আমেরিকা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেনকে আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। কিন্তু এ অস্ত্র ব্যবহারে শর্ত দেওয়া হয়েছে। শর্ত হলো আমেরিকান মিসাইল দিয়ে বিয়ন্ড বর্ডার রাশিয়াতে আক্রমণ করা যাবে না। ফলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধটা ইউক্রেনের সীমানাতে সীমাবদ্ধ থাকছে, রাশিয়ার ভূখÐে যুদ্ধ হচ্ছে না। অবকাঠামোসহ অন্যান্য সকল ক্ষয়ক্ষতি ইউক্রেনে হচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা চাচ্ছে যুদ্ধটা ইউক্রেনের সীমানায় সীমাবদ্ধ রাখতে। যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও মনে রাখা দরকার, জাতিসংঘ অদ্যাবধি কোনো যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। এ যুদ্ধে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশ জ্বালানির জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। সাধারণত অক্টোবর থেকে ইউরোপে শীত শুরু হয়। বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা না হলে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে ইউরোপীয় দেশগুলোকে। ইতোমধ্যে বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্বে খাদ্য পণ্যের দাম বেড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডবিøউ এফপি) গত জুনের তথ্য মোতাবেক ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এ মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশে খাদ্য সরবরাহ করা না গেলে ঐ সব দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। বিশেষ করে, কেনিয়া ও ইথিওপিয়ায় জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সহায়তা পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে লাখ লাখ মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে। তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। এসব অঞ্চলে করোনা অতিমারি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যাভাব শুরু হয়।
জিডিপির আকার বিবেচনা করলে রাশিয়া বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম দেশ। বিশ্বের এক- তৃতীয়াংশ গম ও তুলা সরবরাহ করে রাশিয়া। আর তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বের এক- দশমাংশ তেল উৎপাদন করে রাশিয়া। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া। এছাড়াও রাশিয়া সূর্যমুখী তেল ও ভুট্টা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকে। রাশিয়ার সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আরও একটা বড়ো প্রকল্প হলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২। এ সব প্রকল্প রাশিয়ার সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জামসহ বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতি ও সার ক্রয় করে। এছাড়াও বাংলাদেশ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম, ভুট্টা ও তেল বীজ কিনে থাকে। বাংলাদেশের গমের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ এবং ভুট্টার এক-পঞ্চমাংশ আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। বিশ্বের সিংহভাগ সার রপ্তানি করে রাশিয়া ও বেলারুশ। রাশিয়ার উপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সার সংগ্রহে সমস্যা হবে। ফলে এ বছর কৃষি পণ্য উৎপাদনে সমস্যা না হলেও আগামীতে কৃষককে সময়মতো সার সরবরাহে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমান সরকার তাই ইতোমধ্যেই কিছু কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।
বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার উপর আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের বিভিন্ন রকমের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর বিভিন্ন মাত্রায় পড়বে, এটাই বাস্তবতা। যদিও রাশিয়া ও ইউক্রেনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ খুব বেশি না; তবুও হাজার হাজার মাইল দূরের দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান অসম যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পড়ছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ রাশিয়ার থেকে অনেক এগিয়ে আছে। রাশিয়া থেকে যে পরিমাণ গম, সার স্টিল বা এলুমিনিয়াম বাংলাদেশ আমদানি করে তার থেকে বেশি তৈরি পোশাক রাশিয়ায় রপ্তানি করা হয়। ২০২০-২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশ ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে তৈরি পোশাকের পরিমাণ বেশি। আর আমদানি করা হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য, যার বেশির ভাগ খাদ্য পণ্য। বাংলাদেশের গমের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ গম আমদানি করে এবং রপ্তানি করে তৈরি পোশাক। এর পরিমাণ খুব বেশি না। তবে এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এ দুই দেশে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবিলা ২০২০ সাল থেকে বিশ্ব অর্থনীতি ছিল টালমাটাল। দেশে দেশে লক ডাউনের কারণে সবকিছুই ছিল বন্ধ। সংক্রমন যখন নিয়ন্ত্রণে এলো সবকিছু যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করলো মানুষ যখন কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।
বাংলাদেশ বিশ্ব থেকে বিছিন্ন নয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়া বছরে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি তৈরি পোশাক আমদানি করে। রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংককে বৈশ্বিক আন্তব্যাংক লেনদেন সংক্রান্ত সুইফট সিস্টেমে নিষিদ্ধ করায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি হুমকির মুখে পড়েছে। যে সব তৈরি পোশাকের অর্ডার শিপমেন্ট হয়েছে তার পেমেন্ট পাওয়াও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে তেল, গ্যাসসহ খাদ্যপণ্যের সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রভাব ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশে পড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দাসহ মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে ফলে জীনসপত্রের দাম বাড়ছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। ডলারের তুলনায় বিশ্বের প্রায় সকল দেশের মুদ্রার মান পড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো। বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে ৭ শতাংশের কিছু বেশি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের ৭.০১, পাকিস্তানের ৩৮, নেপালের ৭.২৮ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯.১, ইরানে ৩৯.৩, জার্মানিতে ৭.৯, কানাডায় ৬.৮, তুরস্কে ৭৩.৫ এবং ভেনেজুয়েলায় ২২২ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। মার্কিন অর্থনীতিতে এখন ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব মন্দার মধ্যেও অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো।
তবে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। ডলারের তুলনায় ইতোমধ্যে টাকার মান কমে গেছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও নেমে গেছে। বাংলাদেশ আপাতদৃষ্টিতে ঝুঁকি মুক্ত মনে হলেও সরকার ইতোমধ্যে দেশবাসীকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে আমাদের দেশের সম্ভব্য ক্ষতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে নানামুখী পদক্ষেপে গ্রহণ করেছে। জনগণের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করে তাদের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা, বিদেশ ভ্রমণ কমানো, সক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কম করে জ্বালানি সাশ্রয় করা, গাড়ির ব্যবহার সীমিত রাখাসহ নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ক্রয়-বিক্রয় মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সহজে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা পাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ সব পদক্ষেপের সুফলও আসতে শুরু করেছে। -পিআইডি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন