শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদ এ মিলাদুন্নবী

তিনি কেমন ছিলেন

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০২১, ১২:১৩ এএম

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কোনো তুলনা নেই। কোনো ক্ষেত্রেই নয়। দৈহিক চেহারা, সৌন্দর্য, চারিত্রিক মাধুর্য, মানবিক গুণাবলী- সব ক্ষেত্রেই তিনি অতুল্য। হযরত আলী (রা.) রাসুলেপাক (সা.) সম্পর্কে বলেছেন: ‘তাঁর মতো মানুষ তাঁর আগেও দেখিনি, পরেও দেখিনি।’ তাঁর এই সাক্ষ্যের বরাবর আর কোনো সাক্ষ্য হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) কেমন ছিলেন তার বিবরণ-বর্ণনা অনেকেই দিয়েছেন। আমরা এখানে দুটি বিবরণ উল্লেখ করবো।

এক.
সিরাতে ইবনে হিশামে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আলী ইবনে আবু তালিবের পুত্র মুহাম্মদের পুত্র ইব্রাহিম থেকে গুফরার আজাদকৃত দাস উমার রাসূল (সা.) এর দৈহিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যে বর্ণনা দেন, তা নিম্নরূপ: ‘আলী ইবনে আবু তালিব যখনই রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রশংসা করতেন তখনই বলতেন, ‘তিনি অধিক লম্বা ছিলেন না। আবার খুব বেটেও ছিলেন না। বরং তিনি উচ্চতায় সবার মধ্যে মধ্যম আকৃতির ছিলেন। তাঁর চুল অত্যাধিক কুঞ্চিত ছিল না, আবার একেবারে অকুঞ্চিতও ছিল না। বরং তা কিঞ্চিত কোঁকড়ানো ছিল। তিনি খুব বেশি স্থূল বা মোটা দেহের অধিকারী ছিলেন না। তাঁর মুখমণ্ডল একেবারে গোলাকার ও ক্ষুদ্র ছিল না। চোখ দুটি ছিল কালো। ভ্রু যুগল ছিল লম্বা। গ্রন্থির হাড়গুলো ও দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তী হাড়টি ছিল উঁচু ও সুস্পষ্ট। বক্ষ থেকে নাভি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল ছিল হালকা লোমে আবৃত। হাত ও পায়ের পাতা ছিল পুষ্ট, চলার সময় পা দাবিয়ে দিতেন না, মনে হতো যেন কোনো নিম্নভূমিতে নামছেন। কোনো দিকে ফিরে তাকালে গোটা শরীর নিয়ে ফিরতেন। তাঁর দুই স্কন্ধের মাঝখানে নবুয়তের সিল বা মোহর লক্ষণীয় ছিল। বস্তুত: তিনি ছিলেন শেষ নবী, শ্রেষ্ঠ দানশীল, শ্রেষ্ঠতম সাহসী, অতুলনীয় সত্যবাদী, সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, সবচেয়ে অমায়িক, মিশুক। প্রথম নজরে তাঁকে দেখে সবাই ঘাবড়ে যেতো।’

দুই.
রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় পথিমধ্যে অবস্থিত উম্মে মা’বদ ও তাঁর স্বামী আবু মা’বদের কুটিরে উপস্থিত হন। এই পুণ্যাত্মা দম্পতি ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিকদের তাঁদের কুটিরে আশ্রয় দিয়ে খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করেন। হুজুর (সা.) যখন তাঁদের কুটিরে উপস্থিত হন তখন আবু মা’বদ ঘরে ছিলেন না। মেষ চরাতে গিয়েছিলেন। হুজুর (সা.) ও তাঁর সঙ্গীরা উম্মে মা’বদের কাছে জানতে চান, সেখানে খাদ্য ও পানীয় কেনার সুযোগ আছে কিনা। উম্মে মা’বদ বিষণ্ন বদনে উত্তর দেন, সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকলে মূল্য দিতে হতো না। কুটিরের এক প্রান্তে একটি ছাগী শুয়ে ছিল। হযরত (সা.) উম্মে মা’বদের কাছে জানতে চাইলেন, ছাগী দোহন করে দুধ সংগ্রহ করা যাবে কিনা। উত্তরে উম্মে মা’বদ বলেন, ছাগীটি কৃষ ও দুর্বল। যদি তার স্তনে দুধ থাকে তবে তা তিনি দোহন করতে পারেন। হুজুর (সা.) ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তাকে দোহন করলেন। আল্লাহর ফযলে যথেষ্ট দুধ পাওয়া গেলো এবং তিনি ও তাঁর তিন সঙ্গী তা পান করলেন। দুধের একটা অংশ গৃহমালিকদের জন্যও রইল। অতঃপর তাঁরা সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।

আবু মা’বদ ঘরে ফিরে দুধের কথা জিজ্ঞাসা করায় উম্মে মা’বদ পুরো ঘটনা তাকে বিবৃত করে শোনান। উম্মে মা’বদ রাসূল (সা.) এর যে বর্ণনা দেন, বিভিন্ন সিরাত গ্রন্থে তার উল্লেখ রয়েছে। মোহাম্মদ আকরম খাঁ রচিত ‘মোস্তফা-চরিতে’ তিনি আরবি থেকে বাংলায় সে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন, এখানে তা উদ্ধৃত হলো।
‘তাঁহার উজ্জ্বল বদনকান্তি, প্রফুল্ল মুখশ্রী, অতিভদ্র ও নম্র ব্যবহার। তাঁহার উদরে স্ফীতি নাই, মস্তকে খালিও নাই। সুন্দর, সুদর্শন, সুবিস্তীর্ণ কৃষবর্ণ নয়ন যুগল। কেশকলাপ দীর্ঘ ঘন সন্নিবেশিত। তার স্বর গম্ভীর, গ্রীবা উচ্চ, নয়নযুগলে যেন প্রকৃতি নিজেই কাজল দিয়া রাখিয়াছে, চোখের পুতুলি দুইটি সদা উজ্জ্বল, চঞ্চল, ভুরু যুগল নাতিযুগ্ম পরস্পর সংযোজিত, স্বত কুঞ্চিত ঘনকৃষ কেশদাম। মৌনাবলম্বন করিলে তাঁহার বদনমণ্ডল হইতে গুরুগম্ভীর ভাবের অভিব্যক্তি হইতে থাকে আবার কথা বলিলে মনপ্রাণ মোহিত হইয়া যায়। দূর হইতে দেখিলে কেমন মোহন, কেমন মনোমুগ্ধকর সে রূপরাশি, নিকটে আসিলে কত মধুর, কত সুন্দর তাহার প্রকৃতি, ভাষা অতি মিষ্ট ও প্রাঞ্জল, তাহাতে ত্রুটি নাই, অতিরঞ্জন নাই, বাক্যগুলি যেন মুক্তার হার। তাঁহার দেহ এত খর্ব নহে যাহা দর্শনে ক্ষুদ্রত্বের ভাব মনে আসে বা এমন দীর্ঘ নহে, নয়ন যাহা দেখিতে বিরক্তি বোধ করে, তাহা নাতিদীর্ঘ নাতিখর্ব। পুষ্ট ও পুলকে সে দেহ যেন ফুল্লকুসুমিত নববিটপীর সদ্য পল্লবিত প্রশাখা। সে মুখশ্রী বড় সুন্দর, বড় সুদর্শন ও সুমহান। তাঁহার সঙ্গীরা সর্বদাই তাহাকে বেষ্টন করিয়া থাকে। তাঁহারা তাঁহার কথা আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করে এবং তাঁহার আদেশ উৎফুল্লচিত্তে পালন করে।’

‘স্ত্রীর মুখে এই বর্ণনা শ্রবণ করিয়া আবু মা’বদ উত্তেজিত স্বরে বলিলেন, আল্লাহর দিব্যি, ইনি কোরেশের সেই ব্যক্তি, ইহারই সম্বন্ধে আমরা কত সত্য মিথ্যা শ্রবণ করিয়াছি। আমার দূরদৃষ্ট, এমন সময় অনুপস্থিত ছিলাম। নচেৎ আমি নিশ্চয়ই তাঁহার স্মরণ লইতাম, সুযোগ পাইলে এখনো তাঁহার চেষ্টা করিব।’ (মোস্তফা চরিত)।
কবি বলেছেন: ‘নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি আমার মোহাম্মদ রাসুল’। বস্তুত তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Josim Uddin ২০ অক্টোবর, ২০২১, ৬:০৫ পিএম says : 0
এ জি লিওনার্দ বলেন, পৃথিবীতে বাস করে যদি কোনো মানুষ আল্লাহকে দেখে থাকেন, যদি কোনো মানুষ ভালো ও মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করে থাকেন, তা হলে এ কথা নিশ্চিত সত্য যে, আরবের নবী মুহাম্মদ সা: সেই ব্যক্তি। মুহাম্মদ সা: যে কেবল সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন তা নয়; বরং এ যাবৎ মানব ইতিহাসের যত মানুষের জন্ম হয়েছে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানব একমাত্র তিনি (অনুপম আদর্শ : ৪৫১)।
Total Reply(0)
Baadshah Humaun ২০ অক্টোবর, ২০২১, ৬:০৬ পিএম says : 0
বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক ড. গিবন ‘রোমান সাম্রাজ্যের পতন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বস্তুতপক্ষে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আনীত শরিয়ত সর্বলোকের জন্য প্রযোজ্য। এ শরিয়ত এমন বুদ্ধিবৃত্তিক মূলনীতি ও এ ধরনের আইনগত ভিত্তিতে রচিত যে, সমগ্র বিশ্বে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না (মা’আরিফুল কুরআন, খণ্ড-১ পৃ. ১৬৩)।
Total Reply(0)
Kamrul Hassan ২০ অক্টোবর, ২০২১, ৬:০৮ পিএম says : 0
রাব্বুল ইজ্জতের পক্ষ থেকে তিনি মানবতার সামগ্রিক জীবনের জন্য এমন আদর্শবাণী ও শিক্ষা নিয়ে আসেন, যা ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মানুষদের পরিণত করে ইতিহাসের সর্বোত্তম স্বর্ণমানবে, যা মানবতাকে সন্ধান দিলো ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সামগ্রিক সফলতার এক সোনালি স্মরণীয় মানুষের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজজীবন ও রাজনৈতিক জীবন ধীরে ধীরে হয়ে উঠল সুস্থ, সুন্দর, প্রশান্ত ও কল্যাণময়। মানুষে মানুষে গড়ে উঠল সাম্য, মৈত্রী, মানবতা, একাত্মতা ও ভ্রাতৃত্বের মহান বন্ধন।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন