বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

অর্থনীতির শত্রু হুন্ডি

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২১ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

হুন্ডি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সাক্ষাৎ শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভয়াবহ এ দানব গিলে খাচ্ছে অর্থনীতির অনেক ইতিবাচক অর্জন। হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড লাগিয়ে হুন্ডির ব্যবসা করছে বাংলাদেশের দুটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান। ফলে দেশে আসছে না ডলার। ডলার সংকটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানায় অচলাবস্থা দেখা দিচ্ছে। বন্ডে বিনিয়োগও চলছে মন্দা। প্রবাসীদের বন্ড নবায়ন হচ্ছে না।

মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে হুন্ডি হওয়ায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে, ছোট আকারের রেমিট্যান্সের অধিকাংশই আসছে এ উপায়ে। হুন্ডিকারীরা কৌশলে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সাইনবোর্ড টানিয়ে অর্থ সংগ্রহ করছে। এরপর মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের মাধ্যমে তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সুবিধাভোগীর কাছে। হুন্ডিকারীরাই মূলত কৌশলে এ কাজ করছে।

সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে যে শুধু রেমিট্যান্সের টাকাই আসছে তা নয়, ইয়াবা বা মাদক ব্যবসার লেনদেনের টাকাও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে দেশের বাইরে পাঠানো হচ্ছে। সম্প্রতি টেকনাফের মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের করা মামলার তদন্তে সিআইডি জানতে পারে, টেকনাফ থেকে ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রির পর, সেই বিক্রির টাকা আবার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টেকনাফে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে হাতঘুরে টাকা চলে যায় মিয়ানমারেও।

অংশীজনেরা বলছেন, বন্ডে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রচলিত আড়াই শতাংশের সঙ্গে আরও ১ শতাংশ প্রণোদনাসহ তিন স্তরে বিনিয়োগ সুবিধা থাকলে তবেই কমতে পারে হুন্ডি। পাশাপাশি হুন্ডিতে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দুদকের অনুসন্ধান ও বিদেশে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সবকিছুর আগে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। একটি গ্রহণযোগ্য মূল্য নির্ধারিত হলেই অনেক কিছু স্বাভাবিক হবে। ডলার সঙ্কট দেশের অর্থনীতি ফোকলা করে দিচ্ছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম এক বছরে বেড়ে গেছে ২০ শতাংশের বেশি। এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চিত টাকা থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে।

দেশের ডলারের দাম বাড়ার কারণে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। তদন্তে নেমে হুন্ডি কারবারের সঙ্গে জড়িত ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে গত ৪ মাসে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচার হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এছাড়া সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এমএফসে হুন্ডি করে এমন ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে।

বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর তদন্তে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীদের টাকা ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসার তথ্য ওঠে আসে। সিআইডির প্রধান বলেন, যে নাম্বারগুলোতে টাকা এসেছে, সেগুলো বেশিরভাগই বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের নামে নিবন্ধিত। এতে প্রবাসীদের অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসছে না। ফলে রেমিট্যান্স হারাচ্ছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ এসব হুন্ডি নাম্বার ব্যবহারকারীকে ধরতে মাঠে নামে সিআইডি। সংস্থাটি জানায়, গত এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ১ লাখ ৮১ হাজার ৫০৫টি সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিত করে বিএফআইইউ। এসব নম্বরের মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশ বা তার বেশি শুধু ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে। মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশের বেশি ‘ক্যাশ আউট’ হয়েছে। রাত ২টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে প্রতি মিনিটে চারটি বা তার বেশি ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে। এভাবে বিকাশের ৬৯ হাজার ৬১৩টি, উপায়ের ৩৮ হাজার ৮৩৫টি, রকেটের ৩৮ হাজার ৩৫৮টি এবং নগদের ৩৪ হাজার ৩৫৮ এজেন্টকে প্রাথমিকভাবে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব এজেন্টের তথ্য দিয়ে অধিকতর বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সে আলোকে ৫ হাজার ৮৯ জনের এজেন্টশিপ বাতিল করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর বাইরে অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত আরো ৩৩০টি এজেন্টের এজেন্টশিপও বাতিল করা হয়েছে। এরপর সব মিলিয়ে বাতিল হওয়া ৫ হাজার ৪১৯ এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিআইডিতে তথ্য দেয়া হয়েছে।

ডলার সঙ্কট মোচনে যেসব কারণে প্রবাসীরা ব্যাংকিং খাতের বদলে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠছে সে পথ বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সক্রিয় হলে কারা হুন্ডির সঙ্গে জড়িত তা চিহ্নিত করা কঠিন কিছু নয়। কারণ, কোন এলাকার কারা হুন্ডি ব্যবসা করে এটি ওপেন সিক্রেট। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সক্রিয় হলে তাদের জালের মধ্যে আটকানো সম্ভব। সঙ্কট নিরসনে ব্যাংকিং খাতে আসা অর্থের জন্য প্রণোদনা বাড়ানোর বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন