মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফেতর ও ঈদুল আজহা। সারা বিশ্বে মুসলিম স¤প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত জাঁকজমক ও ধূমধামের সাথে এই ধর্মীয় দিবস দুটি পালিত হতে দেখা যায়। বাঙলা দেশে এখন যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, একশো বছর আগেও কি এভাবে হ’তো? সাধারণ মানুষ কি আজকের মতো অধীর আগ্রহ, উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন ঈদের চাঁদের দিকে? ঈদের ধূমধামের দিকে? ইতিহাস বলে “না”। তবে সে’ আমলে কিভাবে বাঙলা দেশে ঈদ উৎসব পালিত হতো? প্রথমেই বলে রাখা ভাল, বিশ্বাসের সঙ্গে জিজ্ঞাসা মেলে না। জ্ঞানের উৎস জিজ্ঞাসা। আর রসূল (দঃ) নিজেও বলেছেন জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন হলে সুদূর চীনেও যেতে। সুতরাং বর্তমান আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কারো ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি আঘাত দেয়ার জন্য আমার এ লিখা নয়। প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবার জন্য আমার এই অবগাহন। আমি একজন মুসলমান হয়ে নিজেকে অত্যন্ত গৌরাবান্বিত মনে করি। রমজান মাস মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র মাস এবং কোরানে একমাত্র এ মাসের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। এ মাসেই নাজিল হয়েছিল কোরআন, প্রথম অহী পেয়েছিলেন মুহাম্মদ (সাঃ), গিয়েছিলেন তিনি মেরাজে। মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার আগে রমজানের সঙ্গে পরিচয় ছিল না মুসলমানদের। এর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল হিজরতের পরেই। ইসলাম প্রচারের শুরুতে অর্থাৎ আদি বাঙালি মুসলমানরা কিভাবে ঈদ উৎসব পালন করতো তা রীতিমত গবেষণার বস্তু। উৎসব হিসাবে বাঙলাদেশের মানুষ শত বর্ষ আগে ঈদের দিনটি কিভাবে পালন করতেন সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়না। এদেশের হিন্দু, মুসলমান যিনিই আত্মজীবনী লিখে গেছেন তাদের রচনায় আমরা দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, মুহররম, এমনকি রথ যাত্রা, দোল পূর্ণিমা, দিপালী উৎসব এরূপ বিভিন্ন পুজা পার্ব্বণ সম্পর্কে বিস্তর উল্লেখ দেখতে পাই। শুধু পাওয়া যায়না ঈদুল ফেতর সম্পর্কে। এ থেকে যদি বলি ঈদুল ফেতর সেকালে বাঙলাদেশে তেমন কোনো বড় উৎসব হিসাবে পালন হয়নি তবে কি তা’ ভুল বলা হবে? মনে হয় নিশ্চই না। আজ আমরা যে ঈদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি, বাঙালীর ঈদকে দেখি একটা সামাজিক ধর্মীয় বড় উৎসব হিসেবে তা’ কিন্তু সত্তর, আশি বছরের ঐতিহ্য মাত্র। ব্রিটিশ আমলে যে উৎসব সবচেযে ধুমধামের সঙ্গে এ বাংলায় প্রচলিত ছিল এবং ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি ছুটি বরাদ্দ ছিল তা হলো খ্রিস্ট স¤প্রদায়ের “ক্রিসমাস ডে”। ব্রিটিশ আমলে বিদ্যার দিক থেকে মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের থেকে ছিল অনেক পিছিয়ে। ফলে “ক্রিসমাসের” পরেই সরকারিভাবে তো বটেই স¤প্রদায়গত আধিপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণে এই অঞ্চলে হিন্দুদের “দুর্গাপূজা” হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়, জাঁকালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। অফিস আদালতে ইংরেজ আমলে সরকারি ছুটির পরিমাণ ঈদের থেকে পূজার জন্য ছিল অনেক বেশি। সে আমালে সরকারি নথি পত্রেও পূজা সম্পর্কে আছে পর্যাপ্ত তথ্যাদি। শাসক ইংরেজরা স্বাভাবিক ভাবেই মুসলমানদের ঈদকে গুরুত্ব দেয়নি। এজন্য সরকারি ছুটিও বরাদ্দ ছিল কম। ঈদ মুসলমানদের প্রধান উৎসব হিসেবে পালিত না হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ ছিল বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। ফরায়েজী আন্দোলোনের আগে (১৮১৮ খ্রিঃ) গ্রামাঞ্চলে মুসলমানদের কোনো ধারণা ছিলনা বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে। ইসলাম ধর্মে লোকজ উপাদানের আধিপত্য ছিল প্রায়ই ক্ষেত্রেই হিন্দু রীতি নীতির উপর। ১৮৮৫ সালে জেমস্ ওয়াইজ তাঁর æঘড়ঃবং ড়হ ঃযব জধপবং ঈধংঃড়ৎং ধহফ ঞৎধফবং ঊধংঃবৎহ ইবহমধষ” বইতে লিখেছেন “বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানরা সরল অজ্ঞ কৃষক। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ঈদের দিনে গ্রামবাসীরা জমায়েত হয়েছে ঈদের নামাজ পড়বেন বলে, কিন্তু সে সময়ে দুর্ভাগ্য এই যে, জামায়েতের একজনও জানতেন না কিভাবে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় নৌকা যোগে এক যুবক যাচ্ছিলেন তাকেই ধরে নিয়ে এসে পড়ানো হয়েছিল ঈদের নামাজ”। ঐতিহাসিক মুনতাসির মামুন উল্লেখ করেছেন তাঁর পিতার সহকর্মী যিনি ছিলেন সে আমলে একজন নামজাদা পীর, তাঁকে বলেছিলেন “মুসলমান ছিলাম বটে [তাঁর জন্ম ১৮৯৮ সালে] কিন্তু ছেলে বেলায় রোজা বা ঈদ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারনা ছিলনা। মসজিদ ছিল হয়তো কয়েক গ্রাম মিলে একটি। স্থানে স্থানে দরগা ছিল। মুসলমানরা তহবন্দ বা লুঙ্গি পরিতনা। কাচা কোঁচা দিয়া ধূতি পরিধান করিতো। তাদের অনেকেই নাম ছিল যেমন গোপাল, ঈশান, ধীরেন ইত্যাদি। আবুল মনসুর আহমেদ তাঁর আত্মজীবনীতে আরো লিখেছেন তাদের গ্রামাঞ্চলে ছিলনা কোনো মসজিদ। সে সময় বয়স্করা ও সকলে রোজা রাখতেন না। দিনের বেলা তারা তামাক ও পানি খেতো। শুধু ভাত খাওয়া থেকে বিরত থাকতো। পানি ও তামাক খাওয়াতে রোজা নষ্ট হতো না। এই বিশ্বাস ছিল তখন তাদের মনে। রোজার মাসে মাঠে যাবার সময় একটা বাঁশের চোঙ্গা রোজা দাররা সঙ্গে রাখতেন। পানি বা তামাক খাওয়ার শখ হলে এই চোঙ্গার খোলা মুখে মুখ লাগিয়ে খুব জোরে দম ছাড়া হতো। মুখ তোলার সঙ্গে সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি গামছা, নেকড়া বা পাটের ঢিপলা দিয়ে চোঙ্গার মুখ কষে বন্ধ করা হতো, যাতে বাতাস বের হয়ে আসতে না পারে। তারপর আবশ্যক মতো পানি ও তামাক পান করে চোঙ্গাটা আবার মুখের কাছে ধরা হতো। খুব ক্ষিপ্ত হাতে চোঙ্গার ঢিপলাটা খুলে মুখ লাগিয়ে চুষে চোঙ্গায় বন্ধ রোজা মুখে আনা হতো এবং ঢোক গিলে একেবারে পেটের মধ্যে ফেলে দেয়া হতো। ঈদের জামাতেও লোকেরা কাছা, ধূতি পরিধান করে যেতো। অজ্ঞতা ও কুসংস্কার তখন বাঙালি মুসলমান সমাজকে নিদারুণভাবে গ্রাস করে। মুসলমানদের এই অধঃপতন দেখে সে সময় ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরিয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০ খ্রীঃ) স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। হাজী শরিয়তুল্লাহ দীর্ঘকাল যাবত পূর্ব বঙ্গের মুসলমান সমাজ থেকে বহু অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার দূর করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সত্তর, আশি বছর আগেও ঈদুল ফেতর বাংলাদেশে বড় কোনো ধর্মীয় উৎসব হিসাবে পালিত হয়নি এ কথা নিঃশংসয়ে বলা যেতে পারে। সে আমলে জীবনের আধুনিক প্রাপ্যতা, জটিলতা, কৃষিজ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি গ্রামে তখন সহজলভ্য ছিলনা। তাই সে কালের বাংলার রোজা ও ঈদ একালে এখন অবশ্যই ভিন্নতর রূপ পেয়েছে। বছর ঘুরে আসে গ্রামে রোজা, রমজান মাস, গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে পরম বিশ্বাস চাঁদ দেখে রোজা শুরু, চাঁদ ওঠা দেখে রোজার শেষ। চাঁদই তাদের লক্ষ্য স্থল। রমজানের ঈদের চাঁদ দেখার জন্য একালে পাড়ায় পাড়ায় ধুম পড়ে যায়। পবিত্র ঈদের চাঁদ দেখে তারা সালাম করে। সালাম করে বাড়ীর গুরুজনদের। কখনও বা বাজী ফোটায়। বন্দুক মেরে দশ গ্রামের লোককে জানিয়ে দেয়। রাত্রিতে আতশ বাজী ও আলোক মালায় সজ্জিত করে আবাস গৃহ। সাইরেন বাজায়। ছেলে মেয়েদের মধ্যে ধুম পড়ে যায় রোজা রাখার জন্য। বিশেষতঃ ভোর রাতে সেহরী খাওয়ার সময় তাদের ঘুম থেকে না ডাকলে ভীষণ কুরুক্ষেত্র বেধে যায় পরদিন। রোজা থাকতে দাও আর না দাও অন্ততঃ শেষ রাতে উঠে সবার সঙ্গে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সেহরী খায়। এতে অনাবিল আনন্দ স্ফুর্তি ও প্রতিযোগিতা চলে কে বেশী রোজা রাখতে পারে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগেও আমরা গ্রাম বাংলার এরূপ স্বচক্ষে রমজান মাসে দেখেছি। এখন মনে হয় রমজানের রোজার শেষে যে ঈদ তা’নিছক অনুষ্ঠানিকতা না মুসলিম তথা বিশ্বমানবতার একটা দিক দর্শন এ প্রশ্ন আজ আমাদের সবার মাঝে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আগেও যেমন বঞ্চিত ছিলেন ঈদের আনন্দ থেকে এখনো বঞ্চিত আছেন তদ্রæপ প্রতিনিয়ত। মোগল আমলের ইতিহাসে আমরা দেখেছি ধনী বিত্তবানরা ঈদের দিন ছুড়ে দিচ্ছেন রেজগী পয়সা আর সাধারণ নিরন্ন, বঞ্চিত মানুষ তা কুড়িয়ে নিচ্ছেন কাড়াকাড়ি করে। এখনো তার এ আমলে কোনো হেরফের হয়নি, বরং বঞ্চনা আরো বেড়েছে। আমরা চোখের সামনে দেখেছি বাংলাদেশে ধনী, বিত্তবানদের জাকাতের শাড়ি নেয়ার জন্য দুস্থ, গরিব মানুষের হুটোপুটি, লাইন তা আমাদের হতভাগ্য, বঞ্চিত, দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের চেহারাই তুলে ধরে। সুতরাং ঈদুল ফেতরের আনন্দ সাধারণ মানুষের মনে আজ আর কোনই রেখাপাত করে না। ঈদুল ফেতরের জামায়াত এর আগে থেকেই বিত্তবানদের ফেতরার অর্থ ও সাহায্য নেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় শত শত ছিন্নমূল মানুষদের।
উৎসব সর্বাঙ্গীন আনন্দময়, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে তখনই যখন আসে বিত্ত বণ্টনের সামঞ্জস্য। তা না হলে ধর্মীয় উৎসবের (ঈদুল ফিতর) মুল আবেদন হ্রাস পায়। ফরায়েজী আন্দোলন এবং পরবর্তী ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনসমূহ পাল্টে দিতে পেরেছিল বাংলাদেশের এই মুসলমানদের মন-মানসিকতা। কিন্তু তা সত্তে¡ও লৌকিক, স্থানীয় উপাদানসমূহ বিভিন্ন সময় যুক্ত হয়েছে ঈদের সঙ্গে।
অনেকগুলিন এসেছে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন উৎসব ও লোকাচার থেকে। এ শতকের শুরু থেকেই যখন রাজনৈতিকভাবে মুসলিম স্বাতন্দ্রবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে ঈদ। বাংলাদেশের দু’টি ঈদ (ঈদুল ফেতর ও ঈদুল আজহা) জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। এদেশে স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে ঈদ এবং এখনও তা’ অবব্যাহত রয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে আগের অজ্ঞতা ও তেমন নেই এখনকার মুসলমানদের মধ্যে। ফলে স্বতস্ফূর্ত স্বাভাবিকভাবেই মুসলমান প্রধান দেশে ঈদ এখন নিজের গৌরবজ্জ্বোল, ঐতিহ্যমÐিত, স্থান করে নিয়েছে এবং আমাদের বাংলাদেশেও তা বিরাট গৌরবজ্জ্বোল ভূমিকা রেখেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় তামুদ্দনিক জাগ্রত্য করেছে এই ঈদুল ফেতর, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কবির ভাষায় বলতে গেলেÑ
“এসো মুসলিম তসলিম নাও,
নাও এ’ তৌহফা বেহেস্তের
তশতরী ভরে শীরনি বিলাও
নির্মল ইনসানিয়াতের ”
তথ্যসূত্রঃ (১) বাংলাদেশে ঈদ ঃ সেকাল একালঃ মুনতাসীর মামুন
(২) রোজা এবং ঈদের উৎসব ঃ সেকালেঃ আলমগীর জলীল (দৈনিক পূর্বাঞ্চল, খুলনা, ৭ জানুয়ারী ২০০০ ইং)
(৩) আত্ম চরিত্র ঃ কৃষ্ণকুমার মিত্র, কলকাতা ১৯৪৭ খ্রিঃ
(৪) আত্মকথা ঃ আবুল মনসুর আহমদ, ঢাকা ১৩৭৮ বাংলা
(৫) ঈদ ঃ আমাদের কালের কথাঃ খন্দকার আবু তালে, সাপ্তাহিক ঢাকা, ঈদ সংখ্যা ১৯৮৮ খ্রিঃ
(৬) ঢাকার ঈদ ঃ আব্দুস সাত্তার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন