এ বিশ্বে কিছু লোক আছে, যারা বুঝেও বুঝে না, দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না। অথচ, তারা অন্ধও না, উন্মাদও না এবং কালাও না। তারা বরং অধিকাংশ মানুষের তুলনায় পার্থিব বিষয়ে একটু বেশি বোঝে। যেমন আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, ‘আর আমি বহু মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য, তাদের হৃদয় রয়েছে তবে তারা বুঝতে চায় না। আর তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় এবং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর তারাই গাফেল শৈথিল্যপরায়ণ।’ আর একদল লোক আছে, যারা নবী-রাসূল (সা.)গণের মোজেজাগুলোকে বিকৃত অর্থ করে জনসমক্ষে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন, এগুলো কোনো মানুষ দ্বারা সম্ভব না, এটা আল্লাহ পাকের কাজ। যেমন, তাদের কথা হলো পিতা ছাড়া সন্তান জন্ম নিতে পারে না। হযরত ঈসা (আ.)-এর পিতা আল্লাহ পাক নিজেই। (নাউজুবিল্লাহ)। হযরত উজাইর (আ.) ১০০ বৎসর মৃত থাকার পর আবার জিন্দা হয়ে মানুষের নিকট আল্লাহর দ্বীন প্রচার করেছেন। কোনো মানুষের পক্ষে যেহেতু ১০০ বছর মৃত থেকে আবার জিন্দা হওয়া সম্ভব না, এমনটি হলে বলতে হবে তিনিই আল্লাহ (নাউজুবিল্লাহ)।
মোট কথা, অলৌকিক কিছু দেখলেই তারা মানুষকে মানুষ মনে না করে অন্য কিছু ভাবতে থাকেÑ কেউ দেবতা, কেউ আল্লাহর পুত্র, কেউ আবার আল্লাহ মনে করে তার ইবাদতই আরম্ভ করে দেয়। এহেন চেতনা ধর্মহীনতা ও পথভ্রষ্টতার মূর্ত প্রতীকÑ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পক্ষান্তরে বিশ্বমানবের সৌভাগ্যের পরশমণি, মানব সভ্যতার চরম উৎকর্ষ সাধনে পূর্ণ বিজয়ী, শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তির দূত সায়্যেদুল মুরছালীন, আঁকায়ে নামদার তাজেদারে মদীনা, নূরে মুজাচ্ছাম, হুজুরে পুরনুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম-এর কথা আলাদা। তার মোজেজার শেষ নেই, সমস্ত নবী-রাসূলদের মোজেজার সমষ্টি, হুজুরে পাক (সা.)-এর মোজেজার নিকট অতি নগণ্য।
যাকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ পাক এই পৃথিবী-ই সৃষ্টি করতেন না, যার সাথে দেখা ও কথা বলার জন্য আল্লাহ পাক হযরত জিব্রাইল (আ.)কে বোরাকসহ পাঠিয়ে সসম্মানে আরশে মোয়াল্লায় আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন, যার জুতা মোবারক আরশে মোয়াল্লা ধন্য করেছিল, যার অঙ্গুলী হেলনে চাঁদ দু’ টুকরা হয়ে গিয়েছিল, যিনি সূর্যকে অস্ত যাওয়া থেকে বিলম্বিত করে দিয়েছিলেন, যার কথাগুলোকে আল্লাহ পাকের ওহী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, যার কাজগুলোকে আল্লাহপাকের মনোনীত কাজ বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যার ইচ্ছাগুলোকে আল্লাহপাক কার্যকর করেছেন এবং সমস্ত নবী ও রাসূলগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে তুলনাহীন করেছেন। সব মোজেজা ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে যাতে করে মানুষ তাকে মাবুদ মনে করে ইবাদত করা শুরু করে না দেয় অথবা হুজুর পাক (সা.)-এর মনে কোনরূপ অহংকার সৃষ্টি না হয়ে যায়, এই নিরিখে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, ‘(হে রাসূল!) আপনি বলুন, আমি তোমাদেরই ন্যায় একজন মানুষ মাত্র, (তবে পার্থক্য এতটুকু) আমার নিকট (আল্লাহ পাকের নিকট থেকে) ওহী আসে। তোমাদের মাবুদ একই মাবুদ।’ (সূরা কাহাফ, আয়াত ১১০)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ পাক হুজুর (সা.)কে বিনয় অবলম্বনের শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ পাক হুজুর (সা.)কে সমগ্র মানব জাতির উপর সর্বাধিক মর্যাদা দান করেছেন। তিনি নবী ও রাসূলগণের দলপতি। তিনি সর্বোত্তম সৃষ্টি, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, খাতিমুন নাবিয়্যিন। ইহকাল ও পরকালে তার মর্যাদা সর্বোচ্চ। তাই তিনি যেন অহংকার না করেন। এ জন্য আল্লাহপাক আদেশ দিয়েছেন, আপনি সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিন যে, আপনি একজন মানুষ। আমার যা কিছু আছে সবই আল্লাহপাকের দান। তিনি এক, অদ্বিতীয়, অন্য কোন শরীক নেই। তিনি সবার একমাত্র মাবুদ। তিনি ব্যতীত আর কেউ বন্দেগীর যোগ্য নয়। আল্লাহ পাকই স্রষ্টা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা, সকলের ভাগ্যনিয়ন্তা। তিনি সব কিছুর অধিকর্তা, আমি তার বান্দা ও রাসূল। আমাকে রাসূল মেনে নিয়ে শুধু আমার অনুসরণ কর। আমার প্রশংসার সীমালংঘন কর না, বন্দেগী একমাত্র আল্লাহ পাকেরই প্রাপ্য।
উপরোক্ত আলোচনার সারমর্ম হলো:ঃ হুজুরে পাক (সা.) একজন মানুষ ছিলেন। আর দশজন মানুষের মতো হাত, পা, নাক, কান, চক্ষু, অর্থাৎ একজন মানুষের যে সব। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে হুজুরে পাকের মধ্যে সবই বর্তমান ছিল। মানুষ যেভাবে দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, সুখ অনুভব করে, হুজুরে পাকের মধ্যেও সেগুলো ছিল। তাকেও খেতে হতো, ঘুমাতে হতো, আরাম করতে হতো, পায়খানা-প্রস্রাব করতে হতো, কেটে গেলে রক্ত বেরোত ইত্যাদি। তারপরও কথা থেকে যায়, তিনি কি আমাদের মতই মানুষ ছিলেন? অন্য দশজনের সাথে কি তার তুলনা হয়? না, হয় না। হতে পারে না, হওয়া সম্ভবও নয়।
কবির ভাষায়, ‘মুহাম্মাদুন বাশারুন লাকাল বাশারি, অল ইয়াকুতু হাজারুন লা কাল হাজারি’, অর্থাৎ ইয়াকুত পাথর হলেও অন্যান্য পাথরের সাথে যেমন কোন তুলনা হয় না, ঠিক মুহাম্মাদ (সা.) মানুষ হলেও অন্য মানুষের সাথে কোনো তুলনা হয় না।
লক্ষ করুন, হীরা, পান্না, ইয়াকুত, জমরুদ কি পাথর নয়? পাহাড় থেকে এনে যে পাথর দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয় সেগুলো কি পাথর নয়? উভয়ের মূল্য কি এক? ঠিক তেমনই হুজুরে পাক (সা.) মানুষ হয়েও অন্যসব মানুষ থেকে আলাদা, তিনি স্বতন্ত্র এক পবিত্র সত্তা।
১. হুজুরে পাক (সা.) নবী ছিলেন। তিনি দাবি করতেন, আমি আল্লাহর রাসূল। অন্য মানুষ এ দাবি করলে হয়ে যাবে কাফের।
২. হুজুরে পাক (সা.)-এর উপর তাহাজ্জুদ ওয়াজিব ছিল। কিন্তু আমাদের উপর তা নফল।
৩. আরকানে ইসলাম ৫টির মধ্যে তার উপর ফরজ ছিল ৪টি, যাকাত তার উপর ফরজ ছিল না, আমাদের জন্যে ৫টিই ফরজ।
৪. হুজুরে পাক (সা.)-এর উপর বিবাহের সংখ্যা সীমিত ছিল না। আমরা এক সাথে চারটির বেশি স্ত্রী রাখতে পারি না।
৫. হুজুরে পাক (সা.)-এর স্ত্রীগণ মুমিনদের মাতা। তাঁর অবর্তমানে অন্যত্র তাদের বিয়ে জায়েয নয়। আর আমাদের অবর্তমানে বা তালাক দিলে অন্যত্র বিয়ে দেয়া জায়েয আছে।
৬. হুজুরে পাক (সা.)-এর পরিত্যক্ত সম্পত্তি বণ্টনযোগ্য নয়। যেমন বাগে ফেদাক হযরত মা ফাতিমা (রা.) মিরাছ সূত্রে পাননি। আমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি বণ্টনযোগ্য।
৭. হুজুরে পাক (সা.) একজন সাক্ষীকে দুইজনের সমমর্যাদা দিতে পারতেন। যেমন হযরত খুজাইমা (রা.)-এর বেলায়। আমরা তা পারি না।
৮. হুজুরে পাক (সা.) কিছুই না খেয়ে সওমে বেছাল পালন করতে পারতেন। হুজুর বলতেন, আমার পানাহার আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আসে। উম্মতের জন্য সওমে বেছাল জায়েয নয়।
৯. হুজুরে পাক (সা.) আল্লাহ পাককে দেখেছেন, বেহেশত-দোযখ, আরশ-কুরসী, মিজান, পুলছিরাত, কাউসার অর্থাৎ আল্লাহ পাকের সমস্ত সৃষ্টি দেখেছেন। আমরা এর কিছুই দেখিনি।
১০. হুজুরে পাক (সা.) ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। আমরা তা নই।
১১. হুজুরে পাক (সা.)-এর কোন ছায়া ছিল না। আমাদের আছে।
১২. হুজুরে পাক (সা.)-এর ঘামে ছিল আতরের গন্ধ। আর আমাদের ঘামে আছে দুর্গন্ধ। কবি বলেন:
‘আবওহ দিন নেহি কে পছিনা ভি গোলাব থানা
আব ইয়ে দিন হুয়াকে আতর ভি মলে তু খুশবু নেহি।’
অর্থাৎ এমন একদিন ছিল যখন ঘামেও খুশবু ছিল। আর এখন এমন দিন হয়েছে যে, আতর মালিশ করলেও সুগন্ধ আসে না।
১৩. আল্লাহ পাক ফেরেশতাগণকে নিয়ে যার উপর দরূদ পাঠ করেন।
১৪. আল্লাহ পাকের গুণবাচক নামের সাথে যার নাম জড়িত।
১৫. যাকে নবী বলে স্বীকার না করলে আল্লাহপাক বান্দা হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন না।
১৬. হুজুরে পাক (সা.) সম্পূর্ণ নিপাপ।
১৭. হুজুরে পাক (সা.)-এর শাফায়াত কবুল করা হবে বলে আল্লাহপাক ওয়াদা করেছেন।
১৮. কিয়ামতের দিন ‘হামদ’-এর পতাকা হুজুরপাক (সা.)-এর হাতে থাকবে। সমস্ত রাসূল এবং তাদের উম্মতগণ সেই পতাকার নিচে সমবেত হবেন।
১৯. যাঁর নামের উসিলা দিয়ে হযরত আদম (আ.) ও বহু নবী-রাসূল তাদের দোয়া কবুল করিয়েছেন।
২০. আল্লাহপাক যাকে কোনদিন নাম ধরে ডাকেননি।
২১. আল্লাহপাক যাকে সালাম দিতেন।
২২. আল্লাহপাক যার অনিন্দ্য সুন্দর আদর্শকে সর্বকালের মানুষের জন্য অনুকরণ ও গ্রহণযােগ্য আদর্শ বলে ঘোষণা করেছেন।
২৩. যিনি সমস্ত নবীগণের ইমামতি করেছেন।
২৪. যার নিকট জিব্রাইল (আ.) অহী নিয়ে চব্বিশ হাজার বার উপস্থিত হয়েছেন ইত্যাদি। বহু বিষয় আরো আছে সেই সম্বন্ধে হুজুরে পাক (সা.)-এর সাথে অন্য কারো তুলনা হয় না। কাজেই সুরত এক হলেই মানুষ সবাই এক হয়ে যায় না। যেমন কবি রুমী বলেন, ‘গারবাসুরৎ আদমী ইনছা ঝুঁদে আহমদ আবুজাহল হাম একছা বুদে’Ñ গঠন প্রণালীতে যদি মানুষ সবাই সমমর্যাদার অধিকারী হতো তা হলে হুজুর পাক (সা.) এবং আবু জেহেল একই মর্যাদার হয়ে যেতÑ যা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।
হুজুরে পাক (সা.) সৃষ্টির সেরা আর আবু জেহেল নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। হুজুরে পাক (সা.) সবার আগে বেহেশতে প্রবেশ করবেন, যার স্থান হবে সবার উপরে। আর আবু জেহেল সর্বনিকৃষ্ট দোযখে প্রবেশ করতে বাধ্য হবে। পৃথিবীতে এমন কোন জ্ঞান নেই যা হুজুরে পাক (সা.)-এর জ্ঞানের সাথে তুলনা করা যায়। কোনও নবী-রাসূল বা মানুষ তার সমপর্যায়ের ছিল না অর্থাৎ তার সাথে অন্য কারো তুলনাই হয় না। সর্বদিক দিয়ে সর্ববিষয়ে তিনি ছিলেন সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ। রাস্তা নির্মাণের পাথর যেমন কোন দিনই ‘হীরা’র মর্যাদায় পৌঁছতে পারবে না তদ্রুপ সাধারণ মানুষ পারবে না মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বে আল্লাহ পাকের পরেই যার স্থান তার সমকক্ষ হতে।
কবি শেখ শাদী (রহ.) বলেন, ‘লা ইউমকিনুছ সানাউ কামা কানা হাক্কুহু। বাদ আজ খোদা বুজুর্গ তুই কিচ্ছা মুখতাছাড়।’ অর্থাৎ, আপনার শান বর্ণনা করা কোনো মতেই সম্ভব নয়, শুধু এটুকু বলা যায় যে, আল্লাহপাকের পরই আপনার স্থান। সুতরাং আমরা যেন কোনো অবস্থাতেই হুজুরে পাক (সা.)-কে অন্য মানুষের সাথে তুলনা করে বেয়াদবী না করি। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তার সাথে বেয়াদবীপূর্ণ কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার থেকে রক্ষা করুন। আমীন। (সংকলিত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন