শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সহনীয় মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সঙ্কট কাটানোর চ্যালেঞ্জ

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা আজ আইএমএফ’র ঋণ নিশ্চিতে দুটি মুদ্রানীতিতে ফিরছে বাংলাদেশ ব্যাংক দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা ভালো সিদ্ধান্ত : ড. আহসান এইচ মনসুর

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

অর্থনীতিতে চাপ সামাল দিতে এবং তারল্য সঙ্কট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ বিশেষভাবে প্রয়োজন বাংলাদেশের। আর তাই আইএমএফ’র ঋণের প্রথম কিস্তির টাকাটা যাতে ফেব্রুয়ারি মাসেই পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে বছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণার আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে আবার এক অর্থবছরে (আর্থিক বছর, ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ৩০ জুন) দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের ১ জুলাই ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরু হওয়ার পর ওই মাসের শেষের দিকে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরে এক অর্থবছরে একটি মুদ্রানীতিই ঘোষণা করা হতো। এবারও তেমনটিই হবে বলে সবাই ভেবেছিলেন। কিন্তু আইএমএফের পরামর্শে আজ রোববার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। যেখানে গুরুত্ব পাবে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আটকে রেখে জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনা এবং কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক) অর্জনের উদ্যোগ। বাজারে নগদ টাকার জোগান কেমন হবে? কতটা ঋণ দেয়া হবে উদ্যোক্তাদের? সরকারই বা কতটুকু ধার করতে পারবে ব্যাংকিং খাত থেকে! মুদ্রানীতির মাধ্যমে এমন সব লক্ষ্যই নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত কয়েক বছর এই নীতি বছরে একবার প্রকাশ করা হলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আইএমএফের ৪৫০ কোটি (৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন) ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে এখন তা আগের মতো ছয় মাস পর পর (এক অর্থবছরে দুটি) মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফের এই ঋণের বেশ কিছু শর্তের মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল এক অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে হবে। বেশি কিছু সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের শর্তে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই ঋণের প্রথম কিস্তির টাকা ছাড় করা হবে বলে সরকারকে জানিয়েছিল আইএমএফ।

অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, বাজারে টাকার জোগান আরও বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতিতে আরও চাপ তৈরি হবে। তখন সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত সিলিংয়ের (সর্বোচ্চ সীমা) মধ্যেই বাজারে টাকার জোগান বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হবে, যাতে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য মুদ্রানীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হলোÑ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা, যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও মুদ্রানীতির অন্যতম কাজ।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে আবার বছরে দুইবার মুদ্রানীতির যে ঘোষণা দিয়েছে সেটি অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত। দুইবার মুদ্রানীতি দিলে কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। তবে মুদ্রানীতির তাৎপর্য কমে গেছে সুদহার নির্দিষ্ট থাকার কারণে। অর্থাৎ ঋণের ৯ শতাংশ সুদ নির্দিষ্ট হওয়ায় মুদ্রানীতিতে নতুন কিছু থাকে না।

তিনি বলেন, সুদহারের নির্ধারিত সীমা যদি উঠিয়ে দেয় তাহলে নীতি সুদহার অর্থাৎ রেপো, রিভার্স রেপো রেট বিভিন্ন সূচক দিয়ে মুদ্রানীতিকে ব্যাখ্যা করা যায়। আর সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ বহাল থাকলে অন্য কিছু কাজ করবে না।

সূত্র মতে, দুই বছরের করোনামারির রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বেশ বাড়ছে। একই সময়ে বৈদেশিক সম্পদের পরিমাণ হ্রাস এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধিতে ভাটা চলছে। এতে ব্যাংক খাতে চলছে তারল্য সঙ্কট। এই বাস্তবতায় চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য ‘বাস্তবধর্মী মুদ্রানীতি’ প্রণয়ন করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

সঙ্কট মোকাবিলায় নতুন মুদ্রানীতিতে বাজারে টাকার প্রবাহ আরও বাড়ানো ও বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনার ওপর জোর দেয়া হবে। একই সঙ্গে এই সময়ে টিকে থাকতে বাড়াতে হবে কর্মসংস্থান, আর সে জন্য বিনিয়োগ দরকার। এমন এক অবস্থার মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে আজ রোববার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এটি হবে তার প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা।

বর্তমান গভর্নরের মেয়াদে এটি তার প্রথম মুদ্রানীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক আগে প্রতি ছয় মাসের আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করলেও গত ২ অর্থবছর তা ১ বছরের জন্য করা হয়। আর করোনার কারণে গত ২ বছর আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি অনলাইনের পরিবর্তে সরাসরি ঘোষণা করেন বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির।
তবে সম্প্রতি ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বছরে চারবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার পরামর্শ দিয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্য নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। আর পরিসংখ্যান ব্যুরো বছরে দু’বার এসব তথ্য প্রকাশ করে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকও বছরে দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বলে আইএমএফকে জানায়। এই ধারাবাহিকতায় অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশের রাখার সীমিত রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সবশেষ নভেম্বর মাস শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এজন্য মূল্যস্ফীতি সরকার নির্ধারিত মাত্রায় সীমিত রাখা চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

নতুন মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও তারল্য সরবরাহ ঠিক রাখা মুদ্রানীতির মূল কাজ। মুদ্রানীতি ঘোষণার আগে প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা দেশের অর্থনীতিবিদসহ সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক, মুদ্রা সরবরাহ, সংরক্ষিত মুদ্রা ও সুদহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মুদ্রানীতি কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, মূল্যস্ফীতির পারদ ঊর্ধ্বমুখী। অস্থির মুদ্রাবাজারও। ডলার লেনদেন হচ্ছে ১১০ টাকার উপরে। রয়েছে করোনার ধাক্কা। পাশাপাশি বৈশ্বিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডকে যাতে নিরুৎসাহিত না করা হয় সেদিকে মুদ্রানীতির দৃষ্টি থাকবে। এবারের মুদ্রানীতি হবে সতর্কতামূলক। পুরোপুরি সংকোচন বা সম্প্রসারণমূলক নয়। তারা বলেন, এই মুহূর্তে বাজারে টাকার প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা জরুরি। কারণ ডলারের সঙ্কটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করায় প্রচুর টাকা চলে এসেছে। ফলে টাকার সরবরাহ কমে তারল্য সঙ্কটে পড়েছে বেশ কিছু ব্যাংক।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ ঋণ বৃদ্ধির সংকুলান রাখা হয়। নভেম্বর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে নতুন মুদ্রানীততে এরকম প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হতে পারে। সব ধরনের ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের যে ঊর্ধ্বসীমা রয়েছে তা একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে নতুন করে একটি সীমা দেয়া হতে পারে।
জানা গেছে, ২০০৬ সাল থেকে বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও ২০১৯ সাল থেকে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির বছরে একবার মুদ্রানীতি প্রণয়নের ঘোষণা দেন। সেই অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ওই বছরের ৩১ জুলাই একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। পরবর্তী ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরেও একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

উল্লেখ্য, ২০০৬ সাল থেকে বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছিল। ২০১৯ সাল থেকে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির বছরে একবার মুদ্রানীতি প্রণয়নের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ওই বছরের ৩১ জুলাই একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। পরবর্তী ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরেও একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্প্রতি ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বছরে চারবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার পরামর্শ দিয়েছে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্য নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। আর পরিসংখ্যান ব্যুরো বছরে দুইবার এসব তথ্য প্রকাশ করে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকও বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন