মুসলিম ঈদোৎসবগুলির মধ্যে ঈদুল ফেতর ও ঈদুল আজহা- এই দুই ঈদকে প্রধান উৎসব বলে খোদ রসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন। হিজরতের পর এই ঈদ দুটি স্বয়ং আল্লাহতাআলার পক্ষ হতে রসূলুল্লাহ (সা.)কে দান করা হয় এবং এই সূত্রে তা মুসলিম উম্মাহ প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) মুসলমানদের জন্য এমন একটি আনন্দোৎসব, যার কোনো তুলনা হয় না। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর দুনিয়ায় আগমন উপলক্ষে মক্কায় তাঁর জন্মোৎসব পালন করার প্রথাটি পালন করেন খোদ রসূলুল্লাহ (সা.) এর মহান দাদা মহাত্মা আব্দুল মোত্তালেব। আব্দুল মোত্তালেব তাঁর পবিত্র জন্মোৎসবের সূচনা করে গেলেও মহানবী (সা.) এর জীবদ্দশায় তাঁর পবিত্র জন্মোৎসব উদযাপনের খবর জানা যায় না। গভীরভাবে চিন্তা করলে অনুধাবন করা যায়, দিবসটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য সর্বপ্রথম মহাত্মা আব্দুল মোত্তালেবই বুঝে ছিলেন। বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সকল সীরাত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের সুসংবাদে আব্দুল মোত্তালেব অসীম আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মক্কায় আনন্দ প্রকাশার্থে অনেক লোকের মধ্যে তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী, খাওয়ার দাওয়াতের আয়োজন করেছিলেন। হযরত মওলানা সৈয়দ মুফতী মোহাম্মদ আমীমুল এহসান মোজাদ্দেদী বরকতী (র.) এর বর্ণনা অনুযায়ী, বৃদ্ধ সর্দার আব্দুল মোত্তালেব পৌত্রের জন্মের সংবাদ শ্রবণ করে গৃহে আগমন করেন এবং নবজাতক শিশুকে খানা-ই-কাবায় নিয়ে যান ও দোয়া করেন। সপ্তম দিবসে আকীকা করে মোহাম্মদ (সা.) নাম রাখেন এবং সমগ্র কোরেশকে দাওয়াত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার এই সন্তান সমগ্র বিশ্বে প্রশংসার অধিকারী হবে’।
হযরত শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (র.) এ সম্পর্কে তার বিখ্যাত পুস্তক ‘মা সাবাতা বিসসুন্নাহ’য় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। ১২ রবিউল আউয়াল (সোমবার) রসূলুল্লাহ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন বলে প্রসিদ্ধ বর্ণনায় বলা হয়েছে। এদিন মক্কাবাসীরা রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মস্থানের জিয়ারত করত। জন্মরাতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে শেখ আব্দুল হক (র.) বলেন, এই রাত শবে কদর হতেও উত্তম। কেননা তাঁর শবেবেলাদত হচ্ছে তাঁর জন্মরাত এবং শবে কদর তাঁকে প্রদান করা হয়। যে রাত্রটিকে তাঁর আবির্ভাবে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে, এটি শবে কদর অপেক্ষা উত্তম, তাছাড়া শবে-কদরে শুধু আসমান হতে ফেরেশতারা আগমন করে থাকেন, পক্ষান্তরে জন্মদিবসের রাতে রসূলুল্লাহ (সা.) এর সুমহান সত্তার আবির্ভাব ঘটে। জন্মরজনীর শ্রেষ্ঠত্বের আরও একটি কারণ হচ্ছে এই যে, শবে কদরের শ্রেষ্ঠত্ব শুধু উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য নির্ধারিত। পক্ষান্তরে বাস্তব ঘটনা হচ্ছে রসূলুল্লাহ (সা.) এর মহান সত্তাকে আল্লাহতাআলা সকল জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ নির্ধারণ করেছেন এবং তারই মহান জাতিসত্তার গুণাবলীর কারণে আসমান ও জমিন এবং সকল মখলুকাতকে আল্লাহ তা’আলা সাধারণ নিয়ামত দ্বারা ধন্য করেছেন।
রসূলুল্লাহ (সা.)কে আল্লাহ তাআলা সমগ্র জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন বলে স্বয়ং পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল লিল আলামীন।’ সকল সীরাত গ্রন্থে রসূলুল্লাহ (সা.) এর দুনিয়ায় আগমনের খবরে আবু লাহাবের প্রতিক্রিয়ার ঘটনাটি উল্লেখিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হযরত শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (র.) এর বর্ণনাটি বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন: আবু লাহাবের বান্দীগণের মধ্যে সোওয়াইবা রসূলুল্লাহ (সা.) এর ভূমিষ্ট হবার সুসংবাদটি আবু লাহাবকে পৌঁছান। খবরটি শুনে আবু লাহাব বান্দী সোওয়াইবাকে মুক্ত করে দেন। আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার কোনো সঙ্গী তাকে স্বপ্নযোগে দেখেন এবং তার কী অবস্থা জিজ্ঞাসা করেন। আবু লাহাব জবাবে বলেন, ‘জাহান্নামে পড়ে রয়েছি, তবে এতটুকু অবশ্যই হয়েছে যে, প্রতি সোমবার রাতে আযাব কিছুটা হ্রাস করা হয়। আবু লাহাব তার দুই আঙ্গুলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন যে, এই আঙ্গুলদ্বয়ের ইঙ্গিতে আমি সোওয়াইবাকে ঐ কারণে আজাদ করেছিলাম যে, সে রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মলাভের সুসংবাদ জানিয়েছিল। এর বিনিময়ে ঐ দুই আঙ্গুল দ্বারা কিছু পানি পান করি। সোওয়াইবা সম্পর্কে আবু লাহাব বলেন, সে আমার আজাদকৃত বান্দী (দাসী) ছিল, রাসূলুল্লাহ (সা.)কে সে দুধও পান করিয়েছিল।
শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (র.) বলেন: সোওয়াইবাকে আজাদ করে আবু লাহাব এই বিনিময় লাভ করে যে, দোজখে অবস্থান করেও সে সপ্তাহে এক রাতের জন্য আনন্দ খুশি লাভ করে। যদি তাই হয় তবে সেসব মুসলমানের অবস্থা চিন্তা করা যায়, যারা রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মোৎসব উপলক্ষে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করে এবং তার মহব্বত-ভালবাসায় ক্ষমতানুযায়ী ব্যয় করে। আমার প্রাণের শপথ: রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মরজনীতে আনন্দ প্রকাশের কারণে আল্লাহতায়ালা তার সাধারণ দয়া-অনুগ্রহে আনন্দ প্রকাশকারীগণকে বেহেশতের বাগানে দাখিল করবেন। মুসলমনগণ সব সময় মীলাদ-মাহফিলের আয়োজন করে আসছেন। মীলাদ মাহফিলের সঙ্গে সঙ্গে দাওয়াত করে থাকেন, খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং গরিব-দরিদ্রদের নানা রকমের উপহার-উপঢৌকন দিয়ে থাকেন। তারা আনন্দ প্রকাশ করেন এবং অকাতরে খরচও করেন। এতদ্ব্যতীত জন্মোৎসব উপলক্ষে কোরআন খতম করান এবং নিজেদের আবাসগৃহ সুসজ্জিত করেন। এসব উত্তম কাজের বরকতে ঐসব লোকের উপর আল্লাহর বরকত-রহমত হতে থাকে।
শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (র.) ইবনে জওযীর বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেন: মীলাদ-মাহফিল আয়োজনকারীদের জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে, মীলাদ অনুষ্ঠানকারীরা সারা বছর আল্লাহর আশ্রয়ে নিরাপদে থাকে এবং উদ্দেশ্য ও মকসুদ হাসিলের আনন্দ তাড়াতাড়ি উপভোগ করতে পারে। আল্লাহ তাআলা রহমত নাজিল করেন মীলাদুন্নবীর রাতে যারা ঈদোৎসব পালন করে তাদের প্রতি। আর যাদের অন্তরে হঠকারিতা থাকে, তাদের অন্তর সে কাজে আরও শক্ত হয়ে যায়। আল্লামা কুসতুলানী রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাস- এই মতের সমর্থনে লিখেছেন যে, তাঁর জন্মতারিখে মক্কাবসীরা নিয়মিত জন্মস্থান জিয়ারত করত। তার এ উক্তি হতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মতারিখে মক্কাবাসীরা তাঁর জন্মস্থান জিয়ারত করত। এটি ওফাতের পূর্বের ঘটনা হওয়াই স্বাভাবিক। অর্থাৎ তাঁর জীবদ্দশায় মক্কী জীবনে মুসলমানগণ হজরতের জন্মস্থানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে এরূপ করে থাকতো। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে যে, মক্কায় হজরতের জন্ম হয় কোন স্থানে? এ সম্পর্কে হজরত থানভী (র.) তিনটি মতের কথা উল্লেখ করেছেন, শোয়াব, রাদম ও আসফান। যা হোক, এ ঘটনা মীলাদোৎসবের এক বড় দলিল। রসূলুল্লাহ (সা.) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের এসব ঘটনা তাঁর জন্মোৎসব বা ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সুতরাং বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মতের পক্ষ হতে তাঁর জন্মোৎসব অর্থাৎ ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করার প্রয়োজন ও গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ (সা.) এর আপন চাচা হযরত আব্বাস (রা.) ইবনে আব্দুল মোত্তালেবের একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঘটনাটি হাকিুমল উম্মত হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানভী (র.) তার ‘নাশরুত্তীব’ পুস্তকে উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি হুজুর (সা.) এর অনুমতিক্রমে প্রশস্তিসূচক একটি কাসিদায় তার জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কে থানভী (র.) বলেছেন: রসূলুল্লাহ (সা.) যখন তাবুক যুদ্ধ হতে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন হজরত আব্বাস (রা.) আরজ করেলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে আপনার কিছু প্রশংসা করার অনুমতি দান করুন।’ (যেহেতু হুজুর (সা.) এর প্রশংসা করা স্বয়ং আনুগত্য তাই), তিনি এরশাদ করেন, ‘বল আল্লাহ তোমার জবানের হেফাজত করুন।’ তখন হযরত আব্বাস (রা.) হুজুর (সা.) এর প্রশংসায় আটটি কবিতা সম্বলিত একটি কসীদা পাঠ করেন। এসব কবিতায় হুজুর (সা.) এর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। তিনি স্বয়ং এই কাসিদা শ্রবণ করেন। মূল কাসিদাটি হযরত থানভী (র.) এর উলেখিত পুস্তকে উদ্ধৃত হয়েছে।
এই ঘটনা হতে আরো প্রমাণিত হয় যে, রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মোৎসব পালন করার সময় তাঁর জীবনচরিত, আদর্শ ও শিক্ষা আলোচনা করা একান্ত আবশ্যক। তবে এরূপ আলোচনা বা মীলাদ মাহফিল কেবল তাঁর জন্মদিবস বা জন্মমাসেই সীমাবদ্ধ নয়, সর্বদাই তা করা উচিত। আরো উল্লেখ্যযোগ্য যে, হযরত হাসসান ইবনে সাবেত (রা.) ছিলেন একজন সাহাবী কবি। তার উপাধি ছিল ‘শায়েরুননবী’। তিনি রসূলুল্লাহ (সা.) এর উপস্থিতিতে তাঁর প্রশংসায় বহু কবিতা আবৃত্তি করেন। মীলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষে হুজুর (সা.) এর জীবনচরিত আলোচনা করার তাৎপর্য এতে সহজেই অনুমেয়।
আল্লাহর নামের সাথে যার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, যাঁর স্মরণকে স্বয়ং আল্লাহতাআলা সুমহান করেছেন, মাকামে মাহমুদ যাঁকে দান করেছেন, আল্লাহ তাঁর মর্যাদা সুউচ্চ করেছেন, তাঁর জন্মোৎসব-ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করার গুরুত্ব ও প্রয়োজন সর্বাধিক, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর আনুগত্যের সাথে তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের নির্দেশ রয়েছে। তাঁর প্রতি ভালবাসা, আল্লাহর প্রতি ভালবাসা স্বরূপ। যাঁর মধ্যে উত্তম আদর্শ, পবিত্র কোরআন যার মহান চরিত্র এবং যার প্রতি খোদ আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ দরূদ পাঠ করে থাকেন, তার জন্মোৎসব উদযাপন করার সৌভাগ্য আল্লাহর এক মহান অবদান। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেন: ‘এবং আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।’ (সূরা -ইনশেরাহ , আয়াত-৪)
এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোরআনের ভাষ্যকারগণ বহু মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করেছেন, যা একত্রিত করা হলে এক বিরাট গ্রন্থ হয়ে যাবে। কতিপয় হাদীসের আলোকে এখানে ব্যাখ্যার সার সংক্ষেপে প্রদত্ত হল:
ইবনে হাব্বান তার গ্রন্থে হযরত আবু সাঈদ (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আয়াতটি সম্পর্কে হযরত জিবরাইল (আ.)কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ এরশাদ করেন: ‘ইযা যুকিরতু যুকিরতা মায়ী’ আপনার স্মরণকে সমুন্নত করার অর্থ হচ্ছে, যখন আমাকে স্মরণ করা হয়, আমার সাথে আপনাকেও স্মরণ করা হয়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন যে, আয়াতের অর্থ হচ্ছে আযানে তাকবীরে, তাশাহুদে মিম্বরসমূহের উপর, খোৎবাসমূহে। সুতরাং যদি কেউ আল্লাহতাআলার এবাদত করে এবং প্রত্যেক কথায় তাঁর সত্যতা স্বীকার করে কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) এর রেসালতের সাক্ষ্য না দেয়, তাহলে তার এসব আমল নিষ্ফল। সে কাফেরই থেকে যাবে।
হযরত কাতাদাহ (রা.) বলেছেন যে, আল্লাহতাআলা তাঁর স্মরণকে দুনিয়া ও আখেরাতে বুলন্দ করেছেন- প্রত্যেক বক্তা, প্রত্যেক তাশাহুদ পাঠকারী-আশহাদু আল্লা ইলাহা-ইল্লাল্লাহুর সাথে আশহাদু আন্না মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহও উচ্চারণ করে থাকে।
কোনো কোনো তফসীকারের মতে, রসূলুল্লাহ (সা.) এর স্মরণের উচ্চ মর্যাদা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা সম্মানিত নবীগণ (আ.) থেকে তাঁর উপর ঈমান আনার জন্য ওয়াদা নিয়েছেন।
কেবল বিশ্বজগতে রসূলুল্লাহ (সা.) এর স্মরণ সীমাবদ্ধ নয়, যার কিছুটা বিবরণ উপরে বর্ণিত হয়েছে, এমনকি ‘আলমে গায়ব’ বা অদৃশ্য জগতেও তাঁর নাম অহরহ স্মরণ করা হচ্ছে। আলমে গাইবের তিনি হচ্ছেন সুলতান, কোনো স্থান মহল এমন নেই, যেখানে তাঁকে উত্তমরূপে স্মরণ করা হয় না, তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা না হয়। তাঁকে স্মরণ করা হয় কবরে, হাশরে এবং ফেরেশতাগণও জিজ্ঞাসা করেন মোহাম্মদ (সা.) এর আনুগত্য স্বীকার করেছিল কি’না, তাঁর অবাধ্য ছিল কি’না? তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল কি’না? জান্নাতের দ্বারসমূহে এবং আরশের উপরও তাঁর নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। অনুকূল, প্রতিকূল এমন কোনো তারিখ নেই, যাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে স্মরণ করা হয় না। অস্বীকারকারীরাও তাঁর প্রশংসা না করে পারে না, সমগ্র জগতে এমন কোনো স্থান নেই, যাতে তাঁকে স্মরণ করা হয় না। এর চেয়ে সুউচ্চ সম্মান আর কী হতে পারে? আল্লামা আব্দুল হক হক্কানী তার তফসীরে এসব বিষয় উল্লেখ করে বলেন যে, রসূলুল্লাহ (সা.) এর সমুন্নত স্মরণকে একটি সুউচ্চ প্রাসাদের সাথে তুলনা করা যায়। দ্বাদশ কক্ষ বিশিষ্ট এই প্রাসাদের প্রত্যেকটির পরিচালকই তিনি।
মোট কথা, রসূলুল্লাহ (সা.) এর গুণাবলী বর্ণনা ও প্রশংসা বলে শেষ করা যাবে না। তাই জন্ম দিবস পর্যন্ত তাঁর স্মরণ এ আলোচনা সীমাবদ্ধ করে তাঁর সুমহান মর্যাদাকে খাটো করা যায় না, বরং সারা বছরই তাঁকে স্মরণ ও জীবনী আলোচনা করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে সর্বপ্রকারের কল্যাণ।
ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান করা, দান-খয়রাত এবং আনন্দ প্রকাশ করার বৈধতা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের আমল রয়েছে বলে যারা মনে করেন, তারা এর সমর্থনে আল্লামা ইমাম শাহাবুদ্দীন আহমদ ইবনে হাজার আল হায়তামী শাফেয়ীকৃত ‘আন নেমাতুল কোবরা আলাল আলমে ফি মওলাদে সাইয়িদিল আনাম’ গ্রন্থের ৭ম পৃষ্ঠার বরাত দিয়ে বলেছেন যে, খোলাফায়ে রাশেদীন এ ব্যাপারে যেসব মন্তব্য করেছেন তা নিম্নরূপ: ১. প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি হুযুর (সা.) এর মীলাদ শরীফে এক দেরহাম বা টাকা ব্যয় করবে, সে আমার সাথে বেহেশতে অবস্থান করবে। ২. দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি হুযুর (সা.) এর মীলাদ শরীফকে ইজ্জত বা সম্মান করে সে যেন ইসলামকে পূর্ণজ্জীবিত করল। ৩. তৃতীয় খলিফা হযরত ঊসমান (রা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সা.) এর মীলাদ শরীফ উদযাপন করতে গিয়ে দেরহাম বা টাকা-পয়সা ব্যয় করবে, সে যেন বদর, হুনাইনের মতো মহান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। ৪. চতুর্থ খলিফা হযরত আলী মুরতাজা (রা.) বলেছেন: ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনকারী ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে।
ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষে অনুরূপ আরও বহু মূল্যবান মন্তব্য থাকলেও এ সম্পর্কে ভিন্ন মতামতও রয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয়, জাতীয়ভাবে আমাদের দেশেও যথার্থ ধর্মীয় মর্যাদা সহকারে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।
রসূলুল্লাহ (সা.)কে সোমবারের দিন রোযা রাখা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেন, তোমরা সোমবার রোযা রাখ, কারণ ঐদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং ঐদিন আমার প্রতি কোরআন নাযিল করা হয়েছে। মূল হাদীসটি হচ্ছে: ‘সুয়েলা রসূলুল্লাহ (সা.) আন সাওমিল ইসনাইনে ফা’কালা ফিহি উলিদতু ওয়াফিহি উনজিলা আলাইয়্যাল কোরআন।’
এই হাদীস দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মদিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সহজেই অনুমিত হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন