করনার আক্রমণে বাংলাদেশের সরকারি ভাবে লক ডাউন ঘোষণা করা হয় ২৪শে মার্চ ২০২০। প্রথমে ২৬শে মার্চ ২০২০ থেকে ৪ঠা এপ্রিল। পরবতর্েিত ১১ই এপ্রিল এবং ক্রমেই আগামী ৩০ মে পর্যন্ত সকল সরকারি বেসরকারি অফিস, শিল্প কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে সকলকে নিজ নিজ ঘরে থাকার আহŸান জানানো হয়। আমরা তাই সকলে ঘরে আবদ্ধ। দেশের দোকান, শিল্প কারখানা, সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সকল বন্ধ করে দেয়া হয়। নৌ-স্থল, বিমান সকল স্তরে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে।
দেশের পুরো অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যাংক, বীমা শিল্প, বন্দর সকল কিছুর কর্মতৎপরতা বন্ধ। আমদানি-রপ্তানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। বিশ্বজুড়ে চলেছে লকডাউন। সারা পৃথিবী আজ অচল। দুনিয়ার অর্থনৈতিক সকল কর্মকান্ড বন্ধ। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে চলেছে লকআউট। জীবন প্রবাহ বন্ধ। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সকল বন্ধ।
করোনার উৎপত্তি ঃ বিগত ৩১শে ডিসেম্বর ২০ চীনের উহান শহরে অজ্ঞাতকারণে মানুষের নিমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি সনাক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দ্রæত এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।দুই মাসের বেশী সময় ধরে গোটা চীন কিংবা পুরো পৃথিবীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না উহান শহরের। লকডাউনে ছিল উহান শহর গত শনিবার ২৯শে মার্চ ২০ পর্যন্ত। ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নিতে থাকে। ৩ কোটি প্রদেশের সকল মানুষ ঘরে বন্দি ছিল। ৫০ হাজারের বেশী আক্রান্ত হয়। গোটা চীনে আক্রান্ত হয় ২৯শে মার্চ ২০ পর্যন্ত প্রায় ৮২ হাজার। ঐ দিন পর্যন্ত মারা যায় ৩ হাজার ২৯৯ জন। চীন থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। ইতালী, ফ্রান্স, জার্মানী, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য সৌদি আরবসহ বিশ্বের সকল দেশ ও অঞ্চলসহ ২১২টি।
মানবিক সঙ্কটে বৈশ্বিক উদ্যোগ : সামাজিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় পাশাপাশি পাঁচ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছেন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে। করোনা ভাইরাসের মহামারিকে সবার জন্য অভিন্ন লড়াই হিসেবে দেখছে বিশ্ববাসী। এই শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জকে একসঙ্গে রুখতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর জি-২০ এর শীর্ষ নেতারা বিগত ২৬শে মার্চ ২০ এক ভার্চ্যুয়াল শীর্ষ সম্মেলন করেন। এতে নেতারা একসঙ্গে করোনার বিরুদ্ধে লড়ার ঘোষণা প্রদান করেন। সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে করোনার কারণে সৃষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় এক সঙ্গে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে ৫ হাজার কোটি ডলারের এক তহবিল ঘোষণা দেন। ভারত সরকার দেশজুড়ে লকডাউন করেছেন ২১ দিনের জন্য। সকল শ্রমিকের বেতন দিচ্ছেন সরকার। দিন মজুর ও দৈনিক আয়ের মানুষের ঘরে ঘরে খাদ্য সামগ্রী পৌছে দিচ্ছেন। সারা দেশজুড়ে লকডাউন করে করোনা সঠিকভাবে মোকাবেলা করার ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আমাদের বাংলাদেশে বর্তমানে ঢিলাঢালে লকডাউন চলছে। খাদ্য সামগ্রী গরীবদের জন্য সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে দেয়া হচ্ছে। রফতানিমুখি শিল্প শ্রমিকদের বেতনের জন্য ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার এক তহবিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক হালচাল: বাংলাদেশে অর্থনীতিসুলভ তৈরী পোশাক শিল্প, বৈদেশিক প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, চামড়া, চা, প্রসেস মাছ এবং কিছু ইলেকট্রিক পন্য। বাংলাদেশে করোনা ধরা পড়ে ৮ই মার্চ ২০ ২৪শে মার্চ ২০ সরকার থেকে ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করেন। ব ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস শিল্প কারখানা সকল কিছু বন্ধ ঘোষনা করা হয়। কিছু কিছু তৈরী পোশাক শিল্প কারখানা খোলা থাকে। কারখানায় কাজ চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে সকলকে ঘরে থাকতে। কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন তৈরী পোশাক শিল্প কারখানা খোলা রাখতে পারবে। এই দ্বৈত ঘোষণা সমস্যা সৃষ্টি করছে। দোকানপাট, বাস, ট্রাক, রেল, বিমান, স্টীমারসহ সকল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। দেশের অর্থনীতি এমন একেবারে স্থবির। আগামীতে কে আশা হবে এই মুহ’র্তে বলা যাবে না। ব্যাংক, বীমাসহ সকল অফিস এর কর্মতৎপরতা নাই বললে চলে।
তৈরী পোশাক শিল্প : তৈরী পোশাক শিল্প সবচেয়ে বড় ধাক্কা। ইউরোপ, আমেরিকাসহ সকল আমদানীকৃত দেশ ভীষণভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। ঐ সকল দেশে সম্পূর্ণরূপে লকডাউন রয়েছে। শিল্প বাণিজ্য দোকানপাট, ব্যবসা বাণিজ্য একেবারে বন্ধ। তাই বড় বড় ক্রেতা তাদের অর্ডার বাতিল করেছ। নতুন কোন রপ্তানি আদেশও দিতে পারছে না। এই অবস্থা আগামী ৬ মাসের পূর্বে ঠিক হবে না মনে হয়। তাই রপ্তানিতে বড় রকমের ধস নামার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্পিনিং, টেক্সটাইল খাত ঃ তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল জোগান দেয়ার খাত হচ্ছে দেশের স্পিনিং ও টেক্সটাইল খাত। দেশে সকল স্পিনিং, টেক্সটাইল, শিল্প প্রতিষ্ঠান এখন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ। ক্রয় বিক্রয় সম্পূর্ণ বন্ধ। নতুন কোন বিক্রয় আদেশ নাই। কখন স্বাভাবিক ক্রয় বিক্রয় শুরু হবে বলা এখনও যাচ্ছে না।
প্রবাসীদের আয় ঃ আমাদের অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে প্রবাসীদের রেমিটেন্স। সারা বিশ্ব করোনা আক্রান্ত হওয়ায় আমাদের এক কোটি প্রবাসী হুমকির সম্মুখীন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রবাসীর মৃত্যু? বিদেশে কর্মচ্যুত হয়েছে প্রায় সকল প্রবাসী। সেখানে প্রবাসীদের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ। সকল প্রকার আয় বন্ধ। প্রতিদিন সেখানে
হাজার হাজার বাংলাদেশী বিদেশ যেতেন, সেখানে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। কখন বিদেশে বাংলাদেশী যেতে পারবে তাইও কোন নির্দিষ্ট সময় বলা মুশকিল। তবে কমপক্ষে ৬ মাসের পূর্বে কোন ধারণা পাওয়া বেশ কঠিন।
চামড়া, চা, পাট শিল্প ঃ আমাদের রপ্তানিতে চামড়া শিল্প বহু লাভবান খাত। একসময় পাট শিল্প দেশের একমাত্র রপ্তানিখাত ছিল। চা ও একসময় রপ্তানিতে বেশ বড় অবদান রাখে। বর্তমানেও চামড়া, চা, পাট ও একসকল দ্রব্য থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিতে বেশ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু আজ করোনা আক্রমণের কারণে আমদানী, রপ্তানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। সকল শিল্প কারখানা বন্ধ রয়েছে। রপ্তানি আদেশ এখন আর দেশে আসছে না। ঝুকিতে এই সকল খাত বড় বিপদে পড়েছে।
আমাদের মেগা প্রকল্প ঃ আমাদের মেগা প্রকল্প বিগত কয়েক বছর ধরে বেশ দাপটের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। যার ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বেশ বৃদ্ধিতে। বর্তমান অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান করোনা মহামারীতে পুরোদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে রয়েছে। এখন প্রয়োজন প্রথমে দেশের মানুষের জীবন রক্ষা করা। মানুষ বাঁচলে তো অর্থনীতি। তাই মানুষের জীবন রক্ষার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। মেগা প্রকল্পের অর্থ মানুষের জীবন রক্ষার স্বার্থে হ্রাস করতে হবে। কোন কোন প্রকল্প ধীরে চালাতে হবে। এখন প্রয়োজন করোনা মহামারী থেকে জাতিকে রক্ষা করা। সারা বিশ্বের দিকে তাকালে আমাদের উদ্যোগ, পরিকল্পনা অর্থ সংগ্রহ খুবই নগন্য। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। আমেরিকা, ইতালী, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানী, যুক্তরাজ্যসহ উন্নতদেশসমূহ করোনা আক্রমণে দিশেহারা। প্রতিদিন শত শত লোক মৃত্যুবরণ করছে। আল্লাহ ভাল জানেন আমাদের কি অবস্থা হবে।
ব্যাংক, বীমা, অ-আর্থিক খাত ঃ ৫ই এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবেলায় দেশের আর্থিক খাত, শিল্প বাণিজ্যসহ, দেশের দরিদ্র মানুষের সহায়তা করার জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রনোদনাও ঋণ সহায়তা ঘোষণা করেছেন। আশা করেছেন এই প্যাকেজ ঘোষণার পর ভবিষ্যতে অর্থনীতি স্থবির না হয়ে গতিশীলতা বজায় রাখতে পারবে। ইতিপূর্বে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন বাবদ ২ শতাংশ হারে ঋণ সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমানে ঘোষিত ঋণ সুবিধায় সকল শ্রেণীর শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান ব্যাংকিং খাত মহা অরাজকতার মধ্যে দিয়ে চলেছে। সুশাসনের অভাবে ব্যাংকি খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপী ঋণে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ৮ হাজার কোটি টাকার অধিক বৈদেশিক অর্থ জালিয়াত চক্র হাতিয়ে নিয়েছে। অর্থ উদ্যার করা এখনও সম্ভব হয় নাই। আইনের শামিল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিক তদারকি স্বচ্ছতার সঙ্গে করার উপর ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যত নির্ভর করে।
ট্যুরিজম, সেবা খাত ঃ করোনা ভাইরাস অন্যান্য খাতের মত সেবা খাত ও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া শুরু হয়েছে। দেশী বিদেশী সকল যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার ফলে হোটেল, রেষ্টুরেন্ট, বিনোদনসহ সকল খাত সমূহে ব্যবসা বন্ধ। শ্রমিক কর্মচারীরা বেকার। উদ্যোক্তাগণ কর্মহীন। আয় বন্ধ। ব্যয় কিন্তু চালু রয়েছে। সেবা খাতের আর একটি বড় দিক হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। দেশে সরকারি হাসপাতালসমূহের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক ব্যবসা ও ধস নেমেছে। করোনা ভয়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে ডাক্তারগণ ঠিকমত দায়িত্বপালন করতে পারছে না। নানা ভয়ে সাধারণ রোগীগণও চিকিৎসকের সেবা নিতে আসছে না। তাই বেসরকারি হাসপাতালসমূহে বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছে।
পোল্ট্রি খামার ব্যবসা ঃ করোনা ভাইরাসের ফলে পুরোদেশ বলতে বিগত ২৬শে মার্চ ২০ থেকে লকডাউন চলেছে। যার ফলে স্থানীয় বাজার ব্যবসা চলছে না। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি এখন বন্ধ। বড় বড় শহরে হোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকার কারণে কৃষি পণ্যের বিক্রি বন্ধ হয়ে পড়েছে। দুধ, মাছ, সবজি উৎপাদনকারীগণ করোনা ভাইরাসের জন্য সরাসরি ক্ষতি মুখে পড়েছে। আগামীতে এই খাতের সমস্যা আরও বেশী ঘনীভূত হবে।
করোনা-মোকাবেলায় আমাদের জরুরি পদক্ষেপ ঃ
১. কোভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাস এখন বিশ্বজুড়ে একটি মহামারী। যুগে যুগে আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় মানুষকে সংশোধন করার জন্য, আল্লাহপাকের আনুগত্যে ফিরিয়ে আনার জন্য এই সকল মহামারী অতিব গুরুত্বপূর্ণ সতর্ক বার্তা। কখনও মানুষ তা বুঝে, কখনও না বুঝার ভান করে কাটিয়ে দেয়। মুসলমান হিসাবে আমাদেরকে এই ধরনের মহামারি আল্লাহ প্রদত্ত সতর্ক বার্তা বিশ্বাস করে সঠিকভাবে তওবা করে, সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যে ফিরে আসতে হবে। আর আল্লাহপাক তওবা কবুল করলে এই মহাদুর্যোগ থেকে আমাদের বিশ্ববাসীকে ক্ষমা করবেন। আসুন আমরা সেই সঠিক কাজটি করি।
২. এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারকে জাতীয় পর্যায়ে একটি শক্তিশালী জাতীয় কমিটি গঠন করা জরুরি। এই কমিটির প্রধান হতে হবে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর মেডিকেল কোরের শীর্ষ কর্মকর্তা। এই কমিটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী দ্রæত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাতে সমস্যার সমাধানের দ্রæত উন্নতি ঘটবে।
৩. আগামী কয়েক মাসের জন্য হতদরিদ্র, নিম্নআয়ের মানুষ ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জন্য খাদ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসার সাথে সাথে যাতে খাদ্যের অভাবে কোন মানুষ মৃত্যুবরণ করতে না হয়। দলমত সকলকে নিয়ে এই কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সকল রাজনৈতিক দলকে সম্পৃক্ত করে সরকারকে এই দুর্যোগের মোকাবেলা করতে হবে। নতুবা জাতির জন্য বড় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে।
৪. প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিটি থানা হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য জরুরি ভাবে প্রস্তুত করতে হবে এবং সেবা দিতে হবে। সরকারকে এই ব্যাপারে সঠিক ও দ্রæত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে হবে।
৫. প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে শহরে প্রতিটি ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের সঙ্গে সঙ্গে মরদেহ দাফনের জন্য কমপক্ষে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রোটেকটেড স্বাস্থ্যসম্মত টিম গঠন করা দরকার। দ্রæত মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে।
৬. শ্রমিকদের বেতন প্রতি মাসে নিজ নিজ একাউন্টে পৌছানোর জন্য এখনই দ্রæত ব্যবস্থা সরকারিভাবে করতে হবে। শুধু বেসিক বেতন দিলে শ্রমিকদের ব্যয় নির্বাহ হবে না। এর পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যে সকল কারখানায় নগদ বেতন দেয়া হচ্ছে, ঐ সকল কারখানা এখন ব্যাংক একাউন্ট বা বিকাশ এ্যাকাউন্ট বা রকেট এ্যাকাউন্ট খোলে তাতে দেয়ার বিধান করতে হবে। বিগত তিন মাসে যাদের বেতন এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে, তাদের শুধু বেতন দিলে বিষয়টি জটিলতা সৃষ্টি হবে। এখনই করা এ্যাকউন্ট বা কারখানা মালিক কর্তৃক সরবরাহ শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন রয়েছে।
৭. এই মুহ’র্তে সরকারকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কার্যক্রম নিয়ে দ্রæত জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সকল হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সমন্বয় করে করোনা মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে। অনেক বিলম্বে সরকার রোগ মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালী, ফ্রান্স, জার্মানী, ইরানসহ সকল উন্নত দেশ করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছে। ঠিক সময়, সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার ফলে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ানসহ বেশ কিছু দেশ দেশবাসীকে করোনার ভয়াবহ পরিণতি থেকে কিছুটা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।
এখন আমাদেরকে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরের আস্থা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তা না হলে দেশের মানুষ অতিমাত্রায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে, অতিবেশী সংখ্যক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে।
৮. বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো করোনা মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এখন এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে বেশ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল বিগত কয়েক বছর ধরে বেশ ভাল ব্যবসা করে এসেছে। প্রচুর অর্থ এই সকল বেসরকারি হাসপাতাল বিগত বছরগুলোতে উপার্জন করেছে। এখন সময় এসেছে দেশের মানুষের সেবা করার। এখন দেশের মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি। এখন মানুষকে বাঁচানোর জন্য সকলকে সর্বশক্তি দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
ইতিমধ্যে বেসরকারীভাবে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য এগিয়ে এসেছেন বসুন্ধরা গ্রæপ ও আকিজ গ্রæপ। বসুন্ধরা গ্রæপ দুই হাজার বেডের একটি হাসপাতাল নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করেছেন। আকিজ গ্রæপ তেজগাঁয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনিভাবে আমি মনে করি আরও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, গ্রæপ চিকিৎসায় সেবায় এগিয়ে আসবে।
৯. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সমন্বয় এখন খুবই জরুরি। শুধুমাত্র কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল দিয়ে ব্যাপক সংক্রামক করোনা মোকাবেলা বড় কঠিন। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালটি এখনও পর্যন্ত করোনা ভাইরাস রোগী সেবা দেয়ার মত পূর্ণাঙ্গ রূপ সরকার দিতে পারেন নাই। নানা সমস্যা ও প্রয়োজন এখনও সমাধান দিতে পারেন নাই। এমন কি ডাক্তার, নার্সদের খাওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা হয় নাই। সিনিয়র কোন ডাক্তার এখন পর্যন্ত উক্ত হাসপাতালে নিয়োগ দেয়া হয় নাই। এই সমস্যা সমাধান দ্রæত প্রয়োজন।
ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২ হাজার বেডের ২টি সম্পূর্ণ হাসপাতাল করোনার জন্য নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে সরকার এই কাজটি করতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল থেকেও বেশ কয়েকটি করোনার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়ে কাজ শুরু করা প্রয়োজন। ঢাকা ছাড়া অন্যান্য প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে ১ হাজার বেডের একাধিক হাসপাতালকে তৈরি করে কাজ শুরু করা প্রয়োজন।
১০. খাদ্য সহায়তা ও ক্ষুধার্ত মানুষের নিকট একটি জাতীয় ভিত্তিক সমন্বয়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে খাদ্য পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা জরুরি। এই ক্ষেত্রে খাদ্য বিতরণ ও রিলিফ প্রদানের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়া প্রয়োজন। সকল রাজনৈতিক দল, এনজিও, সিভিল সমাজ ও সমাজ কর্মীদের খাদ্য সহায়তা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
এই কমিটি হতে হবে সর্বদলীয় জাতীয় কমিটি। একক শুধু সরকারি দল দিয়ে করতে গেলে দুর্নীতি, লুট, চুরি বন্ধ করা যাবে না। রিফি প্রদানের তালিকা ও উক্ত কমিটির তত্ত¡াবধানে করতে হবে। তাতে প্রকৃত অভাবী ব্যক্তি উপকৃত হবে।
গত ১৫ই এপ্রিল’২০ দেখা গিয়েছে চাল, গম, তেল প্রভাবশালী, সরকার দলীয় ব্যক্তিগণ প্রচুর পরিমান চুরি করছে। র্যাব, পুলিশ অনেক চালের, তেলের কাটন উদ্ধার করেছে। অনেকে গ্রেফতারও করেছে। মামলাও হয়েছে। এদিকে বেশ কয়েক স্থানে খাদ্য সাহায্যের জন্য অভাবী মানুষ বিক্ষোভ করেছে। তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকেরাও বেতন পাওয়ার জন্য বিক্ষোভ করেছে। দিন দিন খাদ্য সহায়তা ব্যবস্থাপনা বেশ খারাপ দেখা যাচ্ছে। সর্বদলীয় কমিটি গঠন না করার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু বিগত নির্বাচনসমূহ স্বচচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয় নাই, তাই নির্বাচিত ব্যক্তিগণ মূলত জোর পূর্বক ও অঘোষিত নির্বাচিত। তাই সৎ, নিষ্ঠাবান, দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধিগণ নির্বাচিত হতে পারে নাই।
১১. টেষ্ট, টেষ্ট, টেষ্ট প্রয়োজন। দেশে বেশির ভাগ জেলা লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু টেষ্ট আমাদের খুবই কম। মাত্র সল্পসংখ্যক ল্যাব এ টেষ্ট হচ্ছে। ১৮ কোটি দেশে দৈনিক কত টেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তাই ধারে কাছে আমরা যেতে পারছি না। জরুরি ভিত্তিতে বিদেশ থেকে টেষ্টের জন্য ও ল্যাব আমদানি করে প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে স্থাপন করা দরকার। তা না হলে যত সময় টেষ্টের জন্য লাগবে তা অনুমান করলে দিশেহারা হয়ে যেতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টেষ্ট না করে গেলে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কোনক্রমেই সম্ভব হবে না। পৃথিবীর যে সকল দেশ করোনা ভাইরাস আক্রমণ হ্রাস করতে পেরেছে তাদের একমাত্র বিষয় টেষ্ট। টেষ্টের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে অবশিষ্ট জনগোষ্টিকে নিরাপদ রাখতে সম্ভব হয়েছে। একই পদ্ধতি হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও চীনের মত দেশ সমূহ আমাদের নিকট উদারহণ হিসেবে সামনে রয়েছে। এই করোনার আক্রমনে বিকল্প কোন চিকিৎসা নাই। এখনও পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয় নাই।
বাংলাদেশকে করোনা ভাইরাসে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষনা করা হয়েছে। দেশ মহামারীতে আক্রান্ত।
১২. আগামি তিন বছরের কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে অর্থনৈতিক ত্রৈবার্ষিক পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করছেন বলে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৮ই এপ্রিল ‘২০ স্বল্প সময়ের সংসদ অধিবেশনে ঘোষণা দিয়েছেন। কিভাবে এই মহাদুর্যোগের পর অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য কি কি পদক্ষেপ, কিভাবে নেয়া যাবে, কত অর্থ কোন খাতে কত বরাদ্দা রাখা হবে- তা গ্রহণ পূর্বক সরকার অগ্রসর হবেন। এইটি একটি বাস্তবসম্মত, যুক্তি সংগত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
১৩. খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়টি বর্তমানে এবং করোনা নির্র্মূল পর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিশ্বে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এই ধারা করোনা ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমাদেরকে ধরে রাখতে হবে।
বর্তমানে দেশে ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে এসে পড়েছে। সরকার এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে খাদ্য-নিরাপত্তা দিতে হবে। এখন থেকে কত দিন এই খাদ্য সহায়তা কত টাকার বিনিময়ে দেয়া যাবে তার সঠিক হিসাবে এখনও আসেনি। ইতিমধ্যে সরকার খাদ্য সহায়তা ও ব্যবসায়ীদের স্বল্পহারে সুদে মোট ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার অর্থ খরচ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
হতদরিদ্র ও অভাবী মানুষের খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য সঠিক তালিকা এখনও সরকার করতে পারে নাই। এই তালিকা তৈরী হওয়া প্রয়োজন। যাদের ন্যাশনাল আইডি নাই তাদেরও তালিকা জন্ম সনদ দেখে তৈরি করা প্রয়োজন। এখন সরকারের কাছে দেশের সকল নাগরিকের তালিকা থাকা জরুরি। ন্যাশনাল আইডি এখন পর্যন্ত সকল নাগরিকের হয় নাই। জন্ম সনদ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের পরিচয় পত্র নিশ্চিত করার পরিকল্পনা সরকারকে নিতে হবে। তাতে যে কোন প্রয়োজনের সময় প্রতিটি নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চিত হবে। অনুপ্রবেশ বা অবৈধভাবে কোন বিদেশী আমাদের দেশে থাকার কোন সুযোগ পাবে না। জাতীয় স্বার্থে এই বিষয়টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।তাং-১৮.০৫.২০২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন